*প্রথমবারের মতো এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭৮৭ বিমানটি আছড়ে পড়ে বিজে মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসে

* বিমান দুর্ঘটনায় অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলেন এক যাত্রী

* বিমানটিতে ছিলেন গুজরাটের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী

* উড্ডয়নের সঙ্গে সঙ্গে সম্ভবত কয়েকটি পাখি আঘাত হেনেছিল- বিমান চলাচল বিষয়ক বিশেষজ্ঞ

ভারতের গুজরাটের আহমেদাবাদে মেঘানি নগর এলাকায় ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় বিমানে থাকা ২৪১ আরোহী নিহত হয়েছেন। তবে পুলিশ জানিয়েছে, এই দুর্ঘটনায় বিশওয়াস কুমার রামেশ নামে একজন যাত্রী অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছেন। এনডিটিভির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই যাত্রী ছিলেন বিমানের ১১-এ নম্বর সিটে। ভিডিওতে দেখা গেছে, তিনি হেঁটে চলেছেন সাদা টি-শার্ট এবং গাঢ় রঙের প্যান্ট পরে আছেন, শরীরেও তেমন কোনো দাহচিহ্ন নেই!। ৮২৫ ফুট উচ্চতায় পৌঁছানোর পরই আকস্মিক আছড়ে পড়ে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটি। সংবাদমাধ্যম নিউজ-১৮, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে এ তথ্য জানিয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১টা ৩৯ মিনিটে ভারতের সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল বিমানবন্দর থেকে যুক্তরাজ্যের লন্ডন গ্যাটউইক বিমানবন্দরের উদ্দেশে বিমানটি রওনা দেয়। উড্ডয়নের কয়েক মিনিট পরই এটি বিধ্বস্ত হয়। বিধ্বস্ত সেই বিমানে ছিলেন গুজরাটের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রুপানি। এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজে মোট ২৪২ জন আরোহী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে দুজন পাইলট ও ১০ জন কেবিন ক্রু। বিমানটির ২৩০ জন সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে ১৬৯ জন ভারতীয়, ৫৩ জন ব্রিটিশ নাগরিক, একজন কানাডীয় নাগরিক এবং ৭ জন পর্তুগালের নাগরিক ছিলেন। এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর ঘটনাস্থল থেকে ২০৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, ওই হোস্টেলে প্রায় ৫০ জন ইন্টার্ন থাকতেন। দুর্ঘটনার সময়ে যারা সেখানে ছিলেন, সকলেরই মৃত্যুর আশঙ্কা করা হচ্ছে। উদ্ধারকর্মীদের বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে, আরও অনেকে ওই ভবনে আটকা পড়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত কত জনের মৃত্যু হয়েছে, সরকারিভাবে তা প্রকাশ করেনি প্রশাসন। এদিকে বিধ্বস্ত হওয়া এয়ার ইন্ডিয়ার এই ফ্লাইটের যাত্রী ও তাঁদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা ও শোক প্রকাশ করেছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস। খবর বিবিসি, নিউজ-১৮, এনডিটিভি, বার্তাসংস্থা এপি, রয়টার্স, এএফপি, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।

লন্ডনের গ্যাটউইক বিমানবন্দর এক বিবৃতিতে বলেছে, (আজ) বৃহস্পতিবার আহমেদাবাদ বিমানবন্দর থেকে যাত্রা করা এয়ার ইন্ডিয়ার এআই১৭১ ফ্লাইটটি গ্যাটউইকে স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ২৫ মিনিটে অবতরণ করার কথা ছিল। এছাড়াও ভারতের এ ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। এতে দেখা গেছে, বিমানবন্দরের রানওয়ে থেকে উড্ডয়নের পর অনেকটা দুলতে দুলতে বিমানটি এগিয়ে যাচ্ছে। এর কিছুক্ষণ পরই এটি বিধ্বস্ত হয়। এয়ার ইন্ডিয়ার এ বিমানটি সেখানকার একটি মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসে আঘাত হানে। বিধ্বস্ত হওয়ার পর এলাকাটি ঘন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। জরুরি সেবা সংস্থাগুলো ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে এবং দুই ডজনের বেশি অ্যাম্বুলেন্স সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে।

ফ্লাইট রাডারের তথ্য অনুযায়ী, রানওয়ে ২৩ থেকে বেলা দেড়টার কিছু সময় পর বিমানটি বিমানবন্দর ছাড়ে। এরপরই সেটি ‘মে ডে’ সঙ্কেত দেয়, এরপর আর বিমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। বিমানটি উড্ডয়নের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেটি থেকে সংকেত পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় বিমানটি ৬২৫ ফুট ওপরে উঠেছিল। ফ্লাইটটি পরিচালনাকারী বিমান পরিবহন সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়া এক বিবৃতিতে বলেছে, আহমেদাবাদ থেকে লন্ডনের গ্যাটউইক বিমানবন্দরগামী ফ্লাইট এআই১৭১ আজ ১২ জুন ২০২৫ তারিখে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। দুর্ঘটনার বিস্তারিত জানতে তদন্ত চলছে এবং যথাসময়ে আরও তথ্য জানানো হবে। আহমেদাবাদ সিটি পুলিশ কমিশনার জিএস মালিক বার্তাসংস্থা এপিকে জানান, দুর্ঘটনাস্থলের পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে বিমানটির কোনো আরোহী বেঁচে নেই। তিনি বলেন, মনে হচ্ছে বিমান বিধ্বস্তে কেউ বেঁচে নেই। এটি আছড়ে পড়েছে আবাসিক এলাকায়। এতে স্থানীয় কিছু মানুষও হয়ত মারা গেছে। সব মিলিয়ে কতজনের মৃত্যু হয়েছে সেটি নিরূপণ করা হচ্ছে।

বিমান চলাচল বিষয়ক এক বিশেষজ্ঞ সংবাদমাধ্যম এনডিটিভিকে জানিয়েছেন, বিমানটি উড্ডয়ন করার সঙ্গে সঙ্গে সম্ভবত এটিতে কয়েকটি পাখি আঘাত হেনেছিল। এতে করে পূর্ণ উড্ডয়নের জন্য যে পরিমাণ শক্তির প্রয়োজন ছিল বিমানটি সেটি হারিয়ে ফেলেছিল। ফলে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও বিমানটি আর উপরের দিতে নিতে পারেননি পাইলট। সাবেক ক্যাপ্টেন সৌরভ ভাটনাগর নামের এ বিশেষজ্ঞ বলেছেন, প্রথমত মনে হচ্ছে, একাধিক পাখির ধাক্কায় দুটি ইঞ্জিনই বিকল হয়ে যায়। উড্ডয়নটি নিখুঁত ছিল। কিন্তু ল্যান্ডিং গিয়ারটি উপরে তোলার আগেই বিমানটি নিচে নামা শুরু করে। এমনটি সাধারণত হয় যখন ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায় অথবা বিমান আকাশে থাকার সামর্থ হারিয়ে ফেলে। তদন্তে আসল কারণ বেরিয়ে আসবে। তিনি আরও বলেন, ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে উড্ডয়নটি বেশ সুন্দরভাবে হয়েছিল। এছাড়া বিমানটিও নিয়ন্ত্রিতভাবে নিচে নেমে আসে। পাইলট মে ডে কল করেছিলেন। যার অর্থ ওই সময় জরুরি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।

ভারতের বেসামরিক বিমান চলাচল বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিমান দুর্ঘটনা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানিয়েছে। দেশটির বিমান পরিবহনমন্ত্রী রাম মোহন নাইডু এক বিবৃতিতে বলেছেন, আহমেদাবাদে বিমান বিধ্বস্তের খবর শুনে আমি মর্মাহত ও শোকাহত। আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছি। আমি নিজে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি এবং সব বিমান ও জরুরি সেবা সংস্থাগুলোকে দ্রুত ও সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছি। উদ্ধারকারী দল ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে। এছাড়া চিকিৎসা সহায়তা ও ত্রাণ তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে।

ভারতের ইতিহাসে এয়ার ইন্ডিয়ার যত প্রাণঘাতী বিমান দুর্ঘটনা: ভারতের সরকারি পতাকাবাহী উড়োজাহাজ সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়া গত ১৫ বছরে একাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংস্থাটি তাদের নিরাপত্তা রেকর্ড উন্নত করার চেষ্টা করেছে বলে জানানো হয়েছে। বৃহস্পতিবারের আগে এয়ার ইন্ডিয়ার সবশেষ বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছিল ২০২০ সালে। সেসময় তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের একটি ফ্লাইট কেরালার কোঝিকোড় বিমানবন্দরে বৃষ্টিভেজা রানওয়েতে অবতরণের সময় ছিটকে গিয়ে দুই ভাগ হয়ে যায়। এতে অন্তত ১৭ জনের মৃত্যু হয়। ঘটনার সময় আবহাওয়া ছিল অত্যন্ত খারাপ এবং দৃষ্টিসীমাও ছিল কম। এর এক দশক আগে ২০১০ সালে আরও ভয়াবহ এক দুর্ঘটনায় পড়েছিল এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের একটি প্লেন। সেটি কর্ণাটকের ম্যাঙ্গালুরু শহরের বিমানবন্দরে অবতরণের সময় রানওয়ে ছাড়িয়ে একটি ঢালে পড়ে আগুন ধরে যায়। ওই ঘটনায় ১৫০ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারান।

ভারতেই প্রথমবারের মতো বিধ্বস্ত হলো বোয়িং ৭৮৭: ভারতের গুজরাটের আগে আর কখনোই বোয়িং ৭৮৭ প্লেন এভাবে ভেঙে পড়েনি। প্রায় ১৪ বছর আগে এই মডেলটি বাজারে এনেছিল মার্কিন সংস্থা বোয়িং। ছয় সপ্তাহ আগে ড্রিমলাইনার মডেলের প্লেনে ১০০ কোটি যাত্রী বহন করার মাইলফলক অর্জন করে তারা। সেই উপলক্ষে বোয়িং জানিয়েছিল, তাদের তৈরি ১ হাজার ১৭৫টি বোয়িং ৭৮৭ প্লেন ৫০ লাখ উড়ান অপারেট করেছে, সেগুলো আকাশে উড়েছে তিন কোটি ঘণ্টা। এই ঘটনাটি বোয়িংকে এত বড় ধাক্কা দিলো এমন একটা সময়ে, যখন সংস্থাটি ৭৩৭ প্লেন একের পর এক ভেঙে পড়াসহ নানান সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।

দুপুরে খাবার খাচ্ছিলেন শিক্ষার্থীরা, হঠাৎ আছড়ে পড়ে প্লেন: ভারতের গুজরাটে ছাত্রাবাসের ওপর প্লেন বিধ্বস্তের ঘটনায় অন্তত পাঁচ মেডিকেল শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে চারজন স্নাতক পর্যায়ের ছাত্র এবং একজন পিজিটি (পোস্টগ্র্যাজুয়েট রেসিডেন্ট)। গতকাল বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় দুপুর ১টা ৩৮ মিনিটে আহমেদাবাদের সরদার বল্লভভাই প্যাটেল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ২৪২ জন আরোহী নিয়ে উড্ডয়ন করে এয়ার ইন্ডিয়ার বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার (ফ্লাইট এআই১৭১)। কিন্তু ওড়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেটি মেঘানীনগরের একটি আবাসিক এলাকায় বিজে মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের ওপর ভেঙে পড়ে। দুর্ঘটনার সময় মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন। ঘটনাস্থলের ছবি থেকে দেখা গেছে, ছাত্রাবাসের ক্যান্টিনের টেবিলে পড়ে আছে খাবারের থালা, গ্লাস, আর ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীর ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন উদ্বিগ্ন মানুষজন। প্লেনের একটি অংশ সরাসরি ঢুকে পড়েছে ছাত্রাবাসে।