প্রিয় পাঠক আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে জুলাই আন্দোলনে পানি লাগবে? পানি.. ? বলে ভাইরাল হওয়া মীর মুগ্ধের কথা। পানি বিতরণের কিছুক্ষণ পর আইনশৃঙ্খলা-বাহিনীর গুলীতে শহীদ হন মীর মুগ্ধ। ওই সময়টা তার পাশেই ছিলেন বাল্য বন্ধু এবং সব সময় পাশে থাকা প্রিয় মানুষ মাইদুর রহমান আশিক। দৈনিক সংগ্রামকে শুনিয়েছেন সেদিনের গল্প। লিখেছেন ইবরাহীম খলিল।
দৈনিক সংগ্রাম : আশিক সাহেব আপনি উত্তরাতে পানি লাগবে, পানি লাগবে ভাইরাল হওয়া মীর মুগ্ধের বাল্য সাথী ছিলেন। আপনি যদি সেদিনগুলোর কথা বলেন যে আপনাদের সময় গুলো কেমন কাটতো।
মাইদুর রহমান আশিক : আমাদের শুরুটা আসলে স্কুল জীবন থেকে। উত্তরা হাইস্কুল থেকে। আমরা একসাথে স্কুলে বসতাম। কলেজে এক সার্কেলে ছিলাম। আমরা ফুটবল খেলেছি সকাল বেলা একসাথে। স্কুল শুরু হওয়ার আগে খেলতাম। টিফিন টাইমে খেলতাম। স্কুলের ক্লাসও একসাথে করতাম। বলতে গেলে সবকিছু একসাথে ছিল। স্কুল থেকে সবাই একসাথে এসএসসি শেষ করে আমাদের কলেজ আলাদা হয়ে যায়। মুগ্ধ উত্তরা স্কুল এন্ড কলেজেই থাকে। আমি চলে যাই বঙ্গবনধু কলেজে। কলেজ বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আলাদা হলেও আমরা একসাথেই বসতাম। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরও আমরা একসাথেই ছিলাম।
দৈনিক সংগ্রাম : জুলাইয়ের আন্দোলনে আপনারা কিভাবে জড়ালেন ?
মাইদুর রহমান আশিক : আমরা যেহেতু এক সার্কেলে ছিলাম। তাই আমরা সার্কেলের মাধ্যমেই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হই। আমাদের মেসেঞ্জার গ্রুপ ছিল আগে থেকেই। আন্দোলন দেখে আমরা এ সম্পর্কে জানতাম এবং নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হওয়ার পর আমাদের মধ্যে আলোচনাটা জোড়ালো হয়। শিক্ষার্থীদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার ভিডিও আমাদের বেশি নাড়া দেয়। আমরা আলোচনা করি যে একটা স্বাধীন দেশে যৌক্তিক আন্দোলনের ওপর এভাবে হামলা হবে এটা হতে পারে না। এই ভিডিওটা আপলোড করে আমাদের গ্রুপের রাহাত। এই ঘটনায় আমরা বিরক্ত ছিলাম। সিদ্ধান্ত নেই আমরা আন্দোলনে যোগদান করবো।
দৈনিক সংগ্রাম : আন্দোলনে যোগ দিলেন কবে ?
মাইদুর রহমান আশিক : আমরা দেখলাম ১৬ তারিখ শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছে। এদিন মুগ্ধর জমজ ভাই স্নিগ্ধ বাইক অ্যাক্সিডেন্ট করে। ১৭ তারিখ রাতে সিদ্ধান্ত হয়, আমি প্রস্তুাব করি আগামিকাল ১৮ তারিখ আমরা মাঠে নামবো। আমি অফিসে ছিলাম, তখন সাড়ে ১২টায় আমাকে মুগ্ধ কল দেয়। বলে দোস্ত কই তুই। আমাদেরতো আন্দোলনে যাওয়ার কথা। আমি বললাম খাওয়া দাওয়া হয়নি। অফিসিয়াল ড্রেসে আছি। মুগ্ধ বলে উত্তরার দিকে খুব বাজে অবস্থা। সেদিন র্যাবের সাথে ছাত্রদের একটা সংঘর্ষ হয়। হাউস বিল্ডিংয়ের নিচে সেদিন র্যাব গাড়ি চাপা দিয়ে বেশ কয়েকজনকে হত্যা করে। সেই ছবিগুলো পাঠায় এবং বলে এরকমের একটা ঘটনা ঘটেছে। আমাকে তার বাসায় গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করতে বলে। আমি তার বাসায় যাই। আসার পথে জসিম উদ্দিনে দেখতে পাই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের সাথে সংঘর্ষ লাগবে লাগবে অবস্থা। আমি সেক্টরে ভেতর দিয়ে চলে যাই। সেখানে খাওয়া দাওয়া করি। পরে মুগ্ধ একটা প্যান্ট দিলো পরার জন্য। আমি লম্বা বলে তাদের প্যান্ট আমার পরনে হবে কি না তা নিয়ে রীতিমত মজা হলো আমার সাথে। আমরা বের হলাম দু’জন রিকশায় করে। বললাম এমন এক দেশে বাস করছি আমাদের স্বাধীনতা কোথায় ? মুগ্ধ বলতে ছিল আজ আমি হলে থাকলে দেখতাম পুলিশ কিভাবে হলে ঢুকে। এমন আলোচনা করতে করতে আমরা আজমপুরে চলে যাই। সেখানে ক্রিসেন্ট হাসপাতালের অপরপ্রান্তে রিকশা থেকে নামি। আমরা দেখলাম প্রচন্ড শব্দ হচ্ছে। সাউন্ড গ্রানেড, গুলীর শব্দ, স্পিন্টার, টিয়ার সেল ফাটায় পুলিশ। টিয়ার সেল থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য কেউ কেউ আগুন জ¦ালিয়ে রাখতে দেখি। আমরা বলি দেখ এলাকাটা একটা ওয়ার জোনে পরিণত হয়েছে। রিকশা থেকে নেমেই দেখি মেইন রাস্তা থেকে দৌড়ে নিয়ে আসে। দেখি শিক্ষার্থীরা প্রচন্ডভাবে আহত। কারো মুখে স্পিন্টার লেগে পুরো মুখ রক্তে লাল হয়ে আছে। পিঠ ঝাঝরা হয়ে গেছে। হাত ফেটে গেছে। আমরা আহত দেখে বাচ্চাদের ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ঢুকাচ্ছিলাম। মাঝখানে দেখলাম একজন লোক বাইক নিয়ে এসেছে। তিনি আহত যাকেই দেখতেছে তুলে নিয়ে হাসপাতালে পৌছে দিচ্ছে বাইকে করে। আমিও বাইক আনার প্রস্তাব করি। কিন্তু সময় লাগবে বরে তা নাকচ হয়ে যায়।
আপনারা ভিডিওতে দেখেছেন যে পুলিশের একটা সাদা এপিসে থানা থেকে বের হয়ে একটা ছেলেকে গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলে। লাশ বেশ কিছুক্ষণ পড়ে ছিল। তারা একটা প্লাস্টিকের রোড ডিভাইডার দিয়ে ঢেকে রাখে। পরবর্তীতে লাশটা দুইতিন দিন পর পাওয়া যায়। ওই লাশটা যখন রাস্তায় কিছুক্ষণ পড়ে ছিল তখান শিক্ষার্থীরা অনেক চেষ্টা করেছিল লাশটা নিয়ে আসার জন্য। তখন পর্যন্ত জানি না ছেলেটা বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে। যদি কোনভাবে সম্ভব হয়, চিকিৎসা দিয়ে যদি বাচানো যায়। এই ইচ্চাটা আমাদের ছিল। আমরা দেখছি লাশটার পাশে পুলিশ বন্দুক তাক করে আছে যাতে কেউ সামনে না আসে। আমাদের সামনে যাওয়ার সুযোগ নাই। একের পর এক টিয়ার সেল ফাটাচ্ছে। সাউন্ড গ্রেনেড ফাটাচ্ছে। বন্দুক তাক করে রাখছে। চায়ের দোকানের স্টিলের কাভারকে শিল্ড হিসেবে ব্যবহার করে আমি সামনে এগুচ্ছিলাম। লাশটা নিয়ে আসার জন্য। তখন মুগ্ধ পিছন থেকে কলার টান দিয়ে ধরলো। রিক্স নেওয়ার দরকার নাই। সাড়ে চারটার দিকে আমাদের আরেক বন্ধু জাকির আসে। আবার আমরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে যাই। দেখি সেখানে গুলীবিদ্ধ রোগীতে ভরে গেছে। বলা যায় ধারণ ক্ষমতার বাইরে। তার সামনে আরেকটা হাসপাতাল আছে। এখন যেটা মুগ্ধ মঞ্চ, হাই কেয়ার নামের একটা হাসপাতাল আছে। আমি সেখানে চলে যাই। তখন মুগ্ধ আমাকে ফোন করে এদিকে আয় আমাকে সাহায্য করতে হবে। আমি তার কাছে এসে দেখি তার হাতে একটা পানির কেইস। সেটা ভরা পানি। আরেক হাতে রুটি আর বিস্কুট। সে বলে সাবধানে থাক। আমরা মানুষকে সাহায্য করবো আর আন্দোলন করবো। সে বললো আমারা সাথে থাক, মানুষকে পানি দেয়। আমি রাজি হয়ে যাই। সে জোরে জোরে বলছে পানি লাগবে পানি ? তখন আমরা আজমপুর থেকে ক্রিসেন্টের দিকে এগুচ্ছি। তখন পেছন থেকে ভিডিওটা করে জাকির। কোন কারণ ছাড়াই ভিডিওটা করে পানি লাগবে পানি। পানিগুলো পাশের ডাচবাংলা বুথের কাছ থেকে কিনেছে। আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম। তখন ক্রিসেন্ট হাসপাতালের আগে একটা বিল্ডিং আছে প্রিয় প্রাঙ্গণ নাম। তার সামনের ডিভাইডারের ওপর আমরা বসছি। প্রথমে বসে জাকির, তারপর মুগ্ধ তারপর আমি। মাঝখানে জাকির বলে আমার একটা ছবি তুলে দেয় মুগধর সাথে। মুগ্ধ বললো তাহলে আমার আই ফোন দিয়ে ছবিটা তোল। যেহেতু আমি আই ফোন কিনেছি। তারপর আমি তাদের ছবি তুলে দিলাম। তখন আমরা দেছি অনেক শিক্ষার্থী দৌড়ে আসতে থাকে। পুলিশ ধাওয়া দিচ্ছে। তখন মনে হলো পুলিশ লাইভ বুলেট ব্যবহার করছে। সারাদিনতা দেখিনি। ছাত্রদের আসতে দেখে জাকির ওঠে হাটতে থাকে। আমি আর মুগ্ধ বসে আছি। আমি দাড়াই আর দেখি এতো মানুষ কেন দৌড়ে আসছে। দেখি বিকট শব্দ হচ্ছে। তখন দৌড় দেবো পেছনে তাকিয়ে দেখি মুগ্ধ সেজদার মতো পড়ে আছে। কপালের মাঝখানে গুলী লেগেছে। চোখ দুটো খোলা। মনে হচ্ছে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি জাকিরকে ডাক দিয়ে বলি মুগ্ধকে গুলী করেছে। তারপর আমরা দুই তিনজন মিলে তাকে তুলি। আমাদের দেখে একজন রিকশাওয়ালা মামা দৌড়ে আসে। তখন রিকশাতে তুললাম মুগধকে। তখন আমি ক্লান্ত। মুগ্ধর মাথা থেকে এভাবে রক্ত বের হচ্ছে, কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। এটা হবে ৪টা ৫০ মিনিটের দিকে। আমরা ছবি তুলি ৪টা ৪৬ মিনিটে। এর দুই তিন মিনিট পরেই গুলী লাগে। কপাল থেকে এতো রক্ত বের হচ্ছিল যে আমার গায়ে কাপড় সব ভিজে যায়। মুগ্ধর শরীর এতো পরিমান ভার হয়ে যায় যে আমি কন্ট্রোল করতে পারছিলাম না। সাথে আরেকজন ছিল। শরীরের ওপরের অংশটা আমি আর নিচের অংশটা আরেকজন সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছিলাম। আমার মনে হচ্ছে আমি তাকে নিয়ে পড়ে যাবো। কপাল থেকে এতো রক্ত বের হচ্ছিল যে, আমার সব জামা ভিজে যায়। আমার হাত পিচ্ছিল হয়ে পড়ে। রিকশাওয়ালা চিৎকার করে বলছে কপালে যেহেতু গুলী লেগেছে সেখানে ধরে রাখেন, যাতে রক্ত বের হতে না পারে। আমি বুঝতে ছিলাম যে এক হাত যদি সরাই মুগ্ধ রিকশা থেকে পরে যাবে। তখন দুই হাত দিয়ে তাকে চেপে ধরে বাম গাল দিয়ে তার কপালে চেপে ধরে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করি। পরে তাকে আমি কোলে তুলে সরাসরি ইমারজেন্সিতে যাই। তাকে বেডে ফেলে দিয়ে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। বেশ কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে ডাক্তার আমাকে একটা রক্তমাখা আইডি কার্ড দেখান। আমাকে ডাক্তার বলে যে উনি(মুগ্ধ) আপনার কি হন। আমি বলি ভাই বনধূ। ডাক্তার বলে যে ওনার বাসায় ফোন দেন। তখন আমি মুগ্ধও ভাই স্নিগ্ধকে ফোন দিয়ে বলি মুগ্ধর গায়ে গুলী লাগছে, হাসপাতালে আসার জন্য। স্নিগ্ধ আসার পর আমরা পাশের খালি বেডে বসে মুগ্ধর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। মুগ্ধর চোখটা অর্ধেক তখনো খোলা। তখন দেখি মুগ্ধর সম্পুর্ণ মাথাটা ব্যান্ডিজ করে রেখেছে। পরে জানতে পারি যে, কপালে যেখানে গুলী লেগেছে সেখানে ফুটোটা ছোট হয়েছে। পিছনে কয়েক ইঞ্চি সার্কেল হয়ে গুলী বের হয়ে গেছে। তখনো আমরা বসে আছে বুঝতে পারিনি আসলে কি হয়েছে। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এসে বললেন ওনার পরিবারের কেউ এসেছে ? আমি বললাম হ্যা তার ভাই এসেছে। তখন ডাক্তার বলে যে আমরা তার পালস খোঁজে পাচ্ছি না। মানে আমরা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। স্নিগ্ধ বলে কি বলেন? তাড়াতাড়ি আরেকবার একটু দেখেন। তখন আমরা মনিটরে দেখি যে পালসের জায়গাটা প্লেন করে যাচ্ছে। তখন আমাদের মনে হলো মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে।