বাংলাদেশে এলপিজি : অর্থনীতি, পরিবেশ ও নিরাপত্তা শীর্ষক এক সেমিনারে জ¦ালানী বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, দেশের প্রাথমিক জ্বালানির ঘাটতি কোনো স্বাভাবিক সংকট নয় এটা পরিকল্পিত । কিছু রাজনীতিবিদ ও তাদের সহযোগী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কারণে তৈরি হয়েছে। স্বল্পমেয়াদি জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় এলপিজির দাম নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। বাজারে যে সিলিন্ডার ১৪০০/ ১৫০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে তা ১০০০ টাকা হওয়া উচিত। গ্যাস দুর্ঘটনাও পিছিয়ে নেই। চলতি বছর গ্যাসজনিত অগ্নিকান্ডের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৬০০টির মতো। এলপিজি সিলিন্ডার বিস্ফোরণে অগ্নিকান্ডের সংখ্যা বেড়ে ৫৮০ ছাড়িয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় আনুমানিক ২০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে।
গতকাল শনিবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে অনুষ্ঠিত সেমিনারে এসব কথা বলেন তারা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান এবং সম্মানিত অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ।
প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ জাহেদ কামাল, ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী, এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আমিরুল হক, ইস্টার্ন ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখারসহ অন্যান্যরা
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মোহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, দেশের স্বল্পমেয়াদি জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় এলপিজির দাম নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। বর্তমানে সিলিন্ডারের বাজার মূল্য ১২০০ টাকার বেশি হওয়ায় শিল্প ও গৃহস্থালি ব্যবহারকারীরা যথাযথ সুবিধা পাচ্ছেন না। অথচ এর দাম ১ হাজার টাকার মধ্যে হওয়া উচিত।
উপদেষ্টা বলেন, এলপিজির প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো দাম। বর্তমানে ১২০০ টাকা দামের সিলিন্ডার কিছু ক্ষেত্রে বাজারে ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তাই দামের নিয়ন্ত্রণ, লজিস্টিক উন্নয়ন এবং প্রাইভেট সেক্টরের কার্যকারিতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। দায়িত্বশীল ব্যবসায়িক মনোভাব ছাড়া দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, দেশের প্রাথমিক জ্বালানির ঘাটতি কোনো স্বাভাবিক সংকট নয়। এটি একটি পরিকল্পিত অবস্থার ফল, যা ক্ষমতাসীন কিছু রাজনীতিবিদ ও তাদের সহযোগী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কারণে তৈরি হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও গ্যাস লাইনের পরিকল্পনায় গ্যাস সরবরাহের চাহিদা উপেক্ষা করা হয়েছে, ফলে শিল্প ও গৃহস্থালিতে বিপুলসংখ্যক অবৈধ সংযোগও হয়েছে।
ফাওজুল কবির জানান, স্থানীয় গ্যাস উৎপাদন প্রতিবছর কমছে। প্রতিবছর প্রায় ২০০ মিলিয়ন কিউবিক ফুট উৎপাদন কমছে, কিন্তু আমরা মাত্র ৭০ মিলিয়ন কিউবিক ফুট নতুন গ্যাস সংগ্রহ করতে পেরেছি। এ জন্য এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে, যদিও এর উচ্চমূল্যের কারণে সমালোচনা হচ্ছে।
তিনি বলেন, এলএনজি আমদানিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া প্রয়োজন, তাই স্বল্পমেয়াদে ঘাটতি মোকাবিলায় এলপিজি কার্যকর বিকল্প হতে পারে।
ক্যাব-এর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বলেছেন, সরকারি মালিকানাধীন এলপিজি সিলিন্ডার ন্যায্য দামে থাকা সত্ত্বেও তা প্রান্তিক ভোক্তার কাছে ঠিকভাবে পৌঁছাচ্ছে না। বাজারে রিটেইলার ও ডিস্ট্রিবিউটারের মাধ্যমে অনিয়মিতভাবে দাম বাড়ছে। অন্যদিকে রেগুলেটরি কমিশন যথাযথ নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি কার্যকর করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
শামসুল আলম বলেন, সরকারি মালিকানাধীন এলপিজি ৬০০ টাকায় থাকা সত্ত্বেও তা বাজারে অন্যভাবে ছড়ানো হচ্ছে। লাইসেন্স দেওয়ার তিনটি প্রবিধান ২০২১ সালে নীতিতে থাকলেও বাস্তবায়ন করা হয়নি। ফলে রিটেইলার ও ডিস্ট্রিবিউটারের দায়-দায়িত্ব স্পষ্ট নয় এবং সিলিন্ডার বিস্ফোরণের মতো ঘটনার জন্য দায় নির্ধারণের কোনো সুস্পষ্ট প্রক্রিয়া গড়ে ওঠেনি।
তিনি বলেন, রেগুলেটরি কমিশন ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং ওয়ান-স্টপ সার্ভিসের অভাবে ঘুস দেওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে, যা শেষ পর্যন্ত প্রান্তিক ভোক্তাদের ওপরই পড়ছে। লাইসেন্সধারীদের পূর্ণ দায়িত্ব ও অভ্যন্তরীণ প্রবিধান বাস্তবায়ন করে রেগুলেটরকে শক্তিশালী করা না হলে ভোক্তা-সুরক্ষা ও পণ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
