সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত জাতীয় সংলাপে দেশের বিশিষ্টজনরা অভিযোগ করে বলেছেন, স্বৈরাচারী ব্যবস্থা শেখ হাসিনাকে দানবে পরিণত করেছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠতার নিপীড়নের কারণে তিনি দানবে পরিণত হন। এই যে দানবে যাতে পরিণত না হন, এর প্রতিষেধক হিসেবে বা এটা ঠেকানোর জন্য উচ্চকক্ষ দরকার। উচ্চকক্ষের মাধ্যমে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স সৃষ্টি হতে পারে।

গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে আয়োজিত জাতীয় সংলাপে এসব অভিমত ব্যক্ত করেন বিশিষ্টজনরা। প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষ কি জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারবে?’ শীর্ষক সংলাপের আয়োজন করে সিপিডি। গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালনক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর নিজাম আহমেদ।

সংলাপে বাংলাদেশে সংসদীয় জবাবদিহি ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করতে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নতুন প্রস্তাব দিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি মনে করে, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বাস্তবসম্মত নয়। বরং বিদ্যমান এককক্ষবিশিষ্ট সংসদ ব্যবস্থাকেই আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে শক্তিশালী করা উচিত।

সংলাপে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, শেখ হাসিনা কিন্তু উর্দি পরে ক্ষমতায় আসেননি এবং শেখ হাসিনা এসে কিন্তু সংবিধানও বাতিল করেননি। শেখ হাসিনা নির্বাচনের মাধ্যমে এসেছেন, যদিও নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন আছে। কিন্তু শেখ হাসিনা কীভাবে স্বৈরাচারে পরিণত হলেন, কীভাবে দানবে পরিণত হলেন? কারণ, স্বৈরাচারী ব্যবস্থাই তাকে দানবে পরিণত করেছে।

তিনি বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতার নিপীড়নের কারণে শেখ হাসিনা দানবে পরিণত হয়েছেন। এই যে দানবে যাতে পরিণত না হন, এর প্রতিষেধক হিসেবে বা এটা ঠেকানোর জন্য উচ্চকক্ষ দরকার। উচ্চকক্ষের মাধ্যমে চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স সৃষ্টি হতে পারে।

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতার নিপীড়নের কারণে শেখ হাসিনা দানবে পরিণত হয়েছেন। এই যে দানবে যাতে পরিণত না হন, তার প্রতিষেধক হিসেবে বা এটি ঠেকানোর জন্য উচ্চকক্ষ প্রয়োজন। উচ্চকক্ষের মাধ্যমে চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স সৃষ্টি হতে পারে। যে কোনো আইন পাস হলে তা উচ্চকক্ষে যাবে এবং এ নিয়ে উচ্চকক্ষের একটি বক্তব্য থাকবে, যার ফলে আমাদের দেশে অনেকগুলো নিবর্তনমূলক আইন হয়তো আরও মডারেটেড হতো। অনেক সময় নিম্নকক্ষে আবেগ এবং প্রতিহিংসাপরায়ণতার কারণে আইন প্রণীত হয়। কিন্তু উচ্চকক্ষে গেলে তা মডারেটেড হতে পারে এবং উচ্চকক্ষ এটাকে ঠেকাতে পারে। নিম্নকক্ষের কাছে মূল ক্ষমতা আইন প্রণয়নে রয়েছে এবং উচ্চকক্ষের কোনো ক্ষমতা নেই আইন প্রণয়ন ও আইন প্রস্তাব করার।

তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় কথা হলো শেখ হাসিনা দানবে পরিণত হয়েছেন, পঞ্চদশ সংশোধনী এবং এর মাধ্যমে তিনি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করেছেন। যে সরকার যখন ক্ষমতায় থাকবে, সেই সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে এবং তার পরিণতি কী হয়েছে, সেটা আমরা দেখেছি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পর সবগুলো নির্বাচনই জালিয়াতি নির্বাচন হয়েছে, না হয় একতরফা বা বিতর্কিত নির্বাচন হয়েছে। উচ্চকক্ষ যদি থাকত, তাহলে শেখ হাসিনার পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা সম্ভব হতো না।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান জানান, কতগুলো দল প্রস্তাব করেছে উচ্চকক্ষ আসনের অনুপাতে হবে। তাহলে উচ্চকক্ষ হবে নিম্নকক্ষের একটি ডুপ্লিকেট, যা অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু নিম্নকক্ষ যদি ভোটের অনুপাতে হয়, তাহলে উচ্চকক্ষ বাধা দিতে পারবে। এটা হলে একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি হবে। যার জন্য রাজনৈতিক দলগুলিকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করতে হবে এবং সংবিধান সংশোধনের খাতিরে এটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পিআর পদ্ধতি হলে এটি একটি চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স তৈরি করবে।

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আজ বলা হচ্ছে, আমরা নির্বাচন চাই। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। দুর্ভাগ্যবশত, জনগণের প্রতিনিধিরা যদি দুর্বৃত্ত হন, তাহলে তো সেই একই, পুরোনো জিনিসের পুনরাবৃত্তি হবে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলাতে হবে। এসব নিয়ম-কানুন বদলানো দরকার, যাতে কাঠামো ঠিক হয়। রাজনৈতিক সংস্কৃতি না বদলালে কোনো কিছু কাজ করবে না।

ইইউর রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার বলেন, গত ১৪ মাসে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচিত সংসদ নেই। ইইউ নতুন সংসদ গঠনে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের দক্ষতাসহ কিছু সহযোগিতা করে যাচ্ছে। স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। নাগরিক সমাজ ও বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারসহ সাধারণ নাগরিকদের মতামত জরুরি। আমি বলতে চাই, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আপনাদের নিজস্ব বিষয়। তবে আমি চাই, বাংলাদেশ অনেক অর্জন করুক। ইইউ বাংলাদেশকে সমর্থনে সবসময় পাশে থাকবে।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, আমরা বাংলাদেশের বাস্তবতায় উচ্চকক্ষের প্রয়োজন মনে করি না। বাংলাদেশের জন্য কতটুকু প্রয়োজন, সেটা ভেবে দেখা দরকার। নিম্নকক্ষ যেটা আছে, সেটাকে কীভাবে শক্তিশালী করা যায় এবং স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার বিষয় নিয়ে আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ। গরিবের টাকায় শ্বেত হস্তি ও নতুন করে জমিদার পালা ছাড়া আমার কাছে অন্য কিছু মনে হয় না।

সিপিডির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সংবিধান ও নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবিত বেশ কিছু সংস্কার ধারণা যেমন, বাইক্যামেরালিজম, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব, দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তি বা নিয়োগ কমিটি গঠন নীতিগতভাবে আকর্ষণীয় হলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় এসব কার্যকর নয়।

গবেষণায় বলা হয়, দীর্ঘদিনের দলীয় আনুগত্য, পৃষ্ঠপোষকতা এবং ‘বিজয়ী সব পায়’ রাজনীতির সংস্কৃতিতে এসব প্রস্তাব কার্যত প্রতীকী হয়ে থাকে। এতে জবাবদিহি বা ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার বদলে রাজনৈতিক অচলাবস্থা, প্রভাব বিস্তার ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ আরও বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।

সিপিডি মনে করে, কাঠামোগত ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ছাড়া শুধু প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার কার্যকর জবাবদিহি আনতে পারবে না। তাই উপরের কক্ষ গঠন না করে বিদ্যমান সংসদকেই কার্যকর করার ওপর জোর দিতে হবে।

সিপিডি সংসদীয় ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে কয়েকটি বাস্তবধর্মী পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলোতে বিরোধীদলীয় এমপিদের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ, রাজনৈতিক দলের তহবিল সংগ্রহ ও ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, স্থানীয় সরকারকে আর্থিকভাবে আরও স্বনির্ভর করা, স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং দলত্যাগ রোধে আইনি সংস্কার।

সিপিডি মনে করে, শাসক দল যেন নির্বাহী দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারে, এজন্য গুরুত্বপূর্ণ ও সাংবিধানিক পদে সরকারের নিয়োগের ক্ষমতা থাকা উচিত। তবে এসব নিয়োগ সংসদীয় পর্যালোচনা কমিটির মাধ্যমে পুনর্বিবেচনার সুযোগ রাখতে হবে।

গবেষণায় আরও বলা হয়, সংসদের আগে ও পরে আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় পরামর্শ ও মূল্যায়নের জন্য একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘গণতন্ত্রের মাধ্যমে আইনবিষয়ক ইউরোপীয় কমিশনের’ আদলে এ কমিশনের নাম হতে পারে ‘গণতন্ত্র, আইন প্রণয়ন, নির্বাহী ও আইনবিষয়ক সংসদীয় কমিশন’। এই কমিশন সংবিধান, আইন ও প্রশাসনিক নীতিমালা শক্তিশালী করা, নাগরিক অধিকার সুরক্ষা এবং স্থানীয় সরকারকে গণতান্ত্রিকভাবে বিকশিত করার কাজ করবে বলে সিপিডির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠানে ইইউ রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব আখতার হোসেন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বক্তব্য রাখেন।