ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে ভারতের যে সম্পর্ক ছিল, সেই সম্পর্ক এখন আমাদের সাথে নেই। তাই সেটির বদলে এখন সম্পর্ক রিঅ্যাডজাস্টমেন্টের পর্যায়ে আছে বলেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। তবে প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক ‘শীতল’ নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সম্প্রতি চীনের কুনমিংয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় একটি জোট গঠন হয়েছে মর্মে নানা আলোচনা চলছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন আজ বলেছেন, আমরা কোনো জোট গঠন করছি না। ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগে বাংলাদেশ চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে জোট গঠন করছে কি না জানতে চাওয়া হয় উপদেষ্টার কাছে। জবাবে তিনি বলেন, আমরা কোনো জোট গঠন করছি না। মূলত, উদ্যোগটি চীনের এবং এটি একেবারিই অফিসিয়াল পর্যায়ে, রাজনৈতিক কোনো পর্যায়ে না।

গতকাল বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিফ্রিংয়ে এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, ভারতের সাথে সম্পর্ক শীতল আমি বলতে চাই না। আমি বলতেছি যে, এটা একটা রিঅ্যাডজাস্টমেন্টের (পুনর্বিন্যাস) পর্যায়ে আছে। আমরা এটাকে এভাবে দেখি। রিঅ্যাডজাস্টমেন্টের পর্যায়ে আছে এবং এ ব্যাপারে আমাদের স্বদিচ্ছার কোনো অভাব নেই। এটুকু বলে আমি এখানে থামব। মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই উপদেষ্টা বলেন, আমরা সত্যটাকে বরং স্বীকার করি যে, পূর্ববর্তী সরকারের সাথে ভারতের যে রকম ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, ভারত যে রকম সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছিল, আমাদের সাথে বর্তমান সম্পর্কটা ঠিক ওই রকম নাই। কাজেই এটাকে আমি রিঅ্যাডজাস্টমেন্ট বলছি।

এদিকে ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার পতনের পর থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে এক ধরনের টানাপোড়েন চলছে। বিচারের জন্য শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়ার পাশাপাশি দিল্লিতে বসে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির প্রচেষ্টার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে এনেছে ইউনূস সরকার। পাশাপাশি ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা ও অপতথ্য’ এবং ‘অতিরঞ্জিত প্রচারণার’ অভিযোগ বাংলাদেশ সরকার করেছে। বিভিন্ন বিষয়ে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি দেওয়ার পাশাপাশি সীমান্ত ইস্যু এবং দিল্লি থেকে দেওয়া শেখ হাসিনার বক্তব্য ঘিরে পাল্টাপাল্টি কূটনীতিক তলবের ঘটনাও ঘটেছে।

রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কিংবা যোগাযোগ কোন ধরনের সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের পর্যায়ে রয়েছে, এমন প্রশ্নে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, সম্পর্কতো সবকিছু মিলিয়েই। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সংঘাত নাই, কিছুই নাই একমাত্র রোহিঙ্গা সমস্যা ছাড়া। রোহিঙ্গা ইস্যুর একমাত্র সমাধান হচ্ছে, তাদের দেশে ফিরে যাওয়া, নিরাপদে থাকবে, স্বাভাবিক জীবন কাটাবে, সেখানে কেউ বাধা দেবে না, অত্যাচার অবিচার করবে না। এটুকু বিশ্ব সম্প্রদায় মোটাদাগে স্বীকার করে। কিন্তু বাস্তবায়ন করতে পারছি না। এবং নানা চেষ্টা-তদবির চলছে। বাস্তবতাটি মেনে নিই যে, আমরা তাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে কিছু করতে পারিনি। আশা করি, আগামী দিনগুলোতে আমরা সেটা করতে পারব।

পাকিস্তান ও চীনের সাথে জোট গঠন প্রসঙ্গে তৌহিদ হোসেন বলেন, ওখানে একটা প্রদর্শনী হচ্ছিল, সেখানে সাইডলাইনে তিন দেশের পররাষ্ট্রসচিব বসে আলাপ-আলোচনা করেছি। আলাপ-আলোচনা পুরোপুরি ছিল কানেক্টিভিটি, ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি; এগুলো বিষয় নিয়ে। আপনারা জোট গঠনের যে কথা বলছেন, এ ধরনের কোনো কিছু ছিল না। এটা নিতান্তই একটি প্র্যাকটিক্যাল সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির ব্যাপার। আমরা মনে হয় না, এটা নিয়ে আর কোনো কিছু হতে দেওয়া উচিত।

তেহরান থেকে ২৬ বাংলাদেশী পাকিস্তান হয়ে দেশে আসবেন: তেহরান থেকে প্রত্যাবাসিত ২৬ বাংলাদেশী গতকাল বৃহস্পতিবার পাকিস্তানে প্রবেশ করার কথা। সেখান থেকে পাকিস্তান সরকার তাদের করাচি নেওয়ার ব্যবস্থা করবে। করাচি থেকে ফ্লাইটে দেশে ফিরবেন প্রত্যাবাসিতরা। তিনি জানান, আজকের দিনের মধ্যে ২৬ জন পাকিস্তানের সীমানায় মধ্যে পৌঁছাবে। সেখান থেকে পাকিস্তান সরকার তাদের করাচি নিয়ে যাবে, সেখান থেকে তারা বিমানযোগে ফিরে আসতে পারবে। তুরস্কের মাধ্যমে কিছু করা যায় কিনা সেটাও আমরা চিন্তা করেছি। তবে যুদ্ধ পরিস্থিতি শান্ত হয়েছে, মনে হয় না যে চট করে আবার শুরু হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় ফিরতে চাওয়াদের আগ্রহ কমছে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, আমি অন্তত দু’একজনের কথা জানি যাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করা হচ্ছিল। তারা এখন আসতে চায় না। আমার মনে হয় এটা নিয়ে আর কোনো সমস্যা হবে না। যদি আরও অল্প কিছু মানুষ আসতে চায় তার ব্যবস্থা করা আছে।

ইউনূস-স্টারমার বৈঠক না হওয়া প্রসঙ্গে যা বললেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা: অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যুক্তরাজ্য সফরকে দেশটির পক্ষ থেকে ‘অফিসিয়াল’ বলা হয়েছিল বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকেই প্রথমে বলা হয়েছিল, এটি একটি অফিসিয়াল সফর। তাদের বক্তব্যের পরে আমরাও তা নিশ্চিত করি, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সফরকালে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক না হওয়া প্রসঙ্গে মন্ত্রণালয় এখনো কোনো পরিষ্কার ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘বৈঠকটি কেন হয়নি, এ মুহূর্তে আমি সঠিকভাবে বলতে পারছি না। কারণ, আমি নিজে সেখানে উপস্থিত ছিলাম না। যারা ছিলেন, তারাই হয়তো ভালো বলতে পারবেন। তবে বাস্তবতা হলো মিটিংটি হয়নি।

গত ১৮ জুন এক সংবাদ সম্মেলনে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব মো. রুহুল আলম সিদ্দিকী বলেন, ‘এ সফরের আগে যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার (ঢাকাস্থ) এক ব্রেকফাস্ট মিটিংয়ে আমাকে জানিয়েছিলেন, তারা এ সফরকে সরকারি সফর হিসেবে আপগ্রেড করেছেন। তার পরেও মিটিং না হওয়ার দায় কার- জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, এখন দেখা যাক, এর দায় কেউ নেয় কি না। তিনি বলেন, তারা বলেনি এ সময়ে বৈঠকটি হবে। তবে সফরটি অফিসিয়াল এটি বলা হয়েছিল এবং সেই অনুযায়ী আমাদের প্রত্যাশাও ছিল। অন্য এক প্রশ্নে তিনি বলেন, সফরকালে যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি।