আলী আহমাদ মাবরুর

আমার সম্মানিত পিতা শহীদ আলী আহসান মো: মুজাহিদের শাহাদাতের ১০ বছর পার হয়ে গেল। অথচ মনে হয়, এই তো সেদিন আমার পিতার জীবন্ত শরীর, তার উষ্ণ হাতের স্পর্শ পেলাম। আবার স্পর্শ পাওয়ার চার- সাড়ে চার ঘন্টার ব্যবধানে তার লাশ রিসিভ করলাম। হৃদয়বিদারক এই ঘটনাগুলোর পর মাঝখানে ১০টি বছর চলে গেছে। এই কয়েক বছরে আব্বার অনুপস্থিতি আরো বেশি করে অনুভব করেছি। তার শূন্যস্থান আরো বেশি উপলব্ধি করেছি। জাতীয় রাজনীতি ও সাংগঠনিক পরিসরেও তার অভাব অনুধাবন করেছি। আমার কাছে মনে হয়, এক দশক চলে গেলেও আমাদের কাছে, পরিবারের কাছে তিনি এখনো আগের মতোই অভিভাবকের অবস্থানেই রয়েছেন।

আব্বা জীবিত থাকাকালীন অনেক আত্মীয়স্বজন ছিলেন, যারা এখন আর জীবিত নেই। আমার নানু ইন্তেকাল করলেন এক বছরের বেশি হয়ে গেল। এই নানু নিজেও শেষ সাক্ষাতে কারাগারে গিয়ে আব্বার সাথে দেখা করেছিলেন। আরো অনেকেই ছিলেন যারা আব্বার সহচর ছিলেন। তারা আজ আর নেই। কিংবা পরিবারের কথা যদি বলি; আমাদের বাসার জুনিয়র সদস্যরা সব বড়ো হয়ে গেলো দাদাজানের আদর সোহাগ ছাড়াই। আমার ছোট ছেলে, আমার বড় ভাইয়ের ছোট ছেলেকে আব্বা দেখার সুযোগই পাননি।

আমার বড় ছেলেকে আব্বা তিন মাসের দেখে গিয়েছিলেন। তার বয়স এখন ১১ বছর হতে যাচ্ছে। আব্বার বড়ো নাতি আল্লাহর রহমতে এসএসসি, এইচএসসি পাস করলো, আব্বা কিছুই দেখতে পারলেন না। মানুষ একটি বয়সে গিয়ে শিশু হয়ে যায়। সন্তানের চেয়ে নাতি-নাতনি নিয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করে। আমার বাবা জীবনের বৃদ্ধ বয়স উদযাপনেরও তেমন কোনো সুযোগ পেলেন না। এক বুক অতৃপ্তি নিয়ে তিনি চলে গেলেন। আমার মায়ের বয়স দিনে দিনে বাড়ছে, অসুস্থতার মাত্রাও বাড়ছে। আব্বা খুব যতœশীল একজন মানুষ ছিলেন। তিনি থাকলে তার জীবনসঙ্গীনির পাশে এই সময়গুলোতে থাকতে পারতেন। কিন্তু কোনোকিছুই স্বাভাবিকভাবে হলো না।

আবার নিজের কথাও যদি বলি। আমি আমার জীবনের উত্থান পতনের এই সময়ে তার সাহচর্য, দিক নির্দেশনার প্রয়োজন প্রতিমুহূর্তে অনুভব করি। কিন্তু মাথার ওপর সেই ছায়াটুকু পাই না। বই লিখছি, কাজ করছি, নানা জায়গায় যাচ্ছি। বিশেষ করে, যখন থেকে বাবার ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছি, তখন থেকে আব্বার কষ্টগুলো যেন আরো বেশি করে অনুভব করছি। আব্বার সন্তানদের, অর্থাৎ আমাদের ভাই-বোনদের একটি অবস্থান তৈরি হলো। কিন্তু আব্বা এগুলো কিছুই দেখতে পারলেন না।

