নিউরো সাইন্সে আসলে আমরা কারো কথা শুনিনি। আমরা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলাম। যদিও স্বাচিবের লোকজন বাঁকা চোখে তাকাচ্ছিল। তবে বাধা দেওয়ার সাহস ছিল না।
-- ডাক্তার মো. মাহফুজুর রহমান
ডাক্তার মো. মাহফুজুর রহমান, সহযোগী অধ্যাপক নিউরো সার্জারি বিভাগ এবং ইউনিট প্রধান নিউরো ট্রমা, ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব নিউরো সাইন্সেস ও হাসপাতাল। জুলাই আন্দোলনে হতাহতদের দিয়েছেন আান্তারিকতার সাথে সেবা। পেশাগত দায়িত্ব পালনের বাইরেও জুলাই আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন তিনি। সশরীরে অংশ নিয়েছেন নাহিদ ইসলামদের ডাকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কর্মসূচিগুলোতে। তিনি দৈনিক সংগ্রামকে বলেছেন সেই সময়ের ঘটনা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইবরাহীম খলিল।
দৈনিক সংগ্রাম : আপনি চিকিৎসক হিসেবে নিউরো সাইন্স হাসপাতালে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মাঠে ময়দানের আন্দোলনেও সশরীরে অংশ নিয়েছেন। সেটা কোন স্পৃহা থেকে ?
ডাক্তার মো. মাহফুজুর রহমান : দীর্ঘ ১৫ বছর ধরেতো একটা ক্ষোভ ছিলই। বিশেষ করে যেভাবে আলেম সমাজকে নির্যাতন করতো, তার মানে যারাই ন্যায়ের কথা, সত্য কথা বলতো, কিভাবে তাদের দমানো যায়, নিষ্পেষণ করা যায়, সত্যি কথা হলো- আওয়ামী লীগ যে করেছে সেকথা স্পষ্ট। ভারতীয় আধিপত্যবাদ, আগ্রাসন, ফ্যাসিবাদ, হিন্দুত্ববাদ কিভাবে চাপানো যায় আমাদের দেশে সেটা থেকে কিন্তু আওয়ামী লীগের একটা ফ্যাসিবাদী চরিত্র ফুটে উঠেছে। আরও সত্য করে বলতে গেলে আমি আওয়ামী লীগকে কোন দেশী সংগঠন মনে করি না। এটাকে ভারতের বিজেপির উইং বলা যায়। এর উদ্দেশ্য একটাই কোনভাবেই যেন বাংলাদেশ উঠে দাঁড়াতে না পারে। যাতে সব সময় দমিয়ে রাখা যায়, এটা আওয়ামী লীগকে দিয়ে সম্ভব হয়েছে। আপনি দেখেন সেই শাপলা চত্বরের ঘটনা, তারপর ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠা দিয়ে পৈচাশিক নির্যাতন, তারপর বিডিআর হত্যাকান্ড, আমাদের দেশের চৌকস সেনাবাহিনীর অফিসার তাদের শেষ করে দেওয়া হয়েছে। এরপর যা ইচ্ছা তাই করেছে। এরকম অবস্থা থেকে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আওয়ামী বিরোধী মেন্টালিটি ছিল। জুলাই আন্দোলনের সময় আব্বা অসুস্থ ছিলেন। তিনি অরোরাতে ভর্তি ছিলেন। বসে বসে আন্দোলনের নিউজগুলো পড়তাম। তারপর ১৬ জুলাই যখন আবু সাঈদকে নির্মমভাবে গুলী করে হত্যা করলো, তখন আমার কাছে মনে হয়েছে একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে বসে থাকা ঠিক না। এরপর থেকে চিকিৎসার পাশাপাশি আন্দোলনে অ্যাগ্রেসিভ ছিলাম, সরাসরি মাঠে ছিলাম। এর দুইদিন পর নিউজে দেখলাম নাহিদকে আহত অবস্থায় পূর্বাচলে ফেলে গেছে। বাই দ্য বাই জানতে পারি তাকে ভর্তি করা হয়েছে গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে। তো ভাবলাম কিভাবে গণস্বাস্থ্যে যাওয়া যায়? সেই সুবাদে আমি গণ স্বাস্থ্যে গেলাম। গিয়ে দেখলাম নাহিদ একাই একটা কেবিনে। সেখানে তাকে একটা গাইনি কেবিনে রাখা হয়েছে। সেখানে গিয়ে গাইনিতে ছিল ফারজানা আপা, ওনার সাথে কথা বললাম। আপা বললেন, মাহফুজ ভাই আপনি যেতে পারেন। তবে সাবধানতার সাথে যেতে হবে। আমি তার কেবিনে গেলাম। তার ফাইলগুলো দেখলাম এবং দীর্ঘক্ষণ কথা বললাম। দেখলাম তার খুব আহত অবস্থা। বেধড়ক পেটানো হয়েছে। তার ডান কাঁধে, উরুতে চামড়ার নিচে রক্ত জমাট হয়ে আছে। তার সাথে কথা বলে দেখলাম তাকে হতাশ-ই মনে হলো। নাহিদের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্য ছিল এরা যাতে কোনভাবেই পিছিয়ে না পড়ে। আমি তাকে অনেক কথা-ই বললাম। নাহিদ তোমরা যদি এই অবস্থায় পিছিয়ে যাও, তাহলে তোমাদের লাশ কিন্তু ম্যানহোলে পাওয়া যাবে। যে লাশের কোন মূল্যায়ন থাকবে না। কেউ সেটা বুঝতেও পারবে না। আন্দোলন থেকে যদি পিছিয়ে যাও অথবা যদি পিছিয়ে পড়ো আর যদি তোমরা আন্দোলনকে ধরে রাখতে পারো; জেনে রাখো তাহলে তোমাদের সাথে গোটা বাংলাদেশ আছে। তোমাদের সাথে সমস্ত জনগণ আছে। এরপরও যদি তোমাদের মেরে ফেলে। নির্যাতন করে মেরে ফেলে, তাহলে তোমাদের পক্ষে পুরো পৃথিবী দাড়াবে। এটা একটা ইতিহাস হয়ে থাকবে যে তোমরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়েছো। তোমরা শক্ত ভয়েস রেইজ করেছো। এজন্য তোমাদের জাতি স্মরণ রাখবে। স্বর্ণের অক্ষরে তোমাদের নাম লেখা থাকবে। আল্লাহর কাছেও তোমরা এর প্রতিদান পাবে। তোমরা কিন্তু অন্যায়ের প্রতিবাদের মধ্যে আছো। ওই দিন রাতেই বসে বসে একটা লিফলেট লিখছিলাম। ওই লিফলেটটা আমি তাকে দিয়ে আসলাম। আর বললাম, তোমরা কখনো হতাশ হবা না। আমরা চারপাশ থেকে আছি। আমরা সবাই প্রতিবাদী হয়ে উঠছি। এরকম একটা মেসেজ ছিল। এরপর দেখলাম ও কেমন জানি নড়েচড়ে বসলো। ভাল করে লিফলেটটা পড়লো তখন তার ওয়াইফ পাশে ছিল।
দৈনিক সংগ্রাম : আপনার কার্যক্রম থেকে বোঝা যাচ্ছে আগে থেকেই আপনি আধিপত্যবাদের বিরোধী ছিলেন। অরোরা এবং নিউরো সাইন্স দুটো জায়গাতেই আপনি আন্দোলনের সময় বড় ভূমিকা রেখেছেন, নিউরো সাইন্সে কোনদিন থেকে মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত রোগী আসা শুরু করলো?
