বর্তমান আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে অতীতের গতানুগতিক ধারার রাজনীতি নতুন প্রজন্মের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের পছন্দ আদর্শবান ও সৎ নেতৃত্ব। প্রযুক্তির যুগে মিথ্যা ও প্রতারণা যেমনিভাবে সহজেই ধরা পড়ে, ঠিক তেমনি সত্য ও সঠিক আদর্শের বিষয়টিও তারা বুঝতে পারে। আর মানুষের ভালোবাসা পেতে হলে ভালো মনের মানুষ হতে হয় এবং ভালো ব্যবহার দিয়ে যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়। আর এ প্রমাণই দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেড জেনারেশনের শিক্ষার্থীরা। এই জেন জি প্রজন্মের তরুণরাই আন্দোলনের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের ফ্যাসিবাদকে বিদায় দিয়েছে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ফ্যাসিবাদ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়েছিল এবং তারা এ জাতির জন্য বিজয় এনে দিয়েছে। ডাকসু নির্বাচনের মাধ্যমে আবার প্রমাণ হলো নতুন প্রজন্মের এই জেনারেশন এখনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে ও ন্যায়ের পক্ষে ঐক্যবদ্ধই আছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনেও নতুন প্রজন্মের পছন্দের সৎ, ন্যায় ও যোগ্য লোকদের সরকার গঠনে তারা ভূমিকা পালন করবে।
মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ভিপি-জিএস, এজিএসসহ ২৮টি পদে ২৩টিতেই বিজয়ী হয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের প্রার্থীরা। ভিপি পদে ছাত্রশিবির প্যানেলের মো. আবু সাদিক (সাদিক কায়েম) পেয়েছেন ১৪ হাজার ৪২ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের আবিদুল ইসলাম খান ৫ হাজার ৭০৮ ভোট পেয়েছেন। ১০ হাজার ৭৯৪ ভোট পেয়ে জয়ী হন এসএম ফরহাদ। তিনিও ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট থেকে লড়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল নেতা তানভীর বারী হামীম পেয়েছেন ৫ হাজার ২৮৩ ভোট। এ ছাড়া প্রতিরোধ পর্ষদের মেঘমল্লার বসু ৪ হাজার ৯৪৯ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন। এজিএস পদেও বিজয়ী হন ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের মুহা. মহিউদ্দীন খান। তিনি ১১ হাজার ৭৭২ ভোট পেয়েছেন। ছাত্রদলের এজিএস প্রার্থী তানভীর আল হাদী মায়েদ পেয়েছেন ৫ হাজার ৬৪ ভোট।
ফলাফল বিশ্লেষনে দেখা যায়, ভিপি, জিএস ও এজিএস সরাসরি ছাত্রশিবির থেকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। তাদের প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধানও অনেক বেশি। সাধারণ শিক্ষার্থীরা জেনে বুঝেই ছাত্রশিবিরকে বিজয়ী করেছেন। ১৯৭৭ সালে ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জন্ম হয়েছে ছাত্র শিবিরের। তাদের আদর্শে শিক্ষার্থীরা যাতে উজ্জীবিত না হতে পারে এ জন্য দীর্ঘ দিন কায়েমী স্বার্থবাদীরা নানা ধরনের অপপ্রচার চালিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির করতে নিরুৎসাহিত করতো। এমন কী স্বাধীনতার ৬ বছর পর ছাত্র শিবিরের জন্ম হলেও তাদেরকে রাজাকার ট্যাগ দিয়ে অপবাদ দেয়া হতো। এর বাইরে তাদের বিরুদ্ধে আর কোন ধরনের অভিযোগ আনতে পারেনি। তবে কায়েমী স্বার্থবাদী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন, ভর্তি নিয়ে জালিয়াতি, চাঁদাবাজি, মাস্তানি ও নারী নির্যাতনসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। তাদের নির্যাতনের সাধারণ শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে অতীষ্ট ছিল। গত বছর ছাত্র-জনতার জুলাই আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র শিবিরের নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে শিক্ষার্থীরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। ছাত্রশিবিরের কাছে এসে তাদের আদর্শ, সততা, ন্যায় পরায়নতা, অমায়িক ব্যবহার এবং স্বার্থহীন রাজনীতি দেখে শিক্ষার্থীরা মুগ্ধ হয়েছে। অবশেষে ডাকসুর নির্বাচনে শিবিরের নেতৃত্বে অন্যান্য সংগঠনগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে শিক্ষার্থী জোটের ব্যানারে প্যানেল দিয়েছে। প্যানেল দেয়ার সময়ই তাদের অনেকটা বিজয় অর্জন হয়েছে। অবশেষে নির্বাচনের শিক্ষার্থীরাও বিপুল সমর্থন দিয়ে আবারো প্রমাণ করেছে তারা অন্যায় ও জুলুমের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। শুধু শিক্ষাঙ্গন নয় দেশের রাজনীতিতেও তারা বড় ধরনের ভূমিকা পালন করবে।
ডাকসু নির্বাচনের অন্যান্য ফলাফলে দেখা যায় অন্যায় আরও ২০ পদে বিজয় লাভ করেছেন ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের প্রার্থীরা। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক ফাতেমা তাসনিম জুমা পেয়েছেন ১০ হাজার ৬৩১ ভোট। ৭ হাজার ৮৩৩ ভোট পেয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক পদে জয়ী হন ইকবাল হায়দার। আন্তর্জাতিক সম্পাদক পদে খান জসিম পেয়েছেন ৯ হাজার ৭০৬ ভোট। ছাত্র পরিবহন সম্পাদক হিসেবে লড়ে আসিফ আবদুল্লাহ পেয়েছেন ৯ হাজার ৬১ ভোট। ৭ হাজার ২৫৫ ভোট পেয়ে ক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন আরমান হোসাইন। কমন রুম, রিডিং রুম ও কাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে উম্মে ছালমা পেয়েছেন ৯ হাজার ৯২০ ভোট। ১১ হাজার ৭৪৭ ভোট পেয়ে মানবাধিকার ও আইন সম্পাদক হন সাখাওয়াত জাকারিয়া। স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পাদক পদে এমএম আল মিনহাজ পেয়েছেন ৭ হাজার ৩৮ ভোট। এছাড়া ৯ হাজার ৩৪৪ ভোট পেয়ে ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট সম্পাদক বিজয় ছিনিয়ে আনেন মাজহারুল ইসলাম। ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট থেকে সদস্য হিসেবে বিজয়ী হয়েছেন সাবিকুন্নাহার তামান্না (১০ হাজার ৪৮ ভোট), সর্বমিত্র (৮ হাজার ৯৮৮ ভোট), আনাস ইবনে মুনির (৫ হাজার ১৫ ভোট), ইমরান হোসেন (৬ হাজার ২৫৬), তাজিনুর রহমান (৫ হাজার ৬৯০), মেফতাহুল হোসেন আল মারুফ (৫ হাজার ১৫), বেলাল হোসাইন অপু খান (৪ হাজার ৮৬৫), রাইসুল ইসলাম (৪ হাজার ৫৩৫), মো. শাহিনুর রহমান (৪ হাজার ৩৯০), মোছা. আফসানা আক্তার (৫ হাজার ৭৪৭) ও রায়হান উদ্দীন (৫ হাজার ৮২ ভোট)। প্যানেলের বাইরে বাকি পাঁচ পদে জয়ী হয়েছেন অন্য প্রার্থীরা। তারা হলেন, সমাজসেবা সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী যুবাইর বিন নেছারী। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী মুসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ। গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী সানজিদা আহমেদ তন্বী। সদস্য পদে হেমা চাকমা ও উম্মা উসউয়াতুন রাফিয়া।
এবার ডাকসুতে ২৮টি পদের বিপরীতে প্রার্থী ছিলেন ৪৭১ জন। আর ১৮টি হল সংসদে নির্বাচন হয়েছে ১৩টি পদে। হল সংসদের ২৩৪টি পদের বিপরীতে প্রার্থী ছিলেন ১ হাজার ৩৫ জন। ডাকসুতে এবার মোট ভোটার ছিলেন ৩৯ হাজার ৮৭৪। এর মধ্যে পাঁচটি ছাত্রী হলে ১৮ হাজার ৯৫৯ আর ১৩টি ছাত্র হলে ভোটার ২০ হাজার ৯১৫ জন ভোটার ছিলেন।