আমার পিতাকে আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে হত্যা করেছে। বিচারের নামে প্রহসন করেছে। আমার বাবা বিচারিক হত্যাকা-ের শিকার। আব্বার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে আওয়ামী লোকজন। প্রলোভন দেখিয়ে সাক্ষী জোগাড় করা হয়েছে। প্রসিকিউশন, ইনভেস্টিগেশন টিম এমনকী বিচারকেরা পর্যন্ত যোগসাজশে এই চক্রান্তে অংশ নিয়েছে- যার তথ্য এখন নিয়মিতভাবে প্রকাশ্যে আসছে। আব্বার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো প্রমাণিত হয়নি। বিচার চলাকালে যেসব নামে, উপাধিতে তাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভূষিত করা হয়েছে এর কোনোটার পক্ষে দলিল হাজির করা হয়নি। আদালতে আমাদের যুক্তিগুলোকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। এমনকি চূড়ান্ত রায়েও ডিফেন্সের যুক্তিগুলোর জবাব দেয়া হয়নি। তাই এই মামলার প্রক্রিয়ায় যে অনিয়মগুলো রয়ে গেছে সেগুলোর সুরাহা হওয়া উচিত বলে মনে করি। অন্তর্বর্তী সরকার ফ্যাসিবাদী আমলের অনেক অনিয়ম, অন্যায় ও অপরাধের সুরাহা করছেন। আশা করছি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে বিচারের নামে প্রহসন করে যে মানুষগুলোর প্রতি, যে পরিবারগুলোর প্রতি অন্যায় করা হয়েছে- সে ব্যাপারেও তারা ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি জামায়াতের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল, মজলুম জননেতা এটিএম আজহারুল ইসলামকে বেকসুর খালাস দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ যে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন তা আমাদেরকে ন্যায়বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে নতুন করে আশাবাদী করেছে। আজহার সাহেবের মামলায় আপীল বিভাগের বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ খুবই ইতিবাচক। কিন্তু এই মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় না প্রকাশিত হওয়ায় আমরা বিষয়গুলো নিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছি না। আজহার সাহেবের মামলায় বিস্তারিত রায় এলে আমরা এর কতটুকু সুবিধা নিতে পারবো তাও জানি না। তবে আশা করছি, এই রায়টি পুরোনো মামলাগুলোর সাথে হওয়া অবিচারগুলো মিমাংসা করার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসের গণঅভ্যুত্থান এবং ৫ আগস্টে ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর দেশে পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। ইসলামী সংগঠন ও ইসলামী আন্দোলনের পক্ষে সবচেয়ে বেশি অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা যেখানেই যাচ্ছেন, তারা মানুষের আকুন্ঠ ভালোবাসা ও সমর্থন পাচ্ছেন। এই দৃশ্যপট দেখে আমার এখন শহীদ পিতার পার্থিব জীবনের শেষ সময়ের ঐ কথাটিই বারবার মনে পড়ে যে, “আমার রক্তের প্রতিটি ফোঁটা এদেশে ইসলামী আন্দোলনকে আরো সুদৃঢ় করবে, বিজয়ী হওয়ার পথে এগিয়ে নেবে, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে।

আমার পিতা ইসলামের জন্য জীবন দিয়েছেন, অন্যায়ভাবে জালিমেরা তাকে হত্যা করেছে। আমার বিশ্বাস, আল্লাহ নিশ্চয়ই তাকে শহীদ হিসেবে কবুল করবেন। আর শহীদের কত সম্মান, কত মর্যাদা। তারপরও আমি মানুষ, আমি শহীদ আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের সন্তান। এটুকু আফসোস মনের ভেতর চলেই আসে, আহ! আমার বাবা যদি ইসলামের পক্ষে এই জোয়ার দেখতে পেতেন। আমার দাদাজান আমার বাবাকে ইসলামী আন্দোলনের জন্য ওয়াকফ করে গিয়েছিলেন। আমার বাবা সারাজীবন এই দেশে ইসলাম কায়েমের জন্যই কাজ করেছেন। আজকে তার এবং তার প্রজন্মের দায়িত্বশীলেরাসহ অসংখ্য নেতা-কর্মীর কুরবানির বিনিময়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে- এর সুফল তারা দেখে যেতে পারলেন না।

আল্লাহ তা’আলা আমাদের বাবাকে শহীদ হিসেবে কবুল করুন। ইসলামী আন্দোলনে তার অবদানগুলো কবুল করুন। আমাদেরকে দ্বীনের পথে কবুল করুন। শহীদ পরিবার হিসেবে প্রাপ্ত মর্যাদাকে ধারণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।