পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশের রাজনৈতিক দলের শীর্ষ অনেক নেতাকে বিনা অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারের পর তাদের নামে দায়ের করা হয় অসংখ্য মিথ্যা মামলা। কারো কারো বিরুদ্ধে কয়েকডজন মামলা দেয়া হয়েছে। গায়েবি মামলায় আদালতে হাজির করার পর পুলিশ আবেদন করলেই দেয়া হতো রিমান্ড। জিজ্ঞাসাবাদের নামে দিনের পর দিন রিমান্ডে নেয়া হতো। রিমান্ডে নিয়ে চালানো হতো অমানবিক নির্যাতন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনে কাউকে কাউকে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে। সুস্থ একজন মানুষকে আটকের পর রিমান্ডে নিয়ে এমনভাবে নির্যাতন চালানো হতো তিনি হেঁটে আদালতে উপস্থিত হতে পারতেন না। পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অনেক নেতাকে আদালতে আসতে দেখা গেছে। নির্যাতনে গুরুতর অসুস্থ কয়েকজনকে চ্যাংদোলা করে উপস্থিত করা হয়েছে এজলাসে। তারা আদালতে স্বপক্ষে কোনো কথা বলারও সুযোগ পেতেন না। অনেকের পক্ষে আইনজীবীও ঁদাড়াতে পারতেন না।
পাঁচ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগের কয়েক ডজন নেতাকে হত্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে। ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও হত্যা মামলায় এসব নেতাকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নেয়া হলেও কোনো ধরনের নির্যাতন চালানোর অভিযোগ নেই। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে তাদেরকে নির্যাতনের কোনো অভিযোগ নেই। এমনকি আদালতে হাজির করার পর আওয়ামী লীনের অনেকে নেতাকে দম্ভোক্তি করতে দেখা গেছে। তারা পুলিশ, আইনজীবী এবং গণমাধ্যম কর্মীদের উদ্দেশ করে উচ্চবাচ্য করার সাহস দেখাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তারা বিষোদগার করে কথা বলছে। আইনজীবীরা বলছেন-আওয়ামী লীগের নেতা, সাবেক মন্ত্রী, এমপিরা বিভিন্ন মামলার আসামী হয়ে আদালতে হাজিরা দিতে এসে নিজেদেরকে এখনো ক্ষমতাসীন দলের নেতা বলে জাহির করার চেষ্টা করছেন। একজন আইনজীবী বলেন-তারা বাড়তি সুযোগ সুবিধা পাওয়ায় এধরণের আচারণ করার সাহস দেখাচ্ছেন। তবে তারা ভুলে গেছেন যে, অতীতেও অন্য দলের নেতাদের গ্রেফতারের পর কিভাবে আদালতে হাজির করা হতো!
কাঠগড়ায় কামরুলের খোশগল্প: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকেন্দ্রিক রাজধানীর মুগদা থানার এক মামলায় সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামকে গ্রেফতার দেখানোর আদেশ দেন আদালত। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার আবেদন মঞ্জুর করে এ আদেশ দেন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মিনহাজুর রহমান। এদিন সকাল ১০টার দিকে কামরুল ইসলামকে কড়া পুলিশি প্রহরায় আদালতে উপস্থিত করা হয়। এরপর তাকেসহ অন্য হেভিওয়েট আসামীদের আদালতের কাঠগড়ায় রাখা হয়। এসময় সালমান এফ রহমানের সঙ্গে গল্প করতে দেখা যায় কামরুল ইসলামকে। একপর্যায়ে সকাল ১০টা ১৮ মিনিটের দিকে কাঠগড়ার সামনে থাকা এক পুলিশ সদস্যের কাঁধে হাত রেখে খোশগল্প শুরু করেন কামরুল ইসলাম। পরে পাশে থাকা আরেক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গেও হাসতে হাসতে আলাপ করতে দেখা যায় তাকে। কাঠগড়ায় তখন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলেন ইনু ও মেনন। মেনন তার আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। ইনুও কথা বলছিলেন তার আইনজীবীর সঙ্গে। সালমান ও আনিসুল যখন তাদের আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত থাকেন।
জ্যাকবের সঙ্গে আড্ডায় শমী কায়সার: গত বুধবার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন চলাকালীন উত্তরার আজমপুরে টঙ্গী সরকারি কলেজের অনার্স ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী জুবায়ের হাসান ইউসুফ হত্যাচেষ্টা মামলায় ই-কর্মাস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাবেক সভাপতি ও অভিনেত্রী শমী কায়সারকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করেছেন আদালত। এজলাসে আসামীর ডকে দাঁড়িয়ে সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের সঙ্গে গল্প করে সময় পার করেন শমী কায়সার। এরই মধ্যে শমী কায়সারকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করেন আদালত। পরে তাকে হাজতখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। আদালতে ওঠানো ও নামানোর সময় মাথা নিচু করে ছিলেন শমী কায়সার।
আমাকে ১০ দিন কেন ২০ দিনের রিমান্ড দিন: গত ৮ এপ্রিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আব্দুল জব্বার নামের এক শিক্ষার্থীকে হত্যাচেষ্টা মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজের ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। তাকে আদালতে উপস্থিত করে ১০ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ। এসময় শুনানিতে তুরিন আফরোজ বলেন, আমাকে ১০ দিন কেন ২০ দিনের রিমান্ড দিয়ে দিন।
কাঠগড়ায় ঈদ মোবারক জানালেন পলক: গত ২৪ মার্চ সকাল ১০টায় পলককে ঢাকার সিএমএম আদালতে হাজির করা হয় সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে। এসময় তাকে আদালতের কাঠগড়ায় রাখা হয়। এরপর এ মামলায় তাকে ৭ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। রিমান্ড শুনানি শেষে পলকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তরিকুল ইসলাম জানান, পলক ভাই সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
আগামী নির্বাচনের জন্য দোয়া: কারাজীবন থেকে মুক্তি নিয়ে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে দোয়া চেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান। কারাগারে থেকে বাইরের সন্ত্রাসীদের হাত থেকে নিরাপদ আছেন বলেও মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক এই প্রভাবশালী মন্ত্রী। গত ৫ মার্চ সকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গণহত্যার ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর বিষয়ে শুনানির জন্য আদালতে তোলার আগে এসব কথা বলেন শাজাহান খান।
জবাই তো দেবেন, একটু সময় দেন: গত মার্চ মাসে রাজধানীর লালবাগ থানায় করা হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয় ঢাকা-৭ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সোলাইমান সেলিমকে। আদালতের এজলাসে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে সোলাইমান সেলিম বলেন, ‘অনেক সাংবাদিক ভুয়া নিউজ করেন। এসব ভুয়া নিউজ করে আমাদের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে।’ এসময় কাঠগড়ার পাশে থাকা পুলিশ সদস্যরা তাকে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কথা বলতে বারণ করেন। তখন সোলাইমান সেলিম পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘জবাই তো দেবেন, একটু সময় দেন।’ গত ৫ মার্চ আদালতে আনা হলে এসব কথা বলেন তিনি।
আদালতে ক্ষেপে গেলেন কামরুল, পুলিশের সঙ্গে চেঁচামেচি: গত ৮ জানুয়ারি রাজধানীর লালবাগ থানার মো. আলী হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার শুনানিতে আদালতের এজলাসে লিফটে না তুলে সিঁড়ি দিয়ে হাঁটিয়ে নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম। ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে একপর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে চেঁচামেচি শুরু করেন তিনি। এদিন সকাল ৯টার আগেই প্রিজন ভ্যানে করে আদালতে আনা হয় কামরুল ইসলাম, সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ ৫ জনকে। এরপর তাদের ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের হাজতখানায় রাখা হয়। কিছুক্ষণ পর বিভিন্ন থানার হত্যা মামলার শুনানির জন্য তাদের এজলাসে তোলা হয়। এ সময় নিরাপত্তা দিতে সারিবেঁধে পুলিশ হাজতখানা থেকে কোর্টের সিঁড়ি পর্যন্ত ব্যারিকেড তৈরি করে। পরে কামরুল, পলক, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ ৫ জনকে মাথায় হেলমেট, হাতে হাতকড়া আর বুকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরিয়ে সরাসরি আদালতে তোলা হয়। কিন্তু আদালতের সিঁড়ি দিয়ে তোলার সময় বাঁধে বিপত্তি। আদালতের লিফটে না তুলে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ৪ তালায় তোলা হয় তাদের। এ সময় আসামীদের নিরাপত্তাদানকারী পুলিশ সদস্যদের ওপর চটে যান কামরুল ইসলাম। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আদালতের লিফট কি নষ্ট?
এ ব্যাপারে বিশিষ্ট ফৌজদারি আইনজীবী ঝয়নাল আবেদীন মেসবাহ জানান, অনেক সময় প্রসিকিউসনের দুর্বলতা এবং জিজ্ঞাসাবাদের নামে প্রহসনের কারণে এ ধরণের ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, একজন নেতা সে ইে হোক তিনি মামলার আসামী। তাকে আদালতের নিয়ম মানতে হবে। আদালতে বিচারকের অনুমতি ছাড়া কোনো ভাবেই কথা বলার সুযোগ নেই। কিন্তু পুলিশের ব্যর্থতার কারণে এসব আসামীরা আদালতে দম্ভোক্তি করার সুযোগ পাচ্ছেন। তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের নামে রিমান্ডে নিয়ে জামাই আদর করার অভিযোগ আছে কোনো কোনো তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। প্রসিকিউশন, পুলিশ এবং তদন্ত কর্মকর্তারা পেশাদার হলে এধরণের আচারণ করার সুযোগ পেতো না।