# সারা দেশে ২২,৪১৮.৯৫ কিঃ মিঃ সড়কের বেশীরভাগই চলাচলের অনুপযোগী
# সড়ক মেরামতের নামে ৫১ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে আওয়ামী লীগ
জাতীয় মহাসড়ক যেমন তেমন আঞ্চলিক ও গ্রামীণ জনপথে সড়কগুলো চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন নিদারুণ কষ্টে এসব বেহাল সড়ক দিয়ে যাতায়াত করছে মানুষ। বলা চলে বেহাল সড়কে অচল জনজীবন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সড়ক নির্মাণের নামে কোটি কোটি টাকা লোপাটের কারণে ভেঙ্গে পড়েছে সড়ক ব্যবস্থা। টাকা লুটে নিয়ে পালিয়েছে ঠিকদাররা। কিন্তু তাদের ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছে। যার ফলে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে মানুষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কর্তৃক জাতীয়, আঞ্চলিক ও জেলা সড়কসমূহসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্রিজ ও কালভার্ট উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের আওতায় প্রায় ২২,৪১৮.৯৫ কিঃ মিঃ সড়ক, ৩,৫৪৮ টি ব্রিজ, ৮৫৬ টি বেইলী ব্রিজ , ১৪,৮১৪ টি কালভার্ট রয়েছে। জাতীয় মহাসড়কের এর অধীনে ৯৬টি জাতীয় মহাসড়ক রয়েছে, যার মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৩,৮১২ কিলোমিটার।
তবে আগামী অক্টোবরের আগে সব ভাঙাচোড়া রাস্তা মেরামত করা হবে বলে জানিয়েছেন পানি সম্পদ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্রে দেখানো হয়েছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশে প্রতি কিলোমিটার চার লেনের মহাসড়ক নির্মাণে খরচ হয়েছে ৬৩ দশমিক ৫ কোটি ডলার, যা ভারতের তুলনায় ৪ দশমিক ৪ গুণ বেশি।
দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্রেও মহাসড়ক নির্মাণে বিপুল ব্যয়ের বিষয়টি উঠে এসেছে। গত ১ ডিসেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে শ্বেতপত্র হস্তান্তর করা হয়। এই শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ছিলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
শ্বেতপত্রে দেখানো হয়েছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশে প্রতি কিলোমিটার চার লেনের মহাসড়ক নির্মাণে খরচ হয়েছে ৬৩ দশমিক ৫ কোটি ডলার, যা ভারতের তুলনায় ৪ দশমিক ৪ গুণ বেশি। এ ধরনের সড়ক নির্মাণে পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের খরচ ২ দশমিক ১৫ গুণ বেশি। চীনে একই ধরনের সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে অর্ধেক খরচে। তুরস্কে এক কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে যে খরচ হয়, বাংলাদেশে হয়েছে এর প্রায় চার গুণ।
২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) অধীন ১ লাখ ৬৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে দেশি অর্থায়নের পাশাপাশি বিদেশি ঋণও রয়েছে। বেশির ভাগ অর্থই খরচ হয়েছে সড়ক ও সেতু নির্মাণে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, বিগত সরকারের আমলে সব অবকাঠামোর নির্মাণ ব্যয় ভারতসহ আশপাশের দেশের চেয়ে বেশি হয়েছে। কারণ, আগেই ঠিকাদার ঠিক করে রাখা হতো। সেই অনুযায়ী ব্যয় ও দরপত্রের শর্ত তৈরি করত। দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণেই এত ব্যয়।
গত বছরের ৯ অক্টোবর সওজের নির্মাণকাজে দুর্নীতির বিষয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এতে বলা হয়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে সওজে উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দের ২৩ থেকে ৪০ শতাংশ অর্থ লোপাট হয়েছে। টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ২৯ হাজার কোটি টাকা থেকে ৫১ হাজার কোটি টাকা।
টিআইবি বলেছে, ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে এ দুর্নীতি হয়েছে। পক্ষগুলো হলো মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী রাজনীতিক; আমলা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং ঠিকাদার।
সওজ সূত্র জানায়, ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি করার পর কাজ বৃদ্ধি ও মূল্যবৃদ্ধির অজুহাতে প্রতিটি ভাগের কাজে ১৮ থেকে ৪৬ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় বাড়ানো (ভ্যারিয়েশন) হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৪৬ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে বগুড়া অংশের সাড়ে ২২ কিলোমিটার কাজে। এটির ঠিকাদার চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ও জাপানের তানিতা (যৌথ)। প্রায় ৪২ শতাংশ ব্যয় বাড়ানো বগুড়ার আরেক অংশের কাজের ঠিকাদার কেএমসি-মনিকো (যৌথ)। বাংলাদেশের আবদুল মোনেম লিমিটেড দুটি ভাগের কাজ পেয়েছে। একটিতে সাড়ে ৪১ ও অন্যটিতে ৩৪ শতাংশ ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। একটি ভাগে যুক্তরাজ্যের হেগো লিমিটেডের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে দেশি কোম্পানি মীর আক্তার লিমিটেড। তাদের ব্যয় বেড়েছে ২২ শতাংশ।
সওজ সূত্র বলছে, এনডিইর দুটি ভাগে বেশির ভাগ কাজই যন্ত্রপাতি ক্রয় ও স্থাপনা-সংক্রান্ত। কিছু ভবন নির্মাণের কাজও রয়েছে। সড়ক ও সেতু নির্মাণকাজের সঙ্গে মিল রেখে তারাও ব্যয় বাড়িয়েছে। বিভাগীয় দরপত্রে ১৫ শতাংশের বেশি ভ্যারিয়েশন নিষেধ, কিন্তু বিদেশি অর্থায়নের প্রকল্পগুলোয় এমন নিয়ম না থাকলেও ১৫ শতাংশের সীমা মানার রীতি আছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভ্যারিয়েশনের ক্ষেত্রে কোনো রীতিই মানা হয়নি।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এ ধরনের বড় প্রকল্পে দুর্নীতি, অপব্যয় ও অযৌক্তিক ব্যয় প্রায় ৪০ শতাংশ। প্রকল্প প্রণয়নের সময়ই অতিরিক্ত ব্যয় ধরা হয়। এরপর প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নানা অঙ্গ যুক্ত করা হয়। এতে সময় বাড়ে, ব্যয়ও বেড়ে যায়।
গত বছরের বন্যায় নোয়াখালী পৌরসভার বিভিন্ন সড়ক ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে ৪১ কিলোমিটার সড়ক চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না করায় ১৯৬ কিলোমিটার সড়কজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে ছোট-বড় গর্ত। সম্প্রতি বৃষ্টিতে এসব গর্তে পানি জমায় ভোগান্তির পাশাপাশি প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। দ্রুত বেহাল সড়কগুলো সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
জানা গেছে, শহরের ল’ইয়ার্স কলোনি, কাজি কলোনি ও নোয়াখালী সরকারি মহিলা কলেজের পূর্ব পাশের সড়কে ছোট-বড় গর্তে ভরা। সামান্য বৃষ্টি হলেই গর্তে পানি জমে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে সড়ক। একই অবস্থা পৌরসভার শান্তিনগর, জেলা কারাগার সড়ক, নতুন বাসস্ট্যান্ড, মাইজদী বাজার-পুলিশ লাইন্স, হরিনারায়ণপুর, লক্ষ্মীনারায়ণপুর, হাউজিং এস্টেটের সেন্টাল সড়ক ও আল-ফারুক একাডেমি সড়কের।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন সড়ক সংস্কার কাজ না করায় সড়কের মাঝখানে এবং উভয় পাশের গর্তে বৃষ্টির পানি জমে আছে। এসব সড়কে যানবাহন চলে হেলেদুলে। কাদা পানিতে একাকার হয়ে যাওয়া সড়কগুলো দিয়ে হেঁটে চলাও মুশকিল।
সড়কের বেহাল দশার কথা স্বীকার করে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক (উপসচিব) ও নোয়াখালী পৌরসভার প্রশাসক জালাল উদ্দিন বলেন, বিভিন্ন সড়ক সংস্কারের প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকায় কাজ করা যাচ্ছে না। বরাদ্দ পেলে কাজ শুরু করা হবে।
জানা গেছে, বরগুনা জেলার উপকূলীয় উপজেলা আমতলী-তালতলী যোগাযোগের একমাত্র আঞ্চলিক সড়কটির বেহাল দশা। ৩৫ কিলোমিটার সড়কে হাজার হাজার গর্ত ও খানাখন্দের ভরপুর হয়ে আছে। এতে উপকূলীয় দুই উপজেলার অন্তত লক্ষাধিক মানুষ দুর্ভোগে পড়েছে। দ্রুত সড়ক সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
জানা গেছে, আমতলী-তালতলীর ফকিরহাট মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার উপকূলীয় আঞ্চলিক সড়ক। দুই উপজেলার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম এ সড়কটি। এ সড়ক দিয়ে লক্ষাধিক মানুষের যাতায়াত। এ ছাড়া সোনাকাটা ইকোপার্ক ও ফকিরহাট মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র যাওয়ার একমাত্র সড়ক এটি। ওই সড়কের ২৪ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে হাজার হাজার গর্ত ও খানাখন্দে ভরপুর। ওই সড়কের মানিকঝুড়ি থেকে কচুপাত্রা সেতু পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার, কড়াইবাড়িয়া বাজার থেকে হরিণবাড়িয়া সেতু পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার এবং তালতলী সেতু থেকে ফকিরহাট মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার সড়ক গর্ত ও খানাখন্দে ভরপুর। ২০-৩০ গজ দূরত্বে রয়েছে বড় বড় খানাখন্দ।
তালতলী উপজেলা এলজিইডির প্রকৌশলী মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, কড়াইবাড়িয়া বাজার থেকে হরিণবাড়িয়া পর্যন্ত সড়কের খুবই খারাপ অবস্থা। আগামী অর্থবছরের প্রথম ধাপে এ সড়ক সংস্কার করা হবে। তিনি আরও বলেন, তালতলী থেকে ফকিরহাট মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে পর্যন্ত সড়কটি ওই অর্থবছরের দ্বিতীয় ধাপে সংস্কার করব।
জানা গেছে, সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার কড়ইতলা মোড় হতে আজুগড়া জামাত মোড় পর্যন্ত আঞ্চলিক সড়কের বেহাল দশা দীর্ঘদিন। এক যুগেও সড়কটির হয়নি কোন উন্নয়ন কাজ। এতে চরম দুর্ভোগে এই সড়কটি ব্যবহারকারী প্রায় লক্ষাধিক মানুষ।
৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কের পুরোটাই ছোট-বড় গর্ত আর খানাখন্দে ভরা। বিশেষ করে সোহাগপুর গরুর হাট থেকে জামাত মোড় পর্যন্ত বাঁধের দুই পাশের মাটি সরে গিয়ে ভগ্নদশা সড়কটির।
জানা গেছে, ভোলা পৌরসভার গুরুত্বপূর্ণ ১২টি সড়ক দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় এখন বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে। বর্ষা শুরু হতেই এসব সড়কে সৃষ্টি হয়েছে চরম জনদুর্ভোগ। খানাখন্দে পরিণত হওয়া রাস্তাগুলো সামান্য বৃষ্টিতেই পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। ফলে মানুষের চলাচল ও পণ্য পরিবহনে দেখা দিয়েছে মারাত্মক সমস্যা।
জানা গেছে, জেলা শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থান আদালতপাড়া, ডিসি ও এসপি অফিস, মুসলিমপাড়া, ওয়েস্টার্নপাড়া ও পৌরসভার সামনের সড়কগুলো চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। খানাখন্দে জমে থাকা দুই থেকে তিন ফুট পানিতে রিকশা, ইজিবাইক চলাচল তো দূরের কথা, পায়ে হেঁটে চলাও কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে।
পৌরসভার দেয়া তথ্যমতে, পৌর এলাকার ২০ কিলোমিটার রাস্তা বর্তমানে পুরোপুরি চলাচলের অনুপযোগী। আরও ৪৫ কিলোমিটার রাস্তা সংস্কারের অভাবে খানাখন্দে ভরা। পৌরসভার মোট ২৬১ কিলোমিটার রাস্তায় ১৭০ কিলোমিটার পাকা, ১৬ কিলোমিটার সেমিপাকা এবং ৭৬ কিলোমিটার হেরিংবোন সড়ক রয়েছে।
বর্তমান পৌর প্রশাসক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘সাবেক মেয়র পৌরসভা প্রায় তহবিলশূন্য করে গেছেন। ১২টি রাস্তায় জরুরি সংস্কারের জন্য ২০ কোটি টাকার প্রয়োজন। তবে আশা করছি, এ মাসের মধ্যেই সরকারি বরাদ্দ পাব। বরাদ্দ পেলেই সংস্কার কাজ শুরু করব। তিনি আরও আশ্বাস দেন, ‘বর্ষা তীব্র হওয়ার আগেই রাস্তাগুলো চলাচলের উপযোগী করে তোলা হবে ।