রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে নেওয়া হয়নি
২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীর ৪৩ নবাব কাটরার পাঁচতলা ভবনের নিচতলায় রাসায়নিকের গুদামে লাগা আগুন ছড়িয়ে পড়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন ১২৪ জন। ভয়াবহ সেই আগুনে আশপাশের বাড়ি ও ভবনগুলো যে পুড়েছিল, এখন তা দেখে বোঝার কোন উপায় নেই। মেরামত করে, পোড়া দাগ তুলে সেগুলোতে রং করা হয়েছে। কোন কোন ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত পরিবর্তনও আনা হয়েছে আংশিকভাবে। দগ্ধ মানুষগুলোর শরীরের পোড়া ক্ষতও শুকিয়েছে যন্ত্রনা শেষে, কিন্তু দীর্ঘ এতটা সময়েও দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারছেন না তাঁরা ও প্রিয়জন-স্বজন হারানো মানুষেরা। ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৈরী করা স্মৃতিস্তম্ভটি এখনো মনে করিয়ে দেয় সেই ১৫ বছর আগের ঘটনা। আজ সেই নিমতলী ট্রাজেডির দু:সহ স্মৃতির দিন।
নিমতলীর বাসিন্দারা জানান, পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় (২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি) আগুন লাগার ঘটনায় মামলায় ভবনমালিক গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। কিন্তু নিমতলীতে রাসায়নিকের গুদাম রাখা ভবনমালিকদের কোনো জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি করা হয়নি। তাঁদের (স্থানীয় বাসিন্দা) দাবি একটাই, শতাধিক মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় মামলা করে দায়ী ব্যক্তিদের সুষ্ঠু বিচার।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডের কথা স্মরণ করে প্রতিবছর এ দিনটি এলে নিমতলীবাসী হারানো স্বজনদের কথা মনে করে কাঁদেন। আপনজনের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দিনব্যাপী দোয়া মাহফিল আয়োজন করেন। রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দেন।
সেদিনের ঘটনা : নিমতলীতে আগুনের ঘটনায় মারা যান ১২৪ জন। দগ্ধ হন অর্ধশতাধিক। ওইদিন একটি বিয়েবাড়ির চুলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। আশপাশে কেমিকেলের গুদাম থাকায় চোখের পলকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ভয়াবহ রূপ ধারণ করে আগুনের লেলিহান শিখা। পুড়ে মারা যান বিয়ের কনের আত্মীয়-স্বজন, অতিথি ও প্রতিবেশীরা। পুড়ে যায় ২৩টি বসতবাড়ি, দোকান ও কারখানা। দগ্ধ আরও কয়েকশ মানুষ দীর্ঘ চিকিৎসায় প্রাণে বেঁচে যান। তবে তাদের অনেকেই আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। শরীরে নিয়ে বেড়াচ্ছেন আগুনের ক্ষত। নেওয়া হয়নি স্থানীয় মানুষের জন্য সুরক্ষামূলক পদক্ষেপ। আর ভুক্তভোগী পরিবারগুলোও তেমন কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি।
এ ঘটনায় একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়। ঘটনার পর তদন্ত কমিটি পুরান ঢাকার আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করে। তবে আজও সেই সুপারিশ পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। তখন কমিটি কেরানীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জে জায়গা ঠিক করার সুপারিশসহ উচ্চমাত্রার বিপজ্জনক ৫ শতাধিক রাসায়নিকের তালিকা করে প্রতিবেদন দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়ে।
নিমতলীর পরে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় ঘটে গেছে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায়। এছাড়া পুরান ঢাকায় প্রায়ই ঘটে ছোটবড় আগুনের ঘটনা। তবে কোনোভাবেই পুরান ঢাকা থেকে সরছে না কেমিকেলের গোডাউন।
জানা গেছে, পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের গুদাম ও দোকান ২০ হাজারের বেশি। এর মধ্যে অনুমোদন বা লাইসেন্স আছে মাত্র ৮০০টি গুদামের। বাসাবাড়িতেও রাখা হয় বিভিন্ন কেমিকেল।
জিডির আর তদন্ত হয়নি : নিমতলীর ঘটনার সূত্রপাত ৪৩ নবাব কাটারার বাসিন্দা গুলজার আলীর পাঁচতলা বাড়ির নিচতলায় রাসায়নিকের গুদামে লাগা আগুন থেকে। তা মুহূর্তে প্রায় আধা কিলোমিটারজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এতে দগ্ধ হয়ে ১২৪ জন মারা যান। দগ্ধ হন আরও কয়েক শ মানুষ। কিন্তু এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। শাস্তিও হয়নি কারও। তবে বংশাল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছিল। গত ১৫ বছর ধরে রাষ্ট্রের কাছে একটাই দাবি ছিল, ঘটনার সুষ্ঠু বিচার, কিন্তু সেটা পাননি নিমতলীবাসী।
নিমতলীর ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা হয়নি। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় হওয়া জিডির সূত্র ধরে তখন ১২৪ জনের লাশ ঢাকা জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করতে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। এরপর জিডির আর তদন্ত হয়নি। এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। এতে আগুনের ঘটনার জন্য দায়ীদের শনাক্ত করা যায়নি। বহুল আলোচিত এ ঘটনায় কাউকে দোষী করা যায়নি। ওই ঘটনায় নিয়মিত মামলা দায়ের না হওয়ায় দায়ীদের বিচারের বিষয়টি আড়ালেই থেকে গেছে।
রাসায়নিকের গুদামের কী অবস্থা : নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের ৯ বছরের মাথায় চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জন মারা যান। নিমতলীর ঘটনার পরপরই পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম সরানোর দাবি উঠেছিল। তখন রাসায়নিকপল্লি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। কিন্তু প্রকল্প অনুমোদন হতেই প্রায় ৯ বছর পেরিয়ে যায়। এর মধ্যেই চুড়িহাট্টায় ‘ওয়াহেদ ম্যানশন’ ভবনে থাকা রাসায়নিকের গুদামে অগ্নিকাণ্ড ঘটে।
এরপর আরও কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে, মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এই মৃত্যু ও দুর্ভোগের কারণ পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম সরাতে না পারা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য, পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের ঝুঁকি এখনো রয়েই গেছে। এ জন্য দায়ী সুশাসনের ঘাটতি, জবাবদিহির অভাব ও জীবনরক্ষার প্রকল্পে অগ্রাধিকার না দেওয়া।
চুড়িহাট্টার ঘটনার পর শিল্প মন্ত্রণালয় রাসায়নিকের কিছু গুদাম টঙ্গীর কাঁঠালদিয়া ও ঢাকার শ্যামপুরের বন্ধ হয়ে যাওয়া উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরির জমিতে সরানোর উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু তাতেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই।
নিমতলীর ঘটনার পর পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেওয়ার জন্য সরকারি নানা নির্দেশনা জারি হয়। নিমতলী ও চুরিহাট্টা ট্রাজেডির যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেজন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর নির্দেশনা দেন। নির্দেশনা দেওয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি এখন পর্যন্ত। প্রধানমন্ত্রী এই মর্মস্পর্শী দুর্ঘটনায় সব হারিয়ে ফেলা তিন বোনের বিবাহের ব্যবস্থা করেন, তাদের স্বামীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দেন। মন্ত্রিপরিষদ এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করে। অথচ মর্মবেদনা জাগানো এই ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এড়িয়ে গেছেন দায়-দায়িত্ব অথবা দায় চাপিয়েছেন অন্যের ওপর।