গতকাল শনিবার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) আয়োজিত ‘নগরে সকলের জন্য নিরাপদ আবাসন’ শীর্ষক পরিকল্পনা সংলাপে বক্তারা বলেছেন, সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও কার্যকর নীতি ছাড়া সবার জন্য আবাসন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এজন্য ঢাকা কেন্দ্রিক প্রকল্প থেকে সরে এসে সারাদেশে ভারসাম্যপূর্ণ আবাসন উন্নয়ন, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব, ভাড়াভিত্তিক ও সাশ্রয়ী কর্মসূচি এবং রিয়েল এস্টেট খাতে সামাজিক দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা জরুরি বলে তারা মনে করেন।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসানের সঞ্চালনায় পরিকল্পনা সংলাপে সভাপতিত্ব করেন বিআইপি’র সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান।
শুভেচ্ছা বক্তব্যে বিআইপি’র সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, ঢাকায় শতকরা ২০ ভাগ অধিবাসী জমির মালিক এবং শতকরা ৮০ ভাগ অধিবাসী ভাড়াটিয়া হিসেবে বসবাস করেন। উক্ত ৮০ ভাগের মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ অধিবাসী বস্তিতে বসবাস করেন, যা নগরবাসীর আবাসন বৈষম্যকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় ৮ শ্রেণীর মহল্লা ও আয়ভিত্তিক বেশ কয়েকটি সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস রয়েছে। তাই নগরের সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য সুষম ও নিরাপদ আবাসন নিশ্চিত করতে মহল্লা ও আয়ভিত্তিক পৃথক আবাসন প্রকল্প গ্রহণ করা জরুরি।
মূল প্রবন্ধে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, আবাসন শুধু মাথা গোঁজার ঠাঁই নয় এটি মানুষের নিরাপত্তা, মর্যাদা, স্বাস্থ্য ও জীবিকার ভিত্তি। রিয়েল এস্টেট খাতের অবদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই খাত দেশের জিডিপিতে ৭-৮ শতাংশ অবদান রাখলেও তা মূলত উচ্চবিত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশের আবাসন খাতের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো ভূমির অভাব, জমির উচ্চমূল্য, নির্মাণ ব্যয়ের বৃদ্ধি, সাশ্রয়ী ঋণের ঘাটতি এবং সরকারি পরিকল্পনার ধারাবাহিকতার অভাব। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি উল্লেখ করেন, সরকারের দৃঢ় পরিকল্পনা, মান নিয়ন্ত্রণ, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ও টেকসই নকশার সমন্বয় থাকলেই সাফল্য আসে।
বিআইপির সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, মানুষের শিক্ষা, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের আগে আবাসনের অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি নিম্নআয়ের মানুষ, অথচ তাদের জন্য নিরাপদ আবাসনের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই, যা অত্যন্ত হতাশাজনক। তিনি আরও বলেন, নিরাপদ আবাসন রাষ্ট্রের দায়িত্ব হওয়া উচিত। সরকারের আবাসন নীতিমালায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তত ২০ শতাংশ ইউনিট নিম্নআয়ের মানুষের জন্য সংরক্ষণের বিধান থাকা প্রয়োজন।
পরিকল্পনাবিদ ড. মুঃ মোসলেহ উদ্দীন হাসান বলেন, আমাদের দেশের রিয়েল এস্টেট ব্যবসা এখনো সারাদেশব্যাপী নয়, এটি মূলত ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক, যা অত্যন্ত হতাশাজনক। এই খাতে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রাশেদা রওনক খান বলেন, ভাষানটেকসহ বিভিন্ন সরকারি আবাসন প্রকল্প মূলত দরিদ্র ও গৃহহীন জনগোষ্ঠীর জন্য নেওয়া হলেও সঠিক টেকনিক্যাল জ্ঞানের অভাব, জটিল প্রশাসনিক প্রক্রিয়া, দুর্নীতি এবং মধ্যস্থভোগীদের প্রভাবের কারণে প্রকৃত বস্তিবাসীরা কাক্সিক্ষত সুবিধা পাচ্ছেন না।
পরিকল্পনাবিদ সালমা এ. শফী দেশের সমগ্র উন্নয়ন ও নাগরিকদের বাসযোগ্য জীবন নিশ্চিত করতে আবাসন ব্যবস্থার ওপর মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ঢাকা ও অন্যান্য অঞ্চলের আবাসন সমস্যা সমাধানে বিআইপি ও রিহ্যাবের মতো সংস্থা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করা জরুরি।
রিহ্যাব-এর সহ-সভাপতি প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ নিরাপদ ও টেকসই আবাসনের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে বলেন, নিম্নআয়ী ও গৃহহীনদের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে আবাসন প্রদান দেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বাস্তবসম্মত নয়। তিনি প্রস্তাব করেন, গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় পাইলট প্রকল্প পরিচালনা করে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে জাতীয় পর্যায়ে পূর্ণাঙ্গ আবাসন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা যেতে পারে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ ড. কাশফিয়া নাহরিন বলেন, উন্নত বিশ্বে বর্তমানে যেখানে পরিবেশবান্ধব ভবন নির্মাণে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, সেখানে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষাপটে জলবায়ু সহনশীল ও স্বল্পমূল্যের আবাসন নিয়ে ভাবা আরও জরুরি।
পরিকল্পনাবিদ মোঃ আরিফুল ইসলাম বলেন, সরকারি বা বেসরকারি উভয় উদ্যোগই এখন পর্যন্ত ‘সবার জন্য আবাসন’ ধারণা থেকে অনেক দূরে রয়েছে। বেসরকারি খাতের আবাসন কার্যক্রম মূলত উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য পরিকল্পিত, যেখানে মধ্যবিত্তদের জন্য কার্যকর কোনো উদ্যোগ এখনো দেখা যায়নি। অনুষ্ঠানে বিআইপি বোর্ড সদস্য, বিশিষ্ট নাগরিক, পরিকল্পনাবিদ ও পেশাজীবীগণ উপস্থিত ছিলেন।