জুলাই গণহত্যা নিয়ে জাতিসংঘের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের পর হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে ভারতের ওপর নতুন করে চাপ তৈরি হয়েছে। এবার বিমসটেক সম্মেলনে অনুষ্ঠানিকভাবে বৈঠক করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাইলো প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের পর শেখ হাসিনা ইস্যুতে নিশ্চিতভাবে কূটনৈতিক চাপে পড়বে দিল্লী, এমটাই বলছেন কূটনীতিকরা। জাতিসংঘের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের পর সবাই একবাক্যে বলেছেন শেখ হাসিনা অপরাধী, অপরাধীকে ভারত আশ্রয় দিতে পারে না। এমনকি ভারতের বুদ্ধিজীবীরাও বলেছে শেখ হাসিনার জন্য আমরা কেন খেসারত দিবো। আগামী দিনে ভারতের ওপর এ চাপ অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকবে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা। কারণ সব আলোচনার অবসান ঘটিয়ে ব্যাংককে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাফ জানিয়ে দিলেন, শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে হবে। শেখ হাসিনা গণহত্যায় অভিযুক্ত আসামি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়ার বিষয়টিকে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সক্ষমতা হিসেবেই দেখছেন আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এদিকে জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর হাসিনা সমর্থকদের হাসিনাকে সমর্থন দেওয়ার সুযোগ অনেকটাই সংকীর্ণ হয়ে গেছে। শেখ হাসিনা সম্পর্কে এ রায় যদি বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে আসত, তাহলে বলার সুযোগ থাকত এই রায় বিদ্বেষ ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপ্রসূত। এখন জাতিসংঘের প্রতিবেদনের পর অন্য কিছু বলার সুযোগ নেই। শেখ হাসিনাকে বিশ্বস্বীকৃত সংস্থা জাতিসংঘ অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে এবং নিশ্চিতভাবেই কাজটি করেছে। শেখ হাসিনাকে জাতিসংঘ কর্তৃক খুনি হিসাবে চিহ্নিত করার পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, আমরা শেখ হাসিনা এবং তার সহযোগীদের ফিরিয়ে এনে গণহত্যার দায়ে বিচার করব। অর্থাৎ ভারতকে এখন বিচারের জন্য হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে হবে।

আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, শেখ হাসিনাকে ভারত ফেরত পাঠাবে কিনা, তা ভবিষ্যতের বিষয়। কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূস শেখ হাসিনাসহ ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় অন্যান্য ইস্যু যেভাবে তুলে ধরেছেন, তা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে এক ইতিবাচক অর্জন। বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. আতাউর রহমান ইউনূস-মোদি বৈঠক সম্পর্কে গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমি এই বৈঠককে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি। বেইজিংয়ে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে ফলপ্রসূ বৈঠকের এক সপ্তাহের মধ্যেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ড. ইউনূসের এই বৈঠক বাংলাদেশের কূটনৈতিক সক্ষমতারই প্রমাণ বহন করে। এই বৈঠকের মাধ্যমে ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার কূটনৈতিক দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশ এখন এই অঞ্চলের অন্যতম খেলোয়াড়, যা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেখিয়ে দিয়েছেন।

প্রফেসর আতাউর রহমানের মতো ইউনূস-মোদি বৈঠককে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ড. এম শহীদুজ্জামান। তিনি দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, এই বৈঠকের মাধ্যমে ঢাকা-দিল্লী সম্পর্কের উন্নয়নে খুব বেশি ভূমিকা রাখবে না। শেখ হাসিনার পতনের পর ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে যে ধরনের বৈরী আচরণ করে আসছে, তা ইতিবাচক পদক্ষেপ নয়। ড. এম শহীদুজ্জামান বলেন, আমরা জানি, এই মুহূর্তে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে দিল্লীর কোনো ইচ্ছা নেই। ভারত তার স্বার্থে শেখ হাসিনাকে আগামী দিনে ব্যবহার করবে। এবং এই বিষয়ে ভারত আনুষ্ঠানিক বক্তব্যও দিয়েছে। প্রত্যাবর্তন চুক্তি সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা ভারত তাদের নিজের মতো করে দিবে। ফলে প্রত্যাবর্তন চুক্তি অনুযায়ী শেখ হাসিনাকে ভারত ফিরত দিবে বলে মনে হয় না। তিনি আরও বলেন, ভারত ওয়াকফ বিল আইন আকারে পাশ করে মুসলমানদের সম্পত্তি দখল করবে। ইতিমরেধ্য মুসলমানদের কবরস্থানে একজন মুসলমানকে কবর দিতে উগ্র আরএসএস বাঁধা দিয়েছে। এতে করে বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করবে এটাই স্বাভাবিক। গত আট মাসের ভারতের কার্যক্রমে বুঝা যাচ্ছে বাংলাদেশের সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করতে ভারতের আগ্রহ কম।

ভারত সরাসরি একটা চাপের মধ্যে পড়লো শেখ হাসিনাকে নিয়ে বলে মন্তব্য করেছেন সাংবাদিক ও উপস্থাপিকা নবনীতা চৌধুরী। তার ইউটিউব চ্যানেল “নবনীতার বয়ান” নামক অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ড. মোহাম্মদ ইউনূস ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে বৈঠকে শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের কথা বলেছেন। সেই সাথে মনে করিয়ে দিয়েছেন ডিসেম্বরেই হাসিনাকে ফেরাতে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয়া হয়েছিল ভারতকে এবং ভারত এখন পর্যন্ত তার কোন উত্তর দেয়নি। আমার মনে হয়, ভারত বড় ধরনের একটা চাপের মুখে পড়েছে শেখ হাসিনাকে নিয়ে। শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেয়া প্রসঙ্গে বড় ধরনের চাপের মুখে পড়লো ভারত এই বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা সরাসরি এই কথা তোলায়।

রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে মিডিয়া ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে সে দেশে চাপ বাড়ছে। প্রেস সচিব বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য তাকে (শেখ হাসিনা) দেশে এনে বিচার করা। কিছুদিন আগে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তাতে স্পষ্ট যে কী ধরনের অপরাধ তিনি করেছেন। তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনেছে তারা।

এটা খুবই বড় ও ভয়ংকর ধরনের অপরাধ। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। এই রিপোর্ট ও অন্যান্য কিছু মানবাধিকারবিষয়ক রিপোর্টের পর প্রচুর চাপ তৈরি হয়েছে। এর একটা ইঙ্গিত আছে ইন্ডিয়া টুডের একটা জরিপে। সেখানে দেখা গেছে, ৫৫ শতাংশ চান তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হোক। আবার একটা অংশ চান তাকে অন্য কোনো দেশে পাঠানো হোক। মাত্র ১৬-১৭ শতাংশ ভারতীয় চায় শেখ হাসিনাকে তাদের দেশে রাখতে, বলেন তিনি। শফিকুল আলম বলেন, তিনি (শেখ হাসিনা) গত ১৫-১৬ বছরে যে নৃশংস স্বৈরাচারী ব্যবস্থা চালিয়েছেন, এটা স্পষ্টভাবে এসেছে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে। আমার মনে হয় এখন চাপ আরও হবে। আমরা তাকে ফেরত চেয়ে ভারতকে একটা চিঠি দিয়েছি। চাপটা অব্যাহত থাকবে।