দখলদার ইসরাইলের সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধের পর জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। গতকাল বৃহস্পতিবার টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে ইসরাইলের বিরুদ্ধে ইরান বিজয়ী হয়েছে বলে ঘোষণা করেছেন তিনি। এদিকে এক রাষ্ট্রীয় সফরে নিজেদের বিশ্বস্ত মিত্র এবং বৃহত্তম ব্যবসায়ীক অংশীদার দেশ চীনে গিয়েছেন ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আজিজ নাসিরজাদেহ। এছাড়া জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থাপিত ব্যাখ্যার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ইরান। অপরদিকে ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, ইহুদিবাদী শাসকের (ইসরাইল) বিরুদ্ধে জয় জনগণের দৃঢ়তা এবং প্রতিরোধের ফলে অর্জিত হয়েছে। জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক বার্তায় পেজেশকিয়ান এ কথা বলেন।
জাতির উদ্দেশে ভাষণে খামেনি বলেন, ইহুদিবাদী সরকারের (ইসরাইলের) বিরুদ্ধে জয়ের জন্য আপনাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। ইহুদিবাদীরা পরাজিত হয়েছে এবং ইসলামি প্রজাতন্ত্রের ধাক্কায় চূর্ণবিচূর্ণ ও ধ্বংস হয়েছে। ইহুদিবাদীরা অনেক উচ্চবাচ্য করলেও ইরানের ধাক্কায় পতনের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছিল।
তিনি বলেন, মার্কিন সরকার যুদ্ধে সরাসরি জড়িত হয়েছিল। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল যদি হস্তক্ষেপ না করে তাহলে ইহুদিবাদীদের পতন ঘটবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন কোনো কিছু অর্জন করেনি।এখানে বিজয়ী হয়েছে ইরান এবং আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে চূড়ান্ত আঘাত করেছি। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জয় পাওয়ায় আমি সবাইকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। ইরানের বিরুদ্ধে যদি কেউ আবারও আগ্রাসন চালানোর চেষ্টা করে তাহলে সেজন্য চড়া মূল্য দিতে হবে বলেও হঁশিয়ারি দিয়েছেন দেশটির এই সর্বোচ্চ নেতা। তিনি বলেন, ইরানের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের মূল্য চড়া হবে। ইহুদিবাদীরা (ইসরাইল) কখনও ভাবেনি তারা ইরানের কাছ থেকে এমন ধাক্কা খাবে।
খামেনি বলেন, আমাদের সশস্ত্র বাহিনী শত্রুদের বহু স্তরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে তাদের প্রাণকেন্দ্রগুলোতে আঘাত হেনেছে। ভাষণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়েও কথা বলেন আয়াতুল্লাহ খামেনি। তিনি বলেন, ট্রাম্প তাদের পারমাণবিক কেন্দ্র ধ্বংস করে দেওয়ার যে দাবি করেছেন, সেটি সত্য নয়। আমাদের পারমাণবিক অবকাঠামোর বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কিছুই অর্জন করতে পারেনি।ইরানিরা ঐক্যবদ্ধ। সবাই একত্রিত ছিল। কাতারের আল উদেইদ মার্কিন ঘাঁটিতে যে হামলা হয়েছে, সেটিকে তারা উড়িয়ে দিয়েছে সত্যকে আড়াল করার জন্য। সময়ই শত্রুদের ক্ষয়ক্ষতি প্রকাশ করবে। ইরান কখনও আত্মসমর্পণ করবে না জানিয়ে খামেনি বলেন, ট্রাম্প বলেছেন, ইরানকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। ট্রাম্প সত্য প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ইরান কেবল আত্মসমর্পণ করলেই যুক্তরাষ্ট্র সন্তুষ্ট হবে। কিন্তু আত্মসমর্পণ কখনও হবে না। আমরা শক্তিশালী জাতি। ইরান মার্কিনিদের মুখে চপেটাঘাত করেছে।
চীন সফরে গেলেন ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী: এক রাষ্ট্রীয় সফরে নিজেদের বিশ্বস্ত মিত্র এবং বৃহত্তম ব্যবসায়ীক অংশীদার দেশ চীনে গিয়েছেন ইরানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আজিজ নাসিরজাদেহ। চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বাণিজ্যিক জোট সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) সম্মেলনে যোগ দিতে বর্তমানে চীনের উপকূলীয় শহর কুইংদাওয়ে অবস্থান করছেন তিনি। টানা ১২ দিনের সংঘাত শেষে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে গত ২৪ জুন যুদ্ধবিরতিতে গেছে ইরান এবং ইসরাইল। যুদ্ধবিরতির পর এই প্রথম চীন সফরে গেলেন ইরানের কোনো মন্ত্রী। রাশিয়া, চীন, ভারত, ইরান, পাকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান এবং বেলরুশ ৯ দেশের নিরাপত্তা ও বাণিজ্যিক জোট এসসিও’র যাত্রা শুরু ২০০১ সাল থেকে। ভৌগলিকভাবে এই জোটের অন্তর্ভুক্ত এলাকার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। গত ২৪ জুন নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর সম্মেলন। তার একদিন পর শুরু হলো এসসিও সম্মেলন। এবারের সম্মেলন হচ্ছে ৯ সদস্যরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পর্যায়ে।
হামলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাখ্যার প্রতিবাদ জানাল ইরান: জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থাপিত ব্যাখ্যার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ইরান। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সেক্রেটারি জেনারেল ও প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে ইরানের স্থায়ী প্রতিনিধি আমির সাঈদ ইরাভানি এই ব্যাখ্যাকে আইনিভাবে ভিত্তিহীন বলে অভিহিত করেন। চিঠিতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হামলাকে ‘অবৈধ এবং জাতীয় সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন’ বলে উল্লেখ করে ইরান। একইসঙ্গে জাতিসংঘ সনদের ৫১ অনুচ্ছেদের আওতায় আত্মরক্ষার অধিকার দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলার যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে ‘আন্তর্জাতিক আইনের হত্যা’ বলে অভিহিত করা হয়। চিঠিতে ইরাভানি বলেন, আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সাধারণ সম্মেলনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী, শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর যে কোনও ধরনের হামলা কিংবা হামলার হুমকি আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন এবং সংস্থাটির বিশ্বাসযোগ্যতা ও যাচাই প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ণ করে।
জনগণের দৃঢ়তা ও প্রতিরোধের ফলে ইসরাইলের বিরুদ্ধে জয় অর্জিত হয়েছে-ইরানি প্রেসিডেন্ট: ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, ইহুদিবাদী শাসকের (ইসরাইল) বিরুদ্ধে জয় জনগণের দৃঢ়তা এবং প্রতিরোধের ফলে অর্জিত হয়েছে। জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক বার্তায় পেজেশকিয়ান এ কথা বলেন। খবর মেহের নিউজ এজেন্সির। প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান বলেন, ইসরাইলী সরকারের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়েছে ইরানের মহান জাতির প্রতিরোধ, ঐক্য এবং সৌহার্দ্যের মাধ্যমে। তিনি বলেন, এই সময়ে জাতির মধ্যে ঐক্য, শান্তি এবং সংহতি ফলপ্রসূ হয়েছে। এই ঐতিহাসিক বিজয়ের সমস্ত গৌরব মহান জাতি এবং সভ্যতার। তিনি আরও বলেন, শত্রু যদি ইসলামী প্রজাতন্ত্রের পরিচয়ের প্রতি গভীর মনোযোগ দিত, তাহলে তারা কখনও এই গুরুতর ভুল করত না। ইরানিদের সাহসী প্রতিরোধের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, তারা ইহুদিবাদী শাসকের ১২ দিনের যুদ্ধের অবসান প্রত্যক্ষ করছে। তিনি বলেন, শত্রুরা কিছু অজুহাতে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের ওপর আগ্রাসন চাপিয়ে দিয়েছে। একইসঙ্গে ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচিতে যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি নিরনের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়েছে।