প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের মতো জঘন্য অপরাধ কোনোভাবেই বিচার ও শাস্তিহীন থাকা উচিত নয় এবং মিয়ানমারকে এই অপরাধের জন্য দায়ী করা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য আস্থা তৈরির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়।
কাতার সফরের দ্বিতীয় দিনে গতকাল বুধবার ‘জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীকে ঘিরে সামাজিক ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ: রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ’ শীর্ষক এক উচ্চপর্যায়ের গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নিয়ে এ মন্তব্য করেন তিনি। সকালে দোহায় মান্দারিন ওরিয়েন্টাল হোটেলে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। গোলটেবিল আলোচনায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে), আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) এবং মিয়ানমারের জন্য গঠিত স্বাধীন তদন্ত প্রক্রিয়া (আইআইএমএম) -এর আওতায় রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত নৃশংসতার বিচার ও জবাবদিহিতার চলমান উদ্যোগগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, জাতিসংঘ ও রোম সংবিধির সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বাস করে, গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ কোনোভাবেই শাস্তির বাইরে থাকা উচিত নয়।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, মিয়ানমার বা এর কর্মকর্তাদের ওপর এই অপরাধগুলোর দায় চাপানো রোহিঙ্গাদের রাখাইনে প্রত্যাবাসনের জন্য আত্মবিশ্বাস তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ এই তিনটি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে বিচার প্রক্রিয়াকে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করছে।
আইসিজে-তে গাম্বিয়া ২৩ অক্টোবর ২০২০ তারিখে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নির্ভরযোগ্য প্রমাণসহ তার অভিযোগপত্র (মেমোরিয়াল) জমা দেয় এবং মিয়ানমার তার পাল্টা জবাব (কাউন্টার-মেমোরিয়াল) জমা দেয় ২৪ অক্টোবর ২০২৩-এ। ২৩ মে ২০২৪-এ গাম্বিয়া তাদের উত্তর জমা দেয় এবং মিয়ানমার তার পাল্টা উত্তর (রিজয়ান্ডার) জমা দেয় ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪-এ।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এই মামলাটি ২০২৫ সালের শুরুর দিকে মূল (মেরিট) পর্বে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। আইন সংস্থা ফোলে হোয়াগ জানিয়েছে, তিনটি ধাপ (অস্থায়ী, আপত্তি ও মূল) সফলভাবে সম্পন্ন হলে, তারা মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে গণহত্যার শিকারদের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবিতে আইসিজেতে আবেদন করবে।
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, গাম্বিয়া সরকার ওআইসি সদস্য রাষ্ট্রগুলো থেকে প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহে একযোগে কাজ করছে। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত ওআইসি ২.৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহ করেছে, যার মধ্যে বাংলাদেশের অবদান সবচেয়ে বেশিÑ৭ লাখ ডলার।
নোবেল শান্তি বিজয়ী অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আইসিজেতে চলমান বিচার প্রক্রিয়ার ব্যয় নির্বাহে যে তীব্র বাজেট ঘাটতি দেখা দিয়েছে, সেই প্রেক্ষাপটে ওআইসির শক্তিশালী সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে কাতার ‘রোহিঙ্গা ফান্ড’-এ আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য ওআইসিকে অনুরোধ করতে পারে, যা মামলার খরচ মেটাতে এবং এ কাজে গতি বজায় রাখতে সহায়ক হবে।
স্পেসএক্সের ভাইস প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ: বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে স্পেসএক্সের গ্লোবাল এনগেজমেন্ট বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট লরেন ড্রেয়ার বুধবার কাতারের দোহায় আর্থনা শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে সাক্ষাৎ করেছেন। উভয়ে বাংলাদেশে স্পেসএক্স স্যাটেলাইট পরিষেবা শিগগিরই চালু করার ব্যাপারে চূড়ান্ত পর্বের সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেন। দুই দশক ধরে ইলন মাস্কের সঙ্গে কাজ করা ড্রেয়ার জানান, এই অংশীদারিত্বের অগ্রগতি নিয়ে তিনি আশাবাদী।
তিনি বলেন, আমরা প্রায় শেষ রেখায় পৌঁছে গেছি। আমি আমার টিমকে নির্দেশ দিয়েছি যে, মে মাসের মধ্যে প্রযুক্তিগত উৎক্ষেপণের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকতে।
সাক্ষাতে অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশের মানুষের আগ্রহের কথা জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এটি একটি বড় খবর। মানুষ দিন গুনছে। সময় এলে আমরা তা উদযাপন করবো বড় পরিসরে। এই অংশীদারিত্ব পুরোপুরি শুরু হবে একটি প্রযুক্তিগত রোলআউটের মাধ্যমে এবং কয়েকটি চূড়ান্ত বিষয়ের সমাধান হলে। এছাড়া, ইলন মাস্ক প্রতিষ্ঠিত আরেকটি প্রতিষ্ঠান পেপ্যালও বাংলাদেশে স্পেসএক্সর কার্যক্রমে ডিজিটাল লেনদেনের সহায়ক হিসেবে বিবেচনায় রয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টাকে লরেন ড্রেয়ার বলেন, শুরু থেকেই এটি ছিল আমাদের অংশগ্রহণ করা অন্যতম সুসংগঠিত ও কার্যকরী একটি উদ্যোগ।
বৈঠকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ উপস্থিত ছিলেন।
কাতারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সাক্ষাৎ: কাতারের উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষা বিষয়ক মন্ত্রী শেখ সাউদ বিন আবদুল রহমান বিন হাসান আল-থানি বুধবার দোহায় আর্থনা সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
বাংলাদেশের প্রস্তাবে রাজি হয়ে সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন সার্ভিস শাখায় ৭২৫ জন বাংলাদেশী সেনাসদস্যকে প্রেষণে নেয়ার সম্মতি প্রদান করায় প্রধান উপদেষ্টা শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির নেতৃত্বাধীন কাতার সরকারকে ধন্যবাদ জানান।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, এই উদ্যোগের মাধ্যমে দুই দেশের সশস্ত্র বাহিনী পেশাগতভাবে উপকৃত হবে এবং পারস্পরিক সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে।
প্রধান উপদেষ্টা আশ্বাস দেন যে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের তিন দশকের অভিজ্ঞতা, শৃঙ্খলা ও পেশাদারিত্ব কাতার সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়নে কাজে লাগাবে।
তিনি আরও বলেন, এই ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ নতুন সহযোগিতার পথ উন্মোচন করবে এবং ভবিষ্যতে দুই দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তুলতে একটি দৃঢ় ভিত্তি তৈরি করবে।
কাতারের বাণিজ্যমন্ত্রীর সাক্ষাৎ: কাতারের বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী শেখ ফয়সাল বিন আল থানি দোহার একটি হোটেলে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। বৈঠককালে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য এবং পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন।