মো:জিসান উদ্দীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী। তিনি সক্রিয় অংশ নেন জুলাই বিপ্লবের আন্দোলনে। তার আন্দোলনের স্থান ছিল উত্তরার বিএনএসের সামনে। তিনি দৈনিক সংগ্রামকে বলেছেন তার আন্দোলনে অংশ নেওয়ার গল্প।
জুলাই বিপ্লব আমাদের সকলের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়েছে। জুলাই বিপ্লব আমার মতে আমাদের ২য় স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। কোটা সংস্কারের দাবিতে আমাদের আন্দোলন শুরু হয়। ১৬ জুলাই থেকে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি।
ওইদিন ক্যাম্পাসের অবস্থা ছিল ভয়াবহ। একপাশে আমরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান নেই অন্যপাশে ছাত্রলীগ টিএসসি তে অবস্থান নেয়। এর পর কয়েক দফায় ধাওয়া পালটা ধাওয়া হয়। আমরা শান্তিপূর্ণ মিছিল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে নিয়ে সলিমুল্লাহ হলের সামনে দিয়ে ভিসি চত্বর আসলে পুলিশের বাধার সম্মুখীন হই।
১৬ জুলাই আবু সাঈদ পুলিশের গুলীতে মারা যাওয়ার পর ১৭ জুলাই ক্যাম্পাসে ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ ভিসির অনুমতিতে আমাদের ওপর গুলী চালায়। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি হলপাড়ায় হামলা চালায়। ক্যাম্পাসে জ্যামার লাগানো হয়। কোন নেটওয়ার্ক নাই। আশেপাশে মানুষের কান্নাকাটি। ওইদিন মনে হয়েছিল ক্যাম্পাস থেকে হয়তো ফেরত যেতে পারব না।
সন্ধ্যায় ক্যাম্পাস থেকে বের হলাম। তখন আরেক ভয়। আশপাশে সব জায়গায় ছাত্রলীগের অস্রসহ অবস্থান। এক রিকশাওয়ালা মামা আমাদের ভেতর দিয়ে যেই জায়গাগুলো সেইফ ওইখান দিয়ে নিয়ে যায়। তখন আমি সায়মন ভাইকে বলতেছিলাম সব কি ভাই শেষ হয়ে গেল ? কারণ ক্যাম্পাস থেকে সবাইকে বের করে দিছে।
এদিন রাতে এসে প্ল্যান করি উত্তারাতে যাবো আন্দোলনে। ১৮ তারিখ উত্তারাতে আন্দোলনে যোগ দেই এলাকা থেকে আরো ১০-১২ জন বন্ধুকে নিয়ে। ওইদিন উত্তারার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। পুলিশ, র্যাব আর ছাত্রলীগের হামলা। বাতাসে শুধু টিয়ার সেলের গন্ধ। ওইদিন আমি হাতে গুলীবিদ্ধ হই। গুলীটা আমার হাত ছুঁয়ে বের হয়ে যায় আর আমার পাশের একজনের বুকে লাগে।
ওদের নিয়ে কুয়েত -মৈত্রী হাসপাতালে যাই। ওইখানে ভয়াবহ অবস্থা ছিল। ওইদিন শুনতে পাই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন উত্তারায় গুলীবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছে। তখনও জানতাম না এদের মধ্যে আমার স্কুলের বন্ধু তানভীনও আছে। এর পর পুলিশের ধাওয়ার মধ্যে পরে যাই। হাত পায়ের চামড়া উঠে যায়। ওই অবস্থায় বন্ধুরা ধরে উত্তরার এক বাসায় নিয়ে যায়। ওইদিন বাসার লোকজন যদি আশ্রয় না দিত তাহলে কি হতো আজ ভাবনায় আসে না। ওইদিন একটাই চিন্তা ছিল যেভাবেই হোক কিছু একটা করতে হবে। এগুলো আর মানা যায় না। এর পরে কয়েকদিন বাইরে যাওয়ার মত শারীরিক অবস্থা ছিল না।
শরীর একটু স্বাভাবিক হওয়ার পর আবার আন্দোলনে যোগ দিলাম। দিন যতই যেতে থাকলো আন্দোলনে ছাত্র-তরুণ এবং কর্মীর সংখ্যা বাড়তে থাকলো। আমাদের মধ্যে আন্দোলনের তীব্রতাও বাড়তে থাকে। ২ আগস্ট আমাদের ৯ দফা দাবি ১ দফায় পরিণত হল। ৩ তারিখ শহীদ মিনারে সবাই একসাথে হলাম। ৪ তারিখ উত্তারা থেকে আন্দেলন শেষে বাসায় এসে "লং মার্চ টু ঢাকা" এর ঘোষণা পেলাম।
৫ তারিখ এলাকা থেকে বের হওয়াই কঠিন। ৪ আগস্ট রাতে অনেকের সাথে ফোনে কথা হল কিন্তু সকালে বের হওয়ার সময় আমরা ৩ জন ছিলাম। শরীরে জ্বর তা নিয়ে রওনা দিলাম লং মার্চে। উত্তরা থেকে মিছিলে অংশ নিলাম। বিএনএস এর সামনে সেনাবাহিনী আমাদের প্রথমে বাধা দেয়। আমি আর আমার বন্ধু নয়ন জাতীয় পতাকা নিয়ে সামনে যেতে থাকি। সামনে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর সেনাবাহিনী আমাদের পথ ছেড়ে দেয়। তখন মনে হচ্ছিল আমরা পেরেছি, স্বৈরাচারের পতন করতে পেরেছি। এর পর বনানী যেতে যেতে লাখ লাখ মানুষ আমাদের সাথে যোগ দিল। ওই সময় আমার মধ্যে যে অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল তা কাগজে কলমে লিখে প্রকাশ করার মত না!
দেখলাম চারদিক দিয়ে মানুষ গণভবনের দিকে যাচ্ছে। একটুপরই জানলাম ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছে। সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিবে। আমরা আমাদের ১ দফা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সফল হলাম। ফ্যাসিস্টমুক্ত নতুন বাংলাদেশ পেলাম।