সুশাসন আর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা বলে মুখে ফেনা তোলা হলেও আওয়ামীলীগ সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের কথা ও কাজের সাথে মিল ছিলনা। ডিজিটাল পদ্ধতির যুগে প্রবেশ করেও বাংলাদেশে সকল প্রকার প্রযুক্তিগত সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তির প্রেক্ষাপটটা ছিল নিয়ন্ত্রিত। যার একটা উদাহরন ‘অনলাইন জিডি’। এই জিডি (সাধারন ডায়রী) করার সুযোগ থানা পুলিশের বাইরে দেশবিদেশের যে কোন স্থান থেকেই করার প্রক্রিয়া তৈরী করেছিল বিগত আওয়ামীলীগ সরকার। কিন্তু অপশাসন চালাতে গিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ অন্যান্যদের দমন পীড়নের মুখে ‘গুম’ সংস্কৃতি চালুর কারনে অনলাইন জিডি করার ক্ষেত্রে ‘নিখোঁজ’ ব্যক্তিদের নিয়ে জিডি করার সুযোগ ছিলনা। অনলাইন জিডিতে এই সুযোগটি বন্ধ করে রেখেছিল বিগত সরকার। ফলে আওয়ামীলীগ সরকারের সময়কালে ‘নিখোঁজ’ বা ‘গুম’ হওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে ভুক্তভোগীদের পক্ষে অনলাইনে জিডি করা সম্ভব হয়নি। থানা পুলিশে এসব বিষয়ে জিডির বদলে লিখিত অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার মেলেনি। খবর সংশ্লিষ্ট সুত্রের।
পুলিশ সদর দফতরের একাধিক সূত্র জানায়, পুলিশের সেবাপ্রত্যাশীদের ভোগান্তি কমাতে চালু করা হয় অনলাইন জিডি (সাধারণ ডায়েরি) ব্যবস্থা। থানায় না গিয়েই নিজের ঘরে বসে বা অন্য যেকোন স্থান থেকে জিডি করা যায় অনলাইনে। এতে সেবা প্রত্যাশীদের সময় যেমন সাশ্রয় হয়, তেমনি থানায় যাওয়ার ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয় না। কিন্তু অনলাইনে জিডির করার ক্ষেত্রে এখনও কিছু ভোগান্তি বা বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে সেবাপ্রত্যাশীদের। সেবা প্রত্যাশীদের সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) ছবির সঙ্গে নিজের বর্তমান ছবির মিল খুঁজতে গিয়ে। এনআইডি এবং বর্তমান ছবির সঙ্গে না মিললে জিডি করতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে তাদের। বাধ্য হয়ে তাদের থানায় গিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তার সহায়তা নিয়ে অনলাইনে জিডি করতে হয়।
এছাড়া অনলাইন জিডি প্ল্যাটফর্ম (gd.police.gov.bd) বা অনলাইন জিডি অ্যাপসে প্রবেশে সমস্যা, সঠিক তথ্য দিতে না পারা এবং সেবা প্রত্যাশীর কারিগরি জ্ঞানের অভাবে অনলাইনে জিডি করতে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। তখন ভুক্তভোগী সেবা পান না। ঝুঁলে থাকে থানা পুলিশের পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য। যেকোনো ধরনের হারানো সংক্রান্ত জিডি অনলাইনে করা গেলেও গুরুত্বপূর্ণ জিডি বা অভিযোগের ক্ষেত্রে সেবা প্রত্যাশীকে শেষ পর্যন্ত থানায় যেতে হয়। এসব কারণে এখনও অনলাইনে জিডি ব্যবস্থা কাক্সিক্ষত সাড়া ফেলেনি সেবা প্রত্যাশীদের কাছে।
ভুক্তোভোগীরা বলছেন, অনলাইন জিডি প্রক্রিয়া পুলিশের একটা সফল উদ্যোগ। কিন্তু জিডি এন্ট্রি করতে গিয়ে কঠিন প্রক্রিয়া তাদের বিড়ম্বনায় ফেলছে। এটা আরও সহজ করা দরকার। জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত আইজি (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) খোন্দকার রফিকুল ইসলাম দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, ‘অনলাইন জিডি চালুর পর আমরা ভেবেছিলাম অনেক জিডি এন্ট্রি হবে। আমরা তা সামাল দিতে পারবো কিনা। কিন্তু সেই অনুযায়ী সাড়া পড়েনি কিংবা সংখ্যা বাড়েনি। আবার হঠাত করে কোন মাসে জিডির পরিমান কমে গেছে। কী কারণে কমল এ ব্যাপারে আমাদের যোক্তিক ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখবো। তিনি বলেন, ২০২২ সালে সীমিত আকারে অনলাইন জিডি চালু করা হলেও তখন হারানো এবং উদ্ধার ছাড়া আর কোন বিষয়ে জিডি করা যেত না। বাকি অপশনগুলো তখন বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। আমরা কিন্তু সব অপশন খুলে দিয়েছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেক আগে তোলা এনআইডির ছবির রেজুলেশন ভালো না। ফলে অনেক সময় লাইভ ছবির সঙ্গে এনআইডির ছবি ম্যাচ করছে না। তবে ৯৫ শতাংশ মিললেই আমরা রেজিস্ট্রেশন করে দিচ্ছি।
