মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা লংমার্চ দিবস উপলক্ষে আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটি-আইএফসি আয়োজিত গণসমাবেশে বক্তারা বলেন, ভারতের ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের ৬ কোটি মানুষ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ জনপদের প্রাণ-প্রকৃতি, জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। পানির অভাবে মারা গেছে অনেক নদ-নদী। এখনো শতাধিক নদ-নদীর মরণ দশা। এর ফলে ভূগর্ভস্থ পানিস্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে কৃষি উৎপাদনের খরচ। উজানের পানির অভাবে সাগর থেকে আসা লোনা পানি ক্রমেই উত্তরের জমি গ্রাস করছে। সুপেয় পানির অভাবে উপকূলীয় এলাকা ছাড়ছে মানুষ। লাখো মানুষ অবর্ণনীয় কষ্টে জীবন কাটাচ্ছে। জলবায়ু হয়ে উঠছে চরমভাবাপন্ন।
গতকাল শুক্রবার বিকেল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা লংমার্চ দিবস উপলক্ষে আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটি-আইএফসি আয়োজিত গণসমাবেশে বক্তারা এসব বলেন। বিশিষ্ট সাংবাদিক মোস্তফা কামাল মজুমদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ গণসমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক মন্ত্রী ও বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আইএফসি, নিউইয়র্কের চেয়ারম্যান সৈয়দ টিপু সুলতান। এ ছাড়াও আলোচনায় অংশ নেন কমরেড খালেকুজ্জামান, ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চের অবিসংবাদিত নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী দৌহিত্র আজাদ খান ভাসানী, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, জাতীয় গণফ্রন্টের সমন্বয়ক কমরেড টিপু বিশ্বাস, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ড. জসিম উদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ টিপু সুলতান, রফিকুল ইসলাম বাবলু, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহিদুল ইসলাম, ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, বিএনপি নেতা মীর সরাফত আলী সপু, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জুনায়েদ সাকি, এনসিপির কেন্দ্রীয় সংগঠক আসাদ বিন রনি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক প্রমুখ।
আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক ফ্রন্ট, জাতীয় গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ কর্মজীবী দলসহ আরও কয়েকটি সংগঠন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেছেন, ভারতীয় আধিপত্যবাদীদের সঙ্গে এ যাবত সম্পাদিত সব অসম চুক্তি বাতিল করতে হবে। ভারতের পানি আগ্রাসন নীতি রুখতে সর্বত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সর্বদলীয় গণসমাবেশের প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, বাংলাদেশের ৫৭টি অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদীর মধ্যে ভারত-বাংলাদেশ আন্তঃসীমান্ত ৩৬টি নদীর ওপর ভারত সরকার আন্তর্জাতিক পানি বণ্টন চুক্তি আইন লঙ্ঘন করে ৫৪টি অবৈধ বাঁধ নির্মাণ করেছে। যার ফলে বাংলাদেশের নদীর পানি শুকিয়ে জনপদ মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে কৃষকরা ঠিকমতো চাষ করতে পারে না। পানির অভাবে প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য, আমাদের মৎস্য সম্পদ, জলবায়ু হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। আবার বর্ষা মৌসুমে বাঁধের গেট খুলে দিয়ে তারা আমাদের পানিতে ডুবিয়ে মারার পরিকল্পনা করে যাচ্ছে বছরের পর বছর ধরে।
তিনি আরও বলেন, ভারতীয় আধিপত্যবাদীদের সঙ্গে এ যাবত সম্পাদিত সব অসম চুক্তি বাতিল করতে হবে। ভারতের পানি আগ্রাসন নীতি রুখতে সর্বত্র প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে।
ঢাকা কলেজের সাবেক ভিপি, বিএনপি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মীর সরাফাত আলী সপু বলেন, দীর্ঘ ১৭ বছর ভারত বাংলাদেশে আওয়ামী পুতুল সরকারকে দিয়ে তার চূড়ান্ত আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিল। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা আবার নতুন বাংলাদেশ করার স্বপ্ন দেখছি।
তিনি বলেন, ১৯৭৬ সালের আজকের এই দিনে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ফরাক্কা লং মার্চের ডাক দেন। তারা ডাকে সাড়া দিয়ে লাখ লাখ জনতা ফারাক্কা অভিমুখে রওনা দেয়। তারপর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের উদ্যোগে তা জাতিসংঘে উপস্থাপন করা হয়। মীর সরাফাত আলী সপু বলেন, প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে অথবা যুদ্ধ করে আমরা আমাদের পানির ন্যায্য হিসেবে আদায় করে ছাড়ব।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেছেন, বর্তমানে প্রতি শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গা-পদ্মা নদীর প্রবাহ ভয়াবহভাবে কমে যায়। নদীর বুকে গরুর গাড়ি চলে, বালুবাহী ট্রাক চলে, অথচ পানি নেই। ১৯৭৫ সাল থেকে গঙ্গা-পদ্মার প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার নৌপথ অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের পরিস্থিতি উল্লেখ করে কাদের গনি বলেন, গঙ্গার আয়তন অর্ধেকে নেমে এসেছে। পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে, জলজ প্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে। পানি নেই বলে ইলিশ আর আসে না, ডলফিন আর ঘড়িয়াল বিলুপ্তপ্রায়। পাশাপাশি হারিয়ে গেছে দেশীয় প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী। সুন্দরবনের অস্তিত্বই আজ হুমকির মুখে।
কাদের গনি চৌধুরী বলেন, ভারত উজানের রাষ্ট্র হিসেবে ভাটির দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশী হিসেবে আচরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফারাক্কা সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ সরকারগুলো টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পক্ষে দেশের স্বার্থবিরোধী ওকালতি করেছে। ফারাক্কা, টিপাইমুখসহ ভারতের অব্যাহত পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।
গণসমাবেশে উপস্থিত ছিলেন ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চের অবিসংবাদিত নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী দৌহিত্র আজাদ খান ভাসানী। তিনি বলেন, পিন্ডির জিঞ্জির ছিন্ন করেছি, দিল্লির দাসত্ব মেনে নেব না, মেনে নেওয়া যায় না (মাওলানা ভাসানী)। প্রয়োজনের যুদ্ধ করে লড়াই করে আমরা আমাদের পানির ন্যায্য হিসাব আদায় করে ছাড়ব।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শহিদুল ইসলাম বলেন, ৫৪টি অভিন্ন নদীর প্রায় প্রতিটিতে আন্তর্জাতিক নদী আইন লঙ্ঘন করে একপাক্ষিকভাবে ভারত উজানে ৩৬ বাঁধ দিয়েছে। বর্তমান সরকারের উচিত পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করতে হবে। তিনি বলেন, ভারত মূলত একটি উদ্দেশ্যে পানি আগ্রাসন অব্যাহত রেখেছে। সেটা হচ্ছে রাজনৈতিক, যাতে বাংলাদেশকে ব্যর্থ ও পঙ্গু রাষ্ট্রে পরিণত করা যায়। ভারতের পানি আগ্রাসন রুখতে হলে, দেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, সকল রাজনীতিবিদেরও ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে।