জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ৮ হাজার ১৪৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ব্যয় সম্বলিত ১২টি প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। গতকাল রোববার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় এসব প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। তবে অনুমোদন পায়নি আলোচিত ‘জুলাই শহীদদের আবাসন প্রকল্প’। প্রধান উপদেষ্টা এবং একনেকের চেয়ারপারসন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় একনেক সভা।
সভায় অনুমোদিত সরকারি অর্থায়ন ৮ হাজার ৫৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকা, প্রকল্প ঋণ ১৪৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন ৫২ কোটি ৭২ লাখ টাকা। ১২টি প্রকল্পের মধ্যে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ২০টি ফায়ার স্টেশন পুনর্র্নিমাণ করা হবে। এ প্রকল্পে মোট ব্যয় ৬৫০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। জুলাই ২০২৫ থেকে জুন ২০২৮ মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানানো হয়।
২ হাজার ৮৪০ কোটি টাকার প্রকল্প পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিকতর উন্নয়ন’ প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাবির অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে।
একনেক জানায়, ৪১টি বহুতল ভবন নির্মাণ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়িত হবে। প্রকল্পে প্রস্তাবিত ৪১টি বহুতল ভবনের মধ্যে রয়েছে শিক্ষার্থীদের জন্য ১৬টি আবাসিক হল, ৮টি একাডেমিক ভবন, আবাসিক হলগুলোতে হাউস টিউটরদের জন্য ৯টি আবাসিক ভবন, পুরোনো ডাকসু ভবন ভেঙে ১২তলা বিশিষ্ট মাল্টিপারপাস ভবন, ৬তলা মেডিকেল সেন্টার, রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের একাংশ ভেঙে একটি ২০তলা ও একটি ৪তলা প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ এবং গ্যালারি ও ডরমিটরি নির্মাণসহ কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের উন্নয়ন।
৮টি একাডেমিক ভবন : প্রকল্পে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভবন সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পশ্চিম ও উত্তর পাশে অবস্থিত ভবন ভেঙে একটি ১২তলা ও একটি ৬তলা ভবন নির্মাণ করা হবে। আইএসআরটি ও ফার্মেসি বিভাগের জন্য বর্তমান আইএসআরটি ভবন ভেঙে এবং মোকাররম হোসেন খন্দকার বিজ্ঞান ভবন ও আইএসআরটি ভবনের মধ্যবর্তী খালি জায়গায় একটি ১০তলা ভবন নির্মাণ করা হবে। উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের নিজস্ব খালি জায়গায় একটি ৩তলা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। চারুকলা অনুষদের অধীন ক্রাফট, স্কাল্পচার, গ্রাফিকস, সিরামিকস, ইতিহাস ভবন ও থিওরেটিক্যাল শিক্ষক লাউঞ্জ ভেঙে সেখানে একটি ৫তলা একাডেমিক ভবন নির্মাণ করা হবে। বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের বর্তমান ১তলা ভবন ভেঙে সেখানে একটি ১০তলা ‘বীর উত্তম শহীদ খাজা নিজামুদ্দিন ভূঁঞা এমবিএ টাওয়ার’ নির্মিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান প্রেস বিল্ডিং ও টিনশেডের নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ি ভেঙে যথাক্রমে ১১তলা ও ৫তলা বিশিষ্ট দুটি ব্লকে প্রেস কাম একাডেমিক ভবন নির্মাণ করা হবে।
ছাত্রদের ১০টি আবাসিক ভবন : ছাত্রদের আবাসিক সংকট দূর করার লক্ষ্যে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের টিনশেড ভবন ভেঙে সেখানে ১ হাজার ৩০০ শিক্ষার্থীর জন্য ১২তলা ও ৮তলা দুটি সম্প্রসারণ ভবন নির্মাণ করা হবে। মাস্টার দা সূর্যসেন হলের উত্তর অংশ ভেঙে তাতে ১১০০ শিক্ষার্থীর জন্য ১১তলা একটি সম্প্রসারণ ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হল প্রাঙ্গণের শহীদ আতাউর রহমান খান খাদিম ভবন ও ক্যাফেটেরিয়া ভেঙে সেখানে ১ হাজার ২০০ শিক্ষার্থীর জন্য ১৫তলা ও ৬তলা দুটি সম্প্রসারণ ভবন নির্মাণ করা হবে। হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের টিনশেড ও একতলা মূল ভবন ভেঙে সেখানে ১ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ১২তলা ও ৬তলা দুটি সম্প্রসারণ ভবন নির্মিত হবে। ড. কুদরাত-ই-খুদা হোস্টেলের বর্তমান বাংলো ভেঙে সেখানে ৫০০ শিক্ষার্থীর জন্য ১০তলা, ৮তলা ও ৫তলা তিনটি সম্প্রসারণ ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি হলেই আবাসিক শিক্ষকদের জন্য ২০টি ফ্ল্যাটসহ ১১তলা একটি করে শিক্ষক কোয়ার্টার নির্মাণ করা হবে।
ছাত্রীদের ৬টি আবাসিক হল ভবন : ছাত্রীদেরও আবাসিক সংকট দূর করার লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে উদ্যোগ। শাহনেওয়াজ হোস্টেল ভেঙে আনুষঙ্গিক সুবিধাসহ ১ হাজার ছাত্রীর জন্য একটি ১৫তলা ছাত্রী হল নির্মাণ করা হবে। শামসুন নাহার হলের ভেতরে বিদ্যমান হাউস টিউটর কোয়ার্টার ও গ্যারেজ ভেঙে ৬০০ ছাত্রীর জন্য ১০তলা ও ৬তলা দুটি সম্প্রসারণ ভবন নির্মাণ করা হবে। লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের বিদ্যমান স্টাফ কোয়ার্টার ‘বি’ ও ‘ডি’ ভবন ভেঙে সেখানে ৫০০ ছাত্রীর জন্য ১১তলা ও ৮তলা দুটি ছাত্রী হল নির্মাণ করা হবে। বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের ভেতরে প্রভোস্ট বাংলো, হাউস টিউটর কোয়ার্টার ও ৩তলা সিকদার মনোয়ারা ভবন ভেঙে ৫০০ ছাত্রীর জন্য ১০তলা সম্প্রসারণ ভবন নির্মাণ করা হবে। প্রতিটি হলে আবাসিক শিক্ষকদের জন্য একটি করে ২০টি ফ্ল্যাটসহ ১১তলা শিক্ষক কোয়ার্টারও নির্মাণ করা হবে।
শিক্ষকদের আবাসিক ভবন : শিক্ষকদের জন্যও আলাদাভাবে এ প্রকল্পে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। মাস্টার দা সূর্যসেন হল এবং হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের বর্তমান প্রভোস্ট বাংলো ভেঙে সেখানে একটি ২তলা বিশিষ্ট উপ-উপাচার্যের বাংলো নির্মাণ করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ ফুলার রোড আবাসিক এলাকার ১২ ও ১৩ নম্বর ভবন ভেঙে সেখানে শিক্ষকদের জন্য ১৫তলা বিশিষ্ট (মোট ১১২টি ফ্ল্যাট) একটি আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হবে।
১২তলা ডাকসু ভবন : ডাকসু ভবন ভেঙে তার স্থানে ১২তলা মাল্টিপারপাস ডাকসু ভবন নির্মাণ করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের উত্তর-পশ্চিম অংশ ভেঙে সেখানে ২০তলা ভবন এবং দক্ষিণ-পূর্ব অংশ ভেঙে সেখানে ৪তলা প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ করা হবে। জিমনেসিয়ামের জন্য প্রি-ইঞ্জিনিয়ারড ভবনের অবশিষ্ট কাজ সম্পন্ন করা হবে।
বদলে যাবে খেলার মাঠের দৃশ্য : পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে আধুনিক ক্রীড়া অবকাঠামো গড়ে তোলার জন্য গ্যালারি, খেলার মাঠ, বাস পার্কিং ও পরিচালকের অফিসসহ খেলোয়াড়দের ডরমিটরি নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। মূল খেলার মাঠের আয়তন ১০ হাজার ৯০০ বর্গমিটার, গ্যালারি ২ হাজার ৪০ বর্গমিটার, বাস পার্কিং ২ হাজার ৯০০ বর্গমিটার এবং পরিচালকের অফিস ও ডরমিটরি মিলিয়ে ৪ হাজার ৩২ বর্গমিটার আয়তনের স্থাপনা নির্মাণের প্রস্তাব রয়েছে।
এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিববাড়ী আবাসিক এলাকার চতুর্থ শ্রেণির ভবনগুলো ভেঙে সেখানে ৬তলা শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা মেডিকেল সেন্টার ভবন নির্মাণ করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যমান ১তলা মসজিদুল জামিয়া ভবন ভেঙে তার স্থানে ৪তলা মসজিদুল জামিয়া কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় জলাধার সংস্কার ও সৌন্দর্যবর্ধন করা হবে। পাশাপাশি রোড নেটওয়ার্ক ও সার্ভিস লাইন স্থাপন, ২৪ হাজার ৮২০ মিটার দীর্ঘ ড্রেনেজ সিস্টেম নির্মাণ এবং আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার (ওয়েস্ট বিনসহ) ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ ও জগন্নাথ হলে বসানো হবে পাবলিক টয়লেট।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ২০টি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নির্মাণ করবে সরকার। এর মধ্যে ১২টি নতুন ও ৮টি ফায়ার স্টেশন পুনর্র্নিমাণ করা হবে। জুলাই শহীদদের আবাসন প্রকল্প বাদ যাওয়ার বিষয়ে একনেক সভা শেষে সাংবাদিক সম্মেলনে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, আমরা মনে করি প্রকল্পটির যথার্থ মূল্যায়ন হওয়া উচিত। জুলাইযোদ্ধাদের সব প্রকল্প এক জায়গায় এনে সমন্বয় করা উচিত। এটা ভালো উদ্যোগ, আরও পরিকল্পিতভাবে এগোতে চাই আমরা।
অনুমোদিত ১২টি প্রকল্প হলো- গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প, কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু হতে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ (২য় সংশোধিত ৪র্থ বার বৃদ্ধি) প্রকল্প। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুইটি প্রকল্প (১) ‘দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ২০টি (১২টি নতুন ও আটটি ফায়ার স্টেশন পুনঃনির্মাণ) ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ষ্টেশন স্থাপন’ এবং (২) ‘বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের জন্য লজিস্টিকস ও ফ্রিট মেইনটেন্যান্স ফ্যাসিলিটিস গড়ে তোলা (প্রস্তাবিত ২য় সংশোধিত)। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দুইটি প্রকল্প, (১) ‘গ্রামীণ স্যানিটেশন প্রকল্প’ এবং (২) ‘বহদ্দারহাট বাড়াইপাড়া হতে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন’ (৩য় সংশোধিত) প্রকল্প। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ ও পুনর্বাসন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প ‘মিরপুর সেনানিবাসে ডিএসসিএসসি’র অফিসার্স মেস ও বিওকিউ নির্মাণ’ (১ম সংশোধিত) প্রকল্প। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিকতর উন্নয়ন’ প্রকল্প। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প, ‘উপজেলা পর্যায়ে মহিলাদের জন্য আয়বর্ধক (আইজিএ) প্রশিক্ষণ (২য় পর্যায়)’। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প, ‘বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের জাদুঘর ভবন সম্প্রসারণ এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ’ (১ম সংশোধিত ৪র্থ বার বৃদ্ধি)। কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটি ‘কন্দাল ফসল গবেষণা জোরদারকরণ প্রকল্প। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্প ‘স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটারিং প্রজেক্ট ইন ডিস্ট্রিবিউশন জোনস অফ বিপিডিবি (১ম সংশোধিত)’ প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ; আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল; স্বরাষ্ট্র এবং কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী; শিল্প এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান; বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ, সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং রেলপথ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান; পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা একনেক সভায় অংশগ্রহণ করেন।