জানা গেছে, থানায় না গিয়ে অনলাইনে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) পদ্ধতি চালু করা হয় ২০২২ সালের ২১ জুন। এরপর থেকে http://gd.police.gov.bd পোর্টাল ঢুকে যেকোন স্থান থেকেই সংশ্লিষ্ট থানায় অনলাইনে জিডি করা যায়। কিন্তু নানা কারণে অনলাইনে জিডি করার ব্যবস্থাটা অনেক ক্ষেত্রেই বিগত সরকারের আমলে গতিহারা হয়ে যায়। গত বছর ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর গত ১৫ এপ্রিল প্রাথমিক পর্যায়ে পাইলট ভিত্তিতে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের সব থানা এবং চাঁদপুর জেলা পুলিশের সব থানায় অনলাইন জিডি সেবা চালু করা হয়। পরে পর্যায়ক্রমে সারাদেশে সব থানায় অনলাইনে জিডি করার সুবিধা চালু করা হয়। সর্বশেষ গত ২৫ সেপ্টেম্বর রেলওয়ে পুলিশের সকল থানায় (ছয়টি জেলার ২৪টি থানা) জনসাধারণের জন্য অনলাইন জিডি সেবা চালু করা হয়। এর মাধ্যমে দেশের সকল থানা সকল ধরনের অনলাইন জিডি সেবার আওতায় এসেছে বলে পুলিশ সূত্রের দাবী। সূত্র মতে, দেশের ৬৬৬ টি থানায় এই অনলাইন জিডি চালু আছে।
অনলাইন জিডি সেবা পেতে গুগল প্লে স্টোর থেকে Online GD এউ অ্যাপটি ডাউনলোড করে অথবা http://gd.police.gov.bd পোর্টালে ঢুকে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে এই সেবা নিতে হবে। এক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, সচল মোবাইল নম্বর ইনপুট দিতে হবে। এ ছাড়া লাইভ ছবি তুলতে হবে। এই লাইভ ছবির সঙ্গে এনআইডির ছবি মিললেই কেবল জিডির জন্য রেজিস্ট্রেশন করা যাবে। কারও জিডি করতে সমস্যা হলে পুলিশের হটলাইনের সহায়তা নেওয়া যাবে।
সূত্র জানায়, অনলাইন জিডি সেবা পেতে একাধিকবার রেজিস্ট্রেশন করার প্রয়োজন নেই। রেজিস্ট্রেশন অথবা অনলাইন জিডি করতে কোনো ধরনের অসুবিধা হলে ০১৩২০০০১৪২৮ হটলাইন নম্বরে যোগাযোগ করলে প্রতিকার মিলবে। হটলাইন নম্বরটি ২৪ ঘণ্টা চালু আছে।
পুলিশ সূত্র বলেছে, সংশ্লিষ্ট থানা থেকে সেবা প্রত্যাশীর অভিযোগের ধরন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে সেবাপ্রত্যাশীকে অবগত করা হবে। অভিযোগের বিষয়টি যদি জিডির যোগ্য হয়, তাহলে সেটি জিডি নম্বর এবং তদন্ত অফিসারের বিবরণীসহ ডিজিটাল জিডির কপি পাঠানো হবে। অভিযোগের বিষয়টি যদি মামলার যোগ্য (আমলযোগ্য অপরাধ) হয়, সেক্ষেত্রে অভিযোগের প্রিন্ট কপি অথবা অভিযোগের কোড নম্বরসহ সেবা প্রত্যাশীকে থানায় উপস্থিত হতে হবে।
পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, এনআইডি অপশন না থাকলে যেকেউ অন্যের নামে ভুয়া জিডি করতে পারে ফাঁসানোর জন্য। যাতে এ ধরনের ঘটনা ঘটে এজন্য এই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যিনি জিডি করবেন তার পরিচয় নিশ্চিত করতেই এনআইডি রাখা হয়েছে। এনআইডির সঙ্গে ছবি এবং তথ্যের সঙ্গে ম্যাচিং হলেই কেবল জিডির জন্য রেজিস্ট্রেশন করা যাবে। জিডি করতে যেকোন অভিযোগ অনলাইনে করার পর সংশ্লিষ্ট অভিযোগটি থানার অফিসার ইনচার্জের ড্যাশ বোর্ডে চলে আসবে। তিনি যাচাই-বাছাইয়ের পর সাবমিট দিলেই জিডি হয়ে যাবে। তবে মামলার বিষয় হলে তখন অফিসার জিডি করতে পারবেন না। অফিসার অভিযোগটি প্রক্রিয়াধীন রাখবেন এবং সেবাপ্রত্যাশীর কাছে একটি ম্যাসেজ পাঠাবেন।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ এপ্রিল থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৬ মাসে সারাদেশের থানাগুলোয় মোট ৩ লাখ ৬০ হাজার ৭৬৪ টি অনলাইন জিডি রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে থানায় না গিয়ে ঘরে বসে মাত্র ৪২ হাজার ৮৭৮টি অনলাইন জিডি রেকর্ড হয়েছে। আর থানায় উপস্থিত হয়ে পুলিশ কর্মকর্তার আইডি ব্যবহার করে অনলাইনে জিডি করা হয়েছে ৩ লাখ ১৭ হাজার ৮৮৬টি। এর মধ্যে থানায় না গিয়ে এপ্রিল মাসে ৪৭০টি, মে মাসে ১৯৭৯টি, জুন মাসে ৩১৯০টি, জুলাই মাসে ১০০৬৫টি, আগস্ট মাসে ১০৬০৫টি এবং সেপ্টেম্বর মাসে ১৬৫৬৯টি অনলাইন জিডি রেকর্ড করা হয়েছে।
এদিকে, কারিগরি ত্রুটির বিষয়টিও জড়িয়ে আছে অনলাইন জিডির সাথে। মাঝে মাঝে এই ত্রুটির কারনে সেবা বন্ধ থাকছে। সর্বশেষ গত ১৮ আগস্ট কারিগরি ত্রুটির কারণে অনলাইন জিডি সেবা সাময়িকভাবে বন্ধ থাকে। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই সেবাটি আবার চালু করা হয় হবে বলে জানায় পুলিশ সদর দপ্তর।