দুর্বল সঞ্চালন লাইনের কারণে গুণগত মান বজায় রেখে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া দুস্কর হয়ে দাড়িয়েছে। প্রায়ই ছোটখাটো কারণে সঞ্চালন লাইনে ঘটছে দুর্ঘটনা। সারা দেশের অর্ধেকের বেশি সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন ৩২ বছরের পুরোনো। এছাড়া বিদ্যুতের ভোল্টেজ ও ফ্রিকোয়েন্সির ওঠানামা, ঘন ঘন এবং অপ্রত্যাশিত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধের সমস্যাও অনেক আগের। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ’বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন নিয়ে তেমন কাজ হয়নি। ফলে এর খেসারত দিচ্ছে গ্রাহকরা।

সর্বশেষ গত রোববার রাতে হঠাৎ করে ঘটা বিদ্যুৎ বিভ্রাটে অন্ধকারে নিমজ্জিত হয় ঢাকার বড় একটি অংশ। রামপুরা সুপার গ্রিড সাবস্টেশনে ‘বাজফিড’ নামে কারিগরি ত্রুটির ফলে এ বিভ্রাট ঘটে। এতে গুলশান, বনানী, তেজগাঁও, ফার্মগেটসহ রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকায় একযোগে এক ঘণ্টার বেশি সময় লোডশেডিং হয়।

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিবিপি) জানিয়েছে, রামপুরা গ্রিডের ২৩০ কেভি সাবস্টেশনে রোববার রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে কারিগরি ত্রুটি দেখা দেয়। পরে রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে মেরামত শেষে ধাপে ধাপে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়।

গ্রিডে হঠাৎ এমন বিপর্যয় দেশের বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থার প্রযুক্তিগত ও পরিকল্পনাগত দুর্বলতার চিত্র সামনে এনেছে। সঞ্চালন ব্যবস্থায় আধুনিকায়নের অভাব এবং পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থার ঘাটতি গ্রিড ট্রিপিংয়ের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

পিজিবিপির প্রধান প্রকৌশলী বি. এম. মিজানুল হাসান বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ওই সময় গ্রিডে ‘বাজফিড’ হয়েছে, যা মূলত বিদ্যুৎ ফ্রিকোয়েন্সি বা ভোল্টেজের অনিয়মিত ওঠানামার ফলে হয়। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম হলে গ্রিডে চাপ পড়ে। এতে ফ্রিকোয়েন্সি অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়, ফলে নিরাপত্তাজনিত কারণে সাবস্টেশন নিজে থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এটিই হলো বাজফিড। তিনি বলেন, রামপুরা সাবস্টেশনে এই ত্রুটি কীভাবে ঘটল, তা জানতে তদন্ত চলছে। তবে ঘটনা দ্রুত সমাধান করতে পেরেছে পিজিবিপি, এটা ইতিবাচক।

জানা গেছে, দেশে গ্রিড বিপর্যয় নতুন ঘটনা নয়। এর আগে ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়ে ঢাকাসহ দেশের অনেক অঞ্চল ছয় ঘণ্টার বেশি সময় বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন ছিল। একই বছরের সেপ্টেম্বরে কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ঘটে ব্ল্যাকআউটের ঘটনা। এছাড়া ২০১৭, ২০১৪ এবং ২০০৭ সালেও গ্রিড বিপর্যয় ঘটে।

পিজিসিবির সূত্র বলছে , বর্তমানে তাদের সঞ্চালন লাইন আছে ১৫ হাজার ৮৭০ সার্কিট কিলোমিটার। ২০১৯ সালে এর পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৪৯৩ কিলোমিটার। গত ৫ বছরে বেড়েছে ৩২৭৭ কিলোমিটার। সঞ্চালন লাইনের টাওয়ার বসাতে জমি দিতে কেউ রাজি হতে চায় না। তাই অনেক সময় লেগে যায়। এখন জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের তথ্য অনুযায়ী সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনে সমস্যা রয়ে গেছে। ২০০৯ সালের শুরুতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ২-৩ বছর ধরে সঞ্চালন ও বিতরণে কিছুটা জোর দেওয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বিদ্যুৎ বিভাগের পরিকল্পনা বলছে, বিদ্যুৎ ব্যবস্থার আধুনিকায়নে মহানগর এলাকার সব বিতরণ লাইন ও সাবস্টেশন মাটির নিচে নেওয়া হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে সঞ্চালন লাইন হবে ২৮ হাজার সার্কিট কিলোমিটার।

পিজিসিবি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে ৪০০ কেভি ২৪৯৭ সার্কিট কিলোমিটার, ২৩০ কেভি ৪ হাজার ২৬৫ সার্কিট কিলোমিটার ও ১৩২ কেভি ৮ হাজার ৬৮৫ সার্কিট কিলোমিটার ট্রান্সমিশন লাইন আছে। গত ৫ বছরে ৪০০/২৩০ কেভি ক্ষমতা বেড়েছে ৯৩৮৫ এমভিএ (মেগা ভোল্ট অ্যাম্পিয়ার), ৪০০/১৩২ কেভি দৈর্ঘ্যরে ক্ষমতা বেড়েছে ২৬৬২ এমভিএ। ২৩০/১৩২ কেভি সাবস্টেশন বেড়েছে ৪৯০০ এমভিএ, ২৩০/৩৩ কেভি সাবস্টেশন বেড়েছে ৫৬০ এমভিএ ও ১৩২/৩৩ কেভি সাবস্টেশন বেড়েছে ৪৩৩৫ এমভিএ। ৪০০ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন বেড়েছে ১৪৭২ সার্কিট কিলোমিটার। ২৩০ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন বেড়েছে ৭৭৯ সার্কিট কিলোমিটার আর ১৩২ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন বেড়েছে ১১১০ সার্কিট কিলোমিটার।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নতুন তৈরি করা সঞ্চালন লাইনের মান নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ৬ লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার বিতরণ লাইন করার টার্গেট নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে আছে ৬ লাখ ১৪ হাজার কিলোমিটার। এরপরও মানসম্মত বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ বিতরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমাদের আগের লাইনগুলোর বেশির ভাগই পুরোনো ও মান্ধাতা আমলের। নতুন সাবস্টেশনগুলোর মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। যে পরিমাণ বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে, সে হিসাবে বিতরণ লাইন ৫০ থেকে ৬০ শতাংশে উন্নীত করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের (বিইপিআরসি) ওয়েবসাইটে বলা আছে, সরকার শতভাগ মানুষের বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিলেও এই সময়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের উন্নয়ন করা সম্ভব হয়নি। বিদ্যুৎ উৎপাদনে দ্রুত উন্নয়নের কারণ অনেকগুলো কোম্পানি বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাজ করেছে। কিন্তু একমাত্র সরকারি বিদ্যুৎ সঞ্চালন কোম্পানি পিজিসিবি নানা সীমাবদ্ধতার কারণে সে অনুপাতে সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করতে পারেনি।

ক্যাবের জ¦ালানী উপদেস্টা প্রফেসর এম শামসুল আলম বলেন, সারা দেশের সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন বেহাল। সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে যতটা সাফল্য দেখিয়েছে গ্রিডলাইন ও বিতরণ লাইন নির্মাণে সে সাফল্য দেখাতে পারেনি। অনেক আগে সারা দেশে বেশকিছু ১৩২/৩৩ কেভি সাবস্টেশন নির্মাণের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি (পিজিসিবি) এ নিয়ে শতভাগ সফলতা দেখাতে পারেনি। মান নিয়েও প্রশ্ন আছে।

তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেভাবে শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে সারা দেশে সে পরিমাণ ১৩২/৩৩ কেভির সাবস্টেশন নেই। এ কারণে বেশির ভাগ শিল্পকারখানায় ২০-২৫ কিলোমিটার দূর থেকে ব্রেকার বসিয়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বিদ্যুৎ আনতে হচ্ছে।

তিনি বলেন, সরকারের নানামুখী উদ্যোগের কারণে প্রতিদিনই বাড়ছে ছোট-বড় শিল্পকারখানা। কিন্তু শক্তিশালী সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনের কারণে এসব শিল্পকারখানা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাচ্ছে না।