গত ২২ এপ্রিল পেহেলগামে পর্যটকদের ওপর হামলাকে কেন্দ্র করে প্রথমে দোষাদোষি পরে হামলা পাল্টা হামলার ঘটনা আস্তে আস্তে বৈশয়িক রূপ নিচ্ছে। দুই দেশেরই উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে। পারমাণবিক দেশ দুটো কেউ কাউকে ছাড় দিয়ে কথা বলছে না। ফলে হামলা পাল্টা হামলার পরিধি বাড়ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই প্রতিবেশীর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে তার প্রভাব শুধু উপমহাদেশেই নয়, প্রভাব পড়বে বিশ্বজুড়ে। বাদ যাবে না বাংলাদেশও। বিশেষ করে এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। এছাড়া কূটনীতি থেকে শুরু করে আমাদানি রফতানিতেও ব্যাপক প্রভাব পড়বে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা মনে করছেন, পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের প্রভাব শুধু যে চিরশত্রু এ দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। তার প্রমাণ মিলেছে যুদ্ধ শুরুর প্রথম প্রহরেই। পাকিস্তানের আকাশ পথ ব্যবহার করা বাংলাদেশগামী দুইটি বিমান যুদ্ধের রেশে ঢাকায় না এসে ফিরে গেছে। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশকেই যে খেসারত দিতে হবে। ভারত-পাকিস্তানের এই যুদ্ধে প্রতিটি দেশই ক্ষতিগ্রস্থ হবে অর্থনৈতিকসহ বিভিন্নভাবে এমনটিই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইতিমধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনায় কমপক্ষে ২৬ পাকিস্তানী নাগরিক নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে সেদেশের গণমাধ্যম সূত্রে। পাল্টা জবাব দিয়েছে পাকিস্তানও, ভারতের ৫টি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার পাশাপাশি ধ্বংশ করেছে ভারতের ব্রিগেড সদর দপ্তর।
বলা হচ্ছে, ভারতের ওষুধশিল্প এখন বৈশ্বিক বাজারে এক গুরুত্বপূর্ণ জোগানদাতা। তারা সস্তা জেনেরিক ওষুধের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক। ভারত-পাকিস্তান সংঘাত বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপরও বিশাল প্রভাব ফেলবে। কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর থেকেই পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে ভারত-পাকিস্তান। এসব পদক্ষেপের জেরে দু’দেশের উত্তেজনার পারদ এখন তুঙ্গে।
আন্তর্জাতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) ড. মনিরুল ইসলাম আকন্দ মনে করেন, ভারত-পাকিস্তান যতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার চেয়েও বাংলাদেশসহ যারা তাদের প্রতিবেশী হয়ে আছে, বা সারা বিশ্বে এর প্রভাব পড়বে। এটা আমাদের অর্থনীতির ওপর বিশাল প্রভাব ফেলবে। দ্রব্যমূল্যে বেড়ে যাবে। এ মুহূর্তে সামরিক ঝুঁকিতে না থাকলেও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিবেশি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও সমঝোতার চেষ্টা করার তাগিদ দেন তারা। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, আমাদের আশা থাকবে যে, বড় আকারে যুদ্ধে তারা যেন না যায়। বড় আকারে যুদ্ধ গেলে যে সাপ্লাই লাইনগুলো আছে, সেগুলো আরও ব্যাহত হবে। সাপ্লাই (সি লাইন) লাইনগুলো যদি ব্যাহত হয় তাহলে আরও বড় ক্ষতি হবে।
বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ এমনকি মিয়ানমার কেউ বাদ যাবে না পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত-পাকিস্তানসহ বাংলাদেশও চলতি বছরে আর্থিকভাবে বেশ টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে ২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের ফলে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়েছে । এরপর থেকেই দেশের অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তী সরকার। অর্থনীতি এখনো ঠিকভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারলো না এর মধ্যেই প্রতিবেশী ভারত যুদ্ধ বাঁধিয়ে বসলো পাকিস্তানের সাথে। এমনিতেই ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালানোর পর থেকে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক ভালো নেই প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাথে। এর ওপর এই যুদ্ধের ব্যাপক প্রভাবে নতুন করে প্রভাবিত হবে দেশের অর্থনীতি। পাকিস্তানের সাথে বাণিজ্যিকভাবে বাংলাদেশের সম্পর্ক দিন দিন ভালো হচ্ছিলো। তবে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের ফলে সেটিও এখন চরম অনিশ্চয়তায়।
এদিকে ভারত-পকিস্তান যুদ্ধের রেশ পড়েছে আন্তর্জাতিক আকাশপথেও। বাংলাদেশগামী অন্তত দুটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট মাঝ আকাশ থেকে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। এর ফলে যাত্রীদের মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এর মধ্যে একটি বিমান টার্কিশ এয়ারলাইন্সের আর আরেকটি কাতার এয়ারওয়েজের বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। শুধু বাংলাদেশ নয় পাক আকাশপথ ব্যবহার করে থাকে শ্রীলংকা, নেপাল, মালদ্বীপ, ভুটানসহ মিয়ানমারও। প্রতিটি দেশের বিমানখাতই এখন চরম অনিশ্চয়তায়।
এদিকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা চরমে পৌঁছানোর প্রেক্ষাপটে উভয় দেশের প্রতি শান্তিপূর্ণ আলোচনায় ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও তুরষ্ক।
মূলত, ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে সামরিক সংঘাত বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। ফলে ডলারের বিপরীতে রুপির দুর্বলতা ভারতের জ্বালানি আমদানি ব্যয় বাড়িয়ে দিতে পারে ধারণা করছে বিশ্লেষকরা। এই যুদ্ধের ফলে কমে যেতে পারে দেশের রিজার্ভ এমনকি বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্সও।
অপরদিকে ভারত-পাকিস্তান দুই দেশের সাথেই দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশেরই বাণিজ্য সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। পাক-ভারত এই অনাকাক্সিক্ষত যুদ্ধের ফলে আর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে এই অঞ্চলের প্রতিটি দেশ, এমনটিই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই প্রভাবে বাংলাদেশসহ প্রতিটি দেশেরই কমে যেতে পারে রিজার্ভের পরিমাণ। যুদ্ধের কারণে দেশে আসা বন্ধ হয়ে যেতে পারে বৈদেশিক আয়। অন্যদিকে আবার কাশ্মীর হামলার রেশে আগে থেকেই ভারতীয় বিমানের জন্য আকাশ পথ বন্ধ করেছিলো পাকিস্তান। ভারতীয় বিমানগুলোকে তাই দীর্ঘপথ ঘুরে ঘুরে যেতে হচ্ছে গন্তব্যে। ভারতীয় বিমান প্রতিষ্ঠানগুলোও তাই আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতির মুখে। আর যুদ্ধ মানেই তো ক্ষতি, যুদ্ধের জন্য পাক-ভারত দুই দেশেরই খরচ হবে বিপুল পরিমাণ অর্থ, ধ্বংশ হবে ঐতিহাসিক সব স্থাপনা। ভারতের পাকিস্তানে চালানো হামলার পরপরই ভারতীয় মুদ্রার চরম দরপতন হয়েছে।
মূলত কাশ্মীর হামলার প্রতিশোধ নিতে ভারত, পাকিস্তানের মাদরাসা আর মসজিদকে টার্গেট করে ক্ষেপনাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এতে ঘুমন্ত অবস্থায় থাকা সাধারণ মাদ্রাসা শিশু-ছাত্র থেকে নিহত হয়েছেন মসজিদে অবস্থানরত মুসল্লিরাও। নারী থেকে শিশু কাউকেই ছাড় দেয়নি নরেন্দ্র মোদি সরকার।
ইতিমধ্যে নেটদুনিয়ায় নরেন্দ্র মোদির মুসলমানদের ওপর এমন ন্যাক্কারজনক হামলার নিন্দা জানাচ্ছেন বিশ^বাসী। বিশ্বনেতারাও ভারতের এ হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসে দুপক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছেন।