তিন দফা দাবিতে গতকাল বুধবার প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা অভিমুখে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মিছিল কাকরাইলে পুলিশ বাধা দিয়েছে। পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে তারা সামনে এগিয়ে যেতে চাইলে পুলিশ বেরিকেড দিয়ে আটকে দেয়। এসময় বিক্ষুব্ধ হয়ে শিক্ষার্থীরা পুলিশের ওপর চড়াও হয়। পুলিশের ওপর মারমুখী হয়ে বেরিকেড ভাঙ্গার চেষ্টা করেন তারা। এসময় পুলিশ শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দিতে সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে। এরপরও শিক্ষার্থীরা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে যমুনার দিকে যেতে চাইলে পুলিশ টিয়ার শেল ও জলকামান ছুড়ে। একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। এতে পুলিশ, সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীসহ অন্তত অর্ধশত আহত হয়। পরবর্তীতে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্তলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পুলিশ ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার পর আন্দোলনকারীরা কাকরাইল মসজিদের সামনে অবস্থান নেয়। এরপর শিক্ষকদের একটি অংশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ছাত্রদের আন্দোলনে একাত্মতা জানান।

জানা গেছে, ৭০ শতাংশ আবাসন ভাতা, বাজেট বৃদ্ধি এবং সব প্রকল্পে অগ্রাধিকার দেওয়ার তিন দফা দাবি নিয়ে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে শুরু হয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ‘মার্চ টু যমুনা’কর্মসূচি। পদযাত্রা সংক্ষিপ্ত করতে পুলিশ তাঁতীবাজার ও গুলিস্থান, জিপিও মোড়, মৎস্য ভবনে ব্যারিকেড দিলে শিক্ষার্থীরা সেগুলো ভেঙে সামনের দিকের অগ্রসর হয়। তাদের মিছিল কাকরাইল এলাকায় পৌঁছালে সেখানে তাদের পুলিশ বাধা দেয়। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। আন্দোলনকারীরা ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করে। পরে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান ব্যবহার করে পুলিশ। তাতে ছত্রভঙ্গ হয়ে আন্দোলনকারীরা মৎস্য ভবন মোড়ের দিকে চলে যান। পরে তারা আবারও ফিরে এসে কাকরাইল মসজিদ মোড়ে রাস্তার ওপর বসে পড়েন। শিক্ষার্থীরা বলছেন, যতক্ষণ তাদের দাবি না মেনে নেওয়া হবে, ততক্ষণ তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।

আবাসন সমস্যায় থাকা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন। সোমবার তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনকে নিয়ে ‘জবি ঐক্য’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম গঠন করেন। সেদিন তাদের সমাবেশে দাবি আদায়ে যমুনা ঘেরাওয়ের কথা বলেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অনেকে। পরদিন মঙ্গলবার দুপুরে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধি দল ইউজিসিতে যায়। কিন্তু ইউজিসি থেকে আশানুরূপ কোনো ঘোষণা না আসায় ওই রাতে ‘মার্চ টু যমুনা’ কর্মসূচি ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। পুলিশের হামলায় আহত জবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. রইছ উদ্দীন বলেন, সরকারের এই কর্মকা-ে আমরা মর্মাহত। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় পুলিশের বিচার করতে হবে। এ সময় শিক্ষার্থীরাÍ জেগেছেরে জেগেছে, জবিয়ান জেগেছে; আমার ভাই অনাহারে, যমুনা কী করে; এসেছি যমুনায়, যাব না খালি হাতে; আমার ভাই আহত কেন, ইন্টেরিম জবাব চাই ইত্যাদি স্লোগান দেন। বিকেল ৩টার পর কাকরাইল মসজিদ মোড়ে এসে উপস্থিত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড.সাবিনা শারমিন, ব্যবসায় অনুষদের ডিন মঞ্জুর মোর্শেদসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জানান, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মৎস্য ভবন পার হয়ে কাকরাইল মসজিদের মোড়ে আসতেই পুলিশ হামলা চালায়। এ সময় পুলিশ টিয়ারগ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড, গরম পানি নিক্ষেপ করে। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ প্রায় শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন।

আহতরা হলেন- রেদোওয়ান (২৪), আসিফ (২০), রহমান (২২), আকিব (২১), আরিফ (২২), রফিক (২৫), শফিক (২৫), ওমর ফারুক(২৪), দৈনিক সংবাদের মেহেদী হাসান (২৪), অর্থিব (২১), আপেল (২১), মুজাহিদ (২৩), রায়হান (২৩), ফারুক (২৩), আবু বক্কর (২২), নিউটন (২০), হানিফ (২২), জীবন (২২), শহীদ(২০), রাসেল (২২), জিসান(২২), জবি সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা পোস্টের ক্যাম্পাস প্রতিবেদক মাহাতাব লিমন (২৩), শহীদ (২৪), রাসেল (২৩), গৌরব (২৫), আব্দুল মান্নান (২২), নাহিদ (২৩), জুয়েল (২৩), মোহন (২২), সোহানুর রহমান সানি (২৪), মাছুমা(২০), সংগ্রাম (২০), বাইতুল (২২), রাজু (২২), সুমন (২২), রাজীব (২২), আকাশ (২২), বাংলা ট্রিবিউনের জবি প্রেসক্লাব সভাপতি আসাইফ আশরাফ (২৬)।

এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. রইছ উদ্দিন, ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক নাসিরউদ্দিন, ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক বেলাল, সহকারী প্রক্টর নাইম সিদ্দিকি আহত হয়েছেন। পুলিশের লাঠিচার্জ ও টিয়ারগ্যাসে আহত শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। বর্তমানে জরুরি বিভাগের বিভিন্ন ওয়ার্ডে তাদের চিকিৎসা চলছে। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হয়েছেন। অন্তত ৩৮ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী আহত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

জবি সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহাতাব লিমন জানান, আমরা যৌক্তিক আন্দোলন নিয়ে যমুনার অভিমুখে লংমার্চে যাওয়ার সময় পুলিশ শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সাংবাদিকদের ওপর লাঠিচার্জ এবং টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। কয়েকজন গুরুতর আহত এবং বেশ কয়েকজনের হাত ভেঙে যায়। তিনি আরও বলেন, পুলিশ যেভাবে আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়েছে সেটি জুলাই আন্দোলনেও হয়নি। আমাদের নারী শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের ওপর পুলিশ হামলা চালিয়েছে। অনতিবিলম্বে এ ঘটনায় যারা দোষী তাদের বিচারের দাবি জানাচ্ছি। অন্যদিকে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সড়ক ছেড়ে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ পরিদর্শক মো. ফারুক বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বর্তমানে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এ ঘটনায় ৩৮ জন আহত হয়েছেন। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার মাসুদ আলম বলেন, জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা কাকরাইলে আমাদের ব্যারিকেড ভেঙ্গে যুমুনা অভিমুখে যেতে চাইলে প্রথমে আমরা শান্তভাবে তাদের এখানে থেমে যেতে বলি। কিন্তু তারা পুলিশের কথা শোনতে চায়নি। তারা পুলিশের ওপর চড়াও হয়ে ইটপাটকেল ছুড়ে। তাদের ছোড়া ইটের আঘাতে পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্য আহত হয়েছেন। আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছেন ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ল বিভাগের সাদিয়া আক্তার নেলি, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের রীতি আক্তার, ইংরেজি বিভাগের রাতুল, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের আবদুল্লাহ আল ফারুক, দর্শন বিভাগের আসিফ আদনান। এছাড়া পুলিশের লাঠিপেটায় তিন সংবাদকর্মীও আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

তাদের তিন দফা দাবি হল: আবাসন নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর জন্য আবাসন বৃত্তি কার্যকর করতে হবে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট কাটছাঁট না করেই অনুমোদন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ পরবর্তী একনেক সভায় অনুমোদন করে অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়ন করতে হবে। এই আন্দোলনের কারণে সব ইন্সটিটিউট ও বিভাগের চলমান ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।