মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) সরকারকে আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী গুম রোধে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। সংগঠনটির মহাসচিব মুনিরুজ্জামান এ আহ্বান জানিয়ে বলেন, গত বছর আগস্ট থেকে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত স্বাধীন কমিশন ১ হাজার ৭৫২টি গুমের ঘটনা তদন্ত করছে। এর মধ্যে এখনো ৩৩০ জন নিখোঁজ। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাবেও গত এক দশকে শত শত গুমের ঘটনা ঘটেছে। ‘অধিকার’ জানায়, ২০০৯ থেকে জুন ২০২৪ পর্যন্ত ৭০৮ জন নিখোঁজ হয়েছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, ২০০৭ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ৬২৯ জন গুম হয়েছেন। এইচআরএসএসের হিসাবে ২০১৫ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত গুমের সংখ্যা ৩৯২ এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হিসাবে ২০০৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত প্রায় ৬০০ জন গুম হয়েছেন। এছাড়াও গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের প্রকৃত সংখ্যা ও পূর্ণাঙ্গ চিত্র প্রকাশ করা জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার কর্মী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। তাদের মতে, গুম কেবল ব্যক্তিগত ক্ষতি নয় এটি রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য গভীর সংকটের প্রতীক। এ ধরনের ঘটনার সঠিক তথ্য গোপন করা হলে ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হয়, জবাবদিহিতা দুর্বল হয় এবং গণতন্ত্রের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে পড়ে।
গতকাল শুক্রবার জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক আলোচনায় সংগঠনটির মহাসচিব মুনিরুজ্জামান এ আহ্বান জানিয়েছেন। ৩০ আগস্ট আন্তর্জাতিক গুম দিবস সামনে রেখে এই কর্মসূচি নেয়া হয়। আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, জাতিসংঘের জ্যেষ্ঠ মানবাধিকার উপদেষ্টা হুমা খান, আইনজীবী সারা হোসেন, এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিষদ সদস্য মাবরুক মোহাম্মদ, নাগরিক ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার, গুম বিষয়ক স্বাধীন কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন, গুমবিষয়ক তদন্ত কমিশনের সদস্য নাবিলা ইদ্রিস, জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ের প্রধান হুমা খান, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) রাজনৈতিক সংগঠক মাইকেল চাকমা, ২০১৭ সালে ধানমন্ডি থেকে নিখোঁজ হওয়া ইশরাক আহমেদের বাবা জামালউদ্দীন আহম্মেদ, ২০১৩ সালে মোহাম্মদপুর থেকে গুমের শিকার হাফেজ জাকিরের ভাই জিয়াউর রহমান, রাজশাহী থেকে গুমের শিকার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মহিদুলের ভাই শহীদুল ইসলাম, রাজশাহী থেকে গুম হওয়া গোলাম মর্তুজা, ২০২৩ সালে ধামরাই থেকে গুম হওয়া রহমত উল্লাহ, ২০১৪ সালে রংপুর থেকে গুম হওয়া আবদুল বাসেত, ২০১৪ সালে নীলফামারী থেকে গুমের শিকার আতিকুর রহমানের ভাই আশিকুর রহমান প্রমুখ। ২০১৫ সালে গুমের শিকার হন মো. আল আমিন ও জেসমিন নাহার দম্পতি। তাঁরাও এই আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে তাদের ওপর হওয়া নির্যাতনের বর্ণনা দেন। আলোচনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি ও মানবাধিকার সংগঠনের নেতারাও অংশ নেন।
আলোচনা সভায় ধারণাপত্র পাঠ করেন এইচআরএসএসের নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম এবং সাত দফা দাবি উপস্থাপন করেন সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। এসময় সংগঠনটি তাদের সাত দফা দাবি তুলে ধরে। সংগঠনটির প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে, গুম হওয়া ব্যক্তির অবস্থান দ্রুত পরিবারের সদস্যদের জানানো, প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা, প্রমাণ সংরক্ষণ ও ভুক্তভোগী ও সাক্ষীদের সুরক্ষা, গুম তদন্তে গঠিত স্বাধীন কমিশনকে স্থায়ী ও কার্যকর করা। এছাড়া ভুক্তভোগী পরিবারকে আইনি, আর্থিক ও মানসিক সহায়তা দেয়া, ভুক্তভোগীদের ব্যাংক হিসাব ও সম্পদ ব্যবহারের সুযোগ নিশ্চিত করা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রাজনৈতিক দলের সদস্যদের মানবাধিকার বিষয়ক নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেয়ার দাবি জানানো হয়। এইচআরএসএস পাঠ্যপুস্তক ও গণমাধ্যমে মানবাধিকার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির ওপরও গুরুত্ব দেয়।
আলোচনা সভায় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এহসানুল মাহবুব জোবায়ের বলেন, গুমের প্রকৃত চিত্র খুব অল্পই জনসমক্ষে এসেছে। কোনো সভ্য দেশ ও মানুষ এই ঘটনাপ্রবাহ মেনে নিতে পারে না। জামায়াতে ইসলামী গুমের শিকার ভুক্তভোগী ও পরিবারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে উল্লেখ করে এহসানুল মাহবুব বলেন, গুমের শিকার ব্যক্তিদের আইনি, আর্থিক ও সামাজিক সহায়তার পাশাপাশি এই সংস্কৃতি যেন আর ফিরে না আসে, তা নিশ্চিতে কাজ করবেন তাঁরা।
আলোচনায় কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন বলেন, গুম সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে এবং এই ধরনের মানসিকতা বদলাতে হবে। এইচআরএসএসের উপদেষ্টা মো. নূর খান বলেন, গুম কমিশন কিছু কাজ করছে, যা শিগগির প্রতিফলিত হবে। তবে মনস্তাত্ত্বিক যে ফ্যাসিজম আছে, সেটাও বিলুপ্ত করতে হবে।
মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার সারা হোসেন রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান, তারা যেন গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, মিথ্যা মামলা ও বিনা বিচারে আটক বন্ধের অঙ্গীকার করেন। তিনি বলেন, ‘ন্যায়বিচার যদি সঠিক না হয় তবে তা নতুন অন্যায়ের জন্ম দেবে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ের প্রধান হুমা খান বলেন, ‘পরিবারগুলোর কষ্ট লাঘব, মিথ্যা মামলা সমাধান এবং খসড়া আইন নিয়ে ব্যাপক পরামর্শ জরুরি।’ তিনি সতর্ক করেন তাড়াহুড়ো করে আইন করলে কিংবা শুধু কঠোর শাস্তির ওপর নির্ভর করলে তা কার্যকর হবে না, নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা ছাড়া সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
অন্তর্বর্তী সরকার গুমের ঘটনার বিচার করবে এমন প্রত্যাশা ছিল বলে মন্তব্য করেছেন গুমের শিকার হওয়া ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) রাজনৈতিক সংগঠক মাইকেল চাকমা। তিনি বলেছেন, কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পেরোনোর পর এই বিচার আর হবে কি না, তা নিয়ে তাদের সংশয় আছে।
তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় গোপনে চোখ খুলে গুমকারীদের পরিচয় র্যাব-১৩ বলে জানতে পেরেছিলেন জেসমিন নাহার। তিনি বলেন, র্যাব সদস্যরা বিষয়টি দেখে ফেলে। এ কারণে শাস্তি হিসেবে তাকে প্রতিদিন দুই বেলা মারধর করা হতো। শরীরে ব্লেড দিয়ে কেটে লবণ লাগানো হতো, ঊরুতে এখনো সেই দাগ আছে। কোনো নারী দেখতে চাইলে তিনি সেই দাগ দেখিয়ে প্রমাণ দিতে পারবেন জানিয়ে বলেন, এখনো কোনো বিচার পাইনি। উল্টো আগের স্বৈরাচারদের কাছ থেকে হুমকি পাচ্ছি।
গুমের শিকার ব্যক্তিদের এখনো জবাব দেওয়ার মতো কিছু করা যায়নি বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর এস এম মঈনুল করিম। তিনি বলেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে, যাতে এই সংস্কৃতি আর কখনো ফিরে না আসে।
আগামী নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে, তা নিয়ে দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে নানা তৎপরতা দেখা যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম। আরিফুল ইসলাম বলেন, তাঁরা ডিজিএফআই ও এনএসআই সংস্কার করার কথা বলেছিলেন। যেসব সদস্য গত ১৫ বছরে খুন-গুমের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাঁদের তালিকা করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। কারণ, পুরোনো সেই কাঠামো ঠিক রেখে নির্বাচনে যাওয়া মানে নির্বাচনকে তাঁরা নিজেদের মতো প্রভাবিত করবে। আগামী দিনে ক্ষমতার পালাবদল থেকে রাজনীতির প্রতিটি বিষয় রাজনীতিবিদেরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে উল্লেখ করে আরিফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে বিদেশি কোনো এস্টাবলিশমেন্টের নাক গলানোর চেষ্টা আর বরদাশত করা হবে না।
বিএনপি নেতা-কর্মীরা বিগত সময়ে সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে উল্লেখ করে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন বলেন, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে যদি বিএনপি সরকার গঠন করে, তাহলে মানবাধিকার, আইনের শাসন ও বাক্স্বাধীনতা নিশ্চিত করেই দেশ পরিচালনা করবে। বিএনপি শহীদ ও গুম হওয়া পরিবারকে আর্থিক ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দেবে। পাশাপাশি ভুক্তভোগীদের নামে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করবে বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর এস এম মঈনুল করিম মনে করেন, গুমের শিকারদের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা এখনও নেওয়া হয়নি; অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া জরুরি। সভায় আরও বক্তব্য দেন মানবাধিকার কর্মী, নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা। তাদের অভিন্ন দাবি, গুমের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের নিশ্চয়তা ছাড়া দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও নাগরিক নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।