অধ্যাপক ড. ম. তামিম বলেছেন, নিজস্ব উৎস থেকে গ্যাস সরবরাহ কমছে, আমদানিও সীমিত। ফলে বড় ধরনের জ্বালানি সংকটের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেশের গ্যাস সরবরাহের বড় অংশই আসে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে, যা এখন প্রায় লাইফের শেষ পর্যায়ে।
ড. তামিম বলেন, স্বল্পমেয়াদে এই ঘাটতি মোকাবিলায় এলপিজি কার্যকর সমাধান হতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ বাড়ানোই টেকসই পথ।
তিনি বলেন, গত ১০ বছরে দেশের প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ প্রতিবছর গড়ে ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট কমেছে, বর্তমানে তা বছরে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট হারে হ্রাস পাচ্ছে।
ড. ম .তামিম বলেন, দেশের প্রাথমিক জ্বালানির ৬৫ শতাংশই এখন আমদানি করতে হচ্ছে। তেল, কয়লা ও গ্যাস সব ক্ষেত্রেই বাড়ছে বিদেশনির্ভরতা। স্থানীয় উৎপাদন কমে যাওয়ায় জ্বালানি সরবরাহে ঘাটতি দিন দিন প্রকট হচ্ছে। বর্তমানে দৈনিক চাহিদা প্রায় ৪০০০ মিলিয়ন ঘনফুট, অথচ সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ২৫০০/২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। ফলে প্রতিদিন প্রায় ১৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এই ঘাটতি পূরণে বিকল্প জ্বালানি উৎস হিসেবে এলপিজি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
ড. তামিম বলেন, শিল্প, বাণিজ্যিক ও গৃহস্থালি খাতে গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা বেশি। শুধুমাত্র শিল্প খাতেই মোট এনার্জি ব্যবহারের প্রায় ৪৫–৫৬ শতাংশ গ্যাসনির্ভর। তাই এলপিজি শিল্পখাত, পরিবহন, বাণিজ্যিক ও গৃহস্থালি ব্যবহারে প্রাকৃতিক গ্যাসের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, এলপিজি হলো একমাত্র জ্বালানি যা কখনও সরকারিভাবে ভর্তুকি পায়নি। তবুও বাজার-চালিত খাত দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে দেশে প্রায় ২২টি কোম্পানি এলপিজি সরবরাহ করছে। দেশে ব্যবহার বছরে প্রায় ১৫–১৬ লাখ টন, যা সাত বছর আগে এক লাখ টনেরও কম ছিল।
ড. তামিম আরও বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, ক্যাপটিভ পাওয়ার ও শিল্প খাতে গ্যাস ঘাটতির প্রায় ৩০ শতাংশই এলপিজি দিয়ে পূরণ করা সম্ভব। দেশীয় অবকাঠামো দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সমমানের এলপিজি সরবরাহ করা সম্ভব। নতুন এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে অন্তত পাঁচ বছর সময় লাগবে। তবে এলপিজি খাতে দ্রুত বিনিয়োগ ও নীতিগত সহায়তা দিলে এক বছরের মধ্যেই সরবরাহ সক্ষমতা দ্বিগুণ করা সম্ভব।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ জাহেদ কামাল বলেছেন, চলতি বছরে দেশে এলপিজি সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও গ্যাসজনিত অগ্নিকান্ডের সংখ্যা বেড়ে ৫৮০ ছাড়িয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় আনুমানিক ২০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। সামগ্রিকভাবে গ্যাসজনিত অগ্নিকান্ডের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৬০০টির মতো।
ডিজি মোহাম্মদ জাহেদ কামাল বলেন, উদ্ধারকাজের মাধ্যমে প্রায় ৯৫ কোটি টাকার মতো সম্পদ রক্ষা করতে পেরেছি। তবে এই কাজে বহু ফায়ার ফাইটার আহত হয়েছেন। সম্প্রতি কেমিক্যাল কারখানার দুর্ঘটনায় আমাদের তিনজন সহকর্মী শাহাদত বরণ করেছেন। এটি আমাদের আরও সতর্ক হওয়ার প্রেরণা দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এলপিজি খাত ক্রমবর্ধমান এবং এর ব্যবহার ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। তাই নিরাপত্তার বিষয়টি এখনই আরও গুরুত্ব দিয়ে দেখা দরকার। যেহেতু ব্যবহার বাড়বে, দুর্ঘটনার ঝুঁকিও থাকবে। তাই সচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি।
ডিজি জানান, ফায়ার সার্ভিস ইতোমধ্যেই স্কুলপড়ুয়া শিশুদের মধ্যে অগ্নিনিরাপত্তা জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে পাঠ্যপুস্তকে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ক্লাস ওয়ান থেকে ফাইভ পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকে অগ্নিনিরাপত্তা সংক্রান্ত পাঠ অন্তর্ভুক্ত করতে একটি লেসন প্ল্যান জমা দেওয়া হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, ২০২৬ সালের বইয়ে এটি অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
তিনি আরও জানান, তৈরি পোশাক খাতের মতো সমন্বিত প্রশিক্ষণ ও সচেতনতার কারণে অগ্নিদুর্ঘটনা কমেছে। একইভাবে এলপিজি খাতেও ৫৩৭টি স্টেশনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, যা ধীরে ধীরে ৯৯৭টি স্টেশনে উন্নীত হবে। ব্যবসায়ী ও অপারেটররা চাইলে সহজেই এসব স্টেশন থেকে প্রশিক্ষণ নিতে পারবেন।