টিআরএনবি আয়োজিত এক সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশীয় উদ্যোক্তাদের স্বার্থরক্ষার মাধ্যমে প্রযুক্তির স্বনির্ভরতা অর্জনে টেলিযোগাযোগ খাতের প্রস্তাবিত নীতিমালা পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, টেলিযোগাযোগ অধ্যাদেশের আলোকে তৈরি চারটি নীতিমালায় বিদেশি বিনিয়োগ ও টেলিকম অপারেটরদের স্বার্থ সুরক্ষা করা হয়েছে। একমাত্র তাদেরই ক্রসকাটিং লাইসেন্সিং সুবিধা দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে দেশীয় টেলিকম উদ্যোক্তাদের পথে বসতে হবে।
গতকাল শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে টেলিকম অ্যান্ড টেকনোলজি রিপোর্টার্স নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের (টিআরএনবি) আয়োজিত মতবিনিময়সভায় এ আহ্বান জানান তারা। সভায় ‘দেশীয় উদ্যোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে কতটা ভূমিকা রাখবে টেলিযোগাযোগ খাতের নতুন নীতি’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উত্থাপন করেন টিআরএনবি’র সাবেক সভাপতি রাশেদ মেহেদী। স্বাগত বক্তৃতা করেন টিআরএনবি সাধারণ সম্পাদক মাসুদুজ্জামান রবিন। সভায় বক্তারা বলেন, দেশের টেলিকম খাত শুরু থেকেই মোবাইল অপারেটরদের হাতে জিম্মি।
২০০৮ সালে আইডিএলটিএস পলিসি এই খাতের একাধিপত্য ভাঙতে সক্ষম হয়। কিন্তু নতুন নীতিমালায় ফের বিদেশি কম্পানির কাছে জিম্মি হওয়ায় শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কেননা, আইএসপির লাইসেন্স ফি ৫ গুণ বেড়েছে। বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের ওপর ৯০ শতাংশ সুবিধাভোগ করবে বিদেশি অপারেটর। দেশীয় উদ্যোক্তা ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়বে ৭৫ শতাংশ। এছাড়াও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ লাইসেন্সের ক্ষেত্রে ৫জন মন্ত্রীর অধীনে এনে বিটিআরসিকে ‘রাবার স্ট্যাম্প’ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হচ্ছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাসুদ কামাল বলেন, বিশেষ লক্ষ্য নিয়ে বর্তমান সরকার কাজ করছে। যে কারণে টেলিযোগাযোগ খাতে দেশি বিনিয়োগ সুরক্ষা না করে বিদেশিদের স্বার্থ সুরক্ষা করা হচ্ছে।
তাই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে কোনো প্রত্যাশা নেই। উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে নির্বাচিত সরকার দিকেই আমাদের তাকিয়ে থাকতে হবে। তবে প্রয়োজনে আইনি পথে অধিকার আদায়ের ঘোষণা দিয়েছেন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি) সভাপতি আমিনুল হাকিম।
তিনি বলেন, খসড়া নীতিমালায় মনে হচ্ছে ‘দেশের চেয়ে মোবাইল অপারেটর বড়’। এ নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে, মোবাইল অপারেটরদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে। এতে তাদের জন্য নতুন ব্যবসার সুযোগ তৈরি করা হয়েছে, অথচ দেশীয় আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নানা আর্থিক চাপে ফেলে দেওয়া হচ্ছে।
ফাইবারহোম ডিএমডি সুমন আহমেদ সাবির বলেন, জুলাই পরবর্তী বাংলাদেশের জন্য কিছু মৌলিক সংস্কার অপরিহার্য হয়ে ওঠে। সেই ধারাবাহিকতায় সংস্কারের শুরু হয় টেলিযোগাযোগ খাতের। কিন্তু প্রস্তাবিত নীতিমালা নিয়ে অভিযোগ, বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুবিধা দিতেই এটা করা হচ্ছে। সরকারকেই এই প্রশ্নের সমাধান দিতে হবে। নতুন নীতিমালায় ইন্টারনেট কখনই বন্ধ করা হবে না- এমন বক্তব্য ‘স্ট্যান্টবাজি’ মন্তব্য করেন প্রযুক্তি নীতিমালা বিশ্লেষক আবু নাজম মুহাম্মাদ তানভীর হোসেন।
তিনি বলেন, ইন্টারনেট যদি বন্ধ করা হয়, তাহলে দায়িত্ব নিতে হবে, নীতিমালায় এমন নির্দেশনা থাকা উচিত। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতের মতন গুরুত্বপূর্ণ খাতের সংস্কার না করে টেলিযোগাযোগ খাতকে সংস্কার করা কেন জরুরী হয়ে উঠলো কেন? নীতিমালা নিয়ে তড়িঘড়ি না করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
আইএসপিবি সাধারণ সম্পাদক নাজমুল করিম ভূঁইয়া বলেন, আমরা মনে করি ইন্টারনেট মানে ইন্টারনেট হবে। মোবাইল, কৃত্রিম উপগ্রহ- এমন নানাভাবে ভাগ করতে চাই না। অসম প্রতিযোগিতা আরো বেগবান হবে। তবে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর ফেসবুক পোস্টে খসড়া সংশোধনে পরিবর্তনের যে ইঙ্গিত দিয়েছেন তার জন্য সাধুবাদ জানাই।
আইসিএক্স’র এম নূরুল আলম বলেন, দেশীয় উদ্যোক্তারা যেন বিকশিত হয়, জিডিপি বাড়ে, কর্মসংস্থান হয়, সে বিষয়টি পলিসিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়ার কথা। কিন্তু পলিসিতে রিফর্মে আমাদের কথা রাখা হয়নি। আমরা বৈষম্যের শিকার। বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ ও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার কথা বলা হলেও এটি নিয়ন্ত্রকের হাত থেকেও বাইরে চলে যাচ্ছে। বড় বিনিয়োগের কাছে, ছোটরা টিকে থাকতে পারবে না।
সামিট কমিউনিকেশনের সিটিও কে এম তারিকুজ্জামান বলেন, নতুন নীতিমালায় মোবাইল অপারেটরদের সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। নতুন পলিসিতে ট্রান্সলেশন কুক্ষিগত করার পথে যে বাধা ছিল তার অপমৃত্যু ঘটবে। এটা ২০০৮ পূর্ববর্তী সময়ে ফিরিয়ে নেওয়া হবে।