ডাক্তার মো. মাহফুজুর রহমান : এটার শুরু ১৭-১৮ জুলাই থেকে। বিচ্ছিন্নভাবে আগে থেকেই আসা শুরু করেছিল। কিন্তু বেশিরভাগ এসেছে ১৬ তারিখের পর থেকে। ১৮ তারিখের পর থেকে যত দিন যায় রোগী বাড়তে থাকে। সবচেয়ে ম্যাসাকার হয়েছে ৪ আগস্ট এবং ৫ আগস্ট। এর আগে আরেকটা ঘটনা আছে। আমি তখন অরোরাতে। রাত ৯টার দিকে দেখলাম যে ৮/১০ জন গুলীবিদ্ধ রোগী। হতে পারে যাত্রাবাড়ী থেকে এসেছে। ইমারজেন্সি থেকে আমাকে ফোন দিলো যে রোগীতো অনেকগুলো এসেছে স্যার। গুলীবিদ্ধ ভর্তি নেবো কি-না। আমি বললাম অবশ্যই ভর্তি নিবা। আমি রোগী ওটিতে নিয়ে গেলাম। ম্যাসাকার অবস্থা। ৪টা ওটিতে শুইয়ে রাখছি। আমরা ডাক্তারতো মাত্র দুইজন। দেখলাম কারো পায়ে এমনভাবে গুলী করেছে, মাদরাসার ছেলে, পা’টা ঝুলছে। একেবারে ছুটে যায়নি। কারো মাথায় গুলি, কারো বুকে গুলী। আমি বুক থেকে গুলী বের করছিলাম। মারাত্মকভাবে রক্ত ঝরছে। ব্যান্ডেজ দিয়ে কোনভাবে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছিলাম। কোনভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছিল না। ৪টা ওটিতে রোগী। আমরা দুজন ডাক্তার। যাহোক কোনভাবে ম্যানেজ করলাম। সেদিন কোনভাবে ম্যানেজ হলো। কিন্তু সমস্যা ছিল অন্য জায়গায়। পরদিন ইমারজেন্সি থেকে ফোন করলো, স্যার ডিবি টিম এসেছে।
দৈনিক সংগ্রাম : পরের দিন?
ডাক্তার মো. মাহফুজুর রহমান : জি¦ পরের দিন। আমি ভাবলাম কি করা যায়। চট করে মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। আমি বললাম রোগীর নামগুলো পরিবর্তন করে ফেলেন। আর লেখে দেন যে রোড অ্যাক্সিডেন্ট। এভাবে ফাইলগুলো সাজিয়ে ফেলেন। সাথে সাথে ডায়ানোগসিস পরিবর্তন করে লেখো যে রোড এক্সিডেনেন্ট পা ভেঙেছে। ডিবি এসে ফাইল উল্টিয়ে দেখে রোড এক্সিডেন্ট। তারা আমাকে বললো স্যাার বুঝলাম না। আমরা তো জেনে এলাম গুলীবিদ্ধ হয়ে ভর্তি। আমি বললাম আপনার অসুবিধা হলে আমরা ডাক্তার হিসেবে চিকিৎসা দেবো না? তারা বলে উপর থেকে নির্দেশনা আছে। তাদের ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়ে দেন, স্যার। আমি বললাম, ওখানেও তাদের ঢুকতে দিচ্ছে না স্বাচিবের ছেলেরা। প্রাইভেটেও দিচ্ছে না। তাহলে কি রাস্তায় মরবে না-কি? তখন তারা বুঝলো। আর বললো উপর থেকে কড়া নির্দেশনা। আমাদের চাকরি থাকবে না। আর আমাদের হাতপা বাঁধা। দয়া করে সিন ক্রিয়েট করবেন না। করলে আপনাদের হসপিটালের লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। সেদিনের মতো বুঝিয়ে পাঠিয়ে দেই। কিন্তু শেষের দিকে যত আহত হয়ে এসেছে সব টার্গেট করা গুলী। মাথায় চোখে।
দৈনিক সংগ্রাম : নিউরো সাইন্সে কিভাবে ম্যানেজ করতেন?
ডাক্তার মো. মাহফুজুর রহমান : ম্যাসাকারটা হয়েছে অনেক। আমরা নিউরোসাইন্সে ম্যাসাকার পেয়েছি ৪ আগস্ট ৫ আগস্ট। ৪ তারিখে আমরা রোগী নিতে পারছিলাম না। যেহেতু আমাদের সিট লিমিটেড ছিল। ড. দীন মুহাম্মদ অনেক সহযোগিতা করেছেন। আমি স্যারকে বললাম। আমি এক্ষেত্রে অগ্রণি ভূমিকায় ছিলাম। স্যার কে বললাম কোনভাবেই পেসেন্ট ব্যাক করা যাবে না। তিনি বললেন মাহফুজ ঠিক আছে। যত মেট্রেস ছিল, দুইশ’ তিনশ’ মেট্রেস স্টোরে যা আছে নামাও। যতখানে ফাকা জায়গা আছে বারান্দায় হউক কেবিনের পাশে হউক। সিড়িতে হউক। রোগী আমরা ছাড়বো না। ১০টা অপারেশন থিয়েটার। কোনভাবেই কাজ শেষ করা যাচ্ছে না। রক্তে রক্তাক্ত। ৪ আর ৫ আগস্ট যে গেছে দেখলে মনে হবে যুদ্ধের পরিস্থিতিও হার মানাবে। আমি বললাম, কোন রোগী ফেরত যাবে না কারণ সোহরাওয়ার্দিতে পঙ্গুতে তারা ভর্তি হতে পারছিল না। তবে আমাদের এখানে সবাই চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তরিক ছিল।
দৈনিক সংগ্রাম : বিভিন্ন হাসপাতালে সমস্যা ছিল। আপনার এখানে কোন সমস্যা ছিল কি-না?
ডাক্তার মো. মাহফুজুর রহমান : আসলে আমরা কারো কথা শুনিনি। আমরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠেছিলাম। যদিও স্বাচিবের লোকজন বাঁকা চোখে তাকাচ্ছিল। তবে বাধা দেয়ার সাহস ছিল না। ৪ তারিখ কোনভাবে আমরা মেনেজ করেছিলাম সারাদিন সারারাত পরিশ্রম করে। ৫ তারিখ ছিল আরেকটা বিভৎস অবস্থা। সেদিন দেখি পুলিশ এমনভাবে গুলী করেছে যে মগজ পর্যন্ত উড়ে গেছে। এম্বুলেন্সে করে রোগী আসছে আর মগজ টপ টপ করে পরছে। বাবা সন্তানের মগজ হাতে করে নিয়ে এসে বলছে স্যার মগজটা লাগিয়ে দেওয়া যাবে কি-না। সত্যিটা হলো বাবাতো বলবেই। আমরাতো দেখছি যখন গুলী করা হয়েছে তখনই মারা গেছে। আমরা শান্তনা দেয়ার জন্য রোগীটাকে বেডে নিয়ে স্যালাইন দিলাম। কোন রকম করে একটু অক্সিজেন দিলাম। এটা ছিল সান্ত্বনা। সান্ত্বনা দেয়া ছাড়া আমাদের কিছুই করার ছিল না। ওই দিন শহীদ হয়েছে ৩২ জন।
দৈনিক সংগ্রাম : কখন জানতে পারলেন স্বৈরাচার পালিয়েছে?
ডাক্তার মো. মাহফুজুর রহমান : আমরা যখন যোহরের নামায পড়তে যাই। নামাযের সালাম ফেরানোর পর জানতে পারি সেনাবাহিনীর প্রধান ভাষণ দিবে। তখন বুঝতে পারি ফ্যাসিবাদ পালিয়ে গেছে। তখনই নামায আদায় করলাম। শুকরিয়া আদায় করলাম। এটা আল্লাহর দ্বারাই সম্ভব। যেভাবেই হউক। নয়তো যেভাবে সাজিয়েছে হাসিনা। আমাকে সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা বলতেছিল মাহফুজ ভাই, আপনি বলছেন যে শেখ হাসিনা চলে যাবে। এটা অসম্ভব। আমি বলতাম বলিস কি? আজরাইল আসলে না! বলে নিরাপত্তাটা ৫ স্তরে সাজানো হয়েছে। এটা পারবে না। আমি বলতাম, আল্লাহ যখন চাইবেন তখন যাবেই।