যাত্রাবাড়ী এলাকার মোহাম্মদ মাসুম, জুলাই আন্দোলনে পুলিশের গুলীতে আহত হয়ে ১১ মাস ধরে চিকিৎসাধীন আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ৫ আগস্ট স্বৈরাচার হাসিনা পালানোর দিন তিনি গুলীবিদ্ধ হন যাত্রাবাড়ি থানার সামনে। সেদিন কি ভয়াবহ দৃশ্য ছিল তিনি তার বর্ণনা দিয়েছেন দৈনিক সংগ্রামকে। লিখেছেন ইবরাহীম খলিল।
দৈনিক সংগ্রাম : আপনকে ৫ আগস্ট গুলী করে পুলিশ। এরপর থেকে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন। হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন দীর্ঘ ১১ মাস ধরে। সেদিনের ঘটনা শুনতে চাই আপনার কাছ থেকে।
মোহাম্মদ মাসুম : ৪ আগস্ট সারাদিন যাত্রাবাড়িতে অনেক গন্ডগোল হয়েছে, আন্দোলন হয়েছে, সেই আন্দোলনে আমি ছিলাম। সেদিন সন্ধ্যায় যখন আমরা বাসায় ফিরি তখন আওয়ামী লীগের লোকজন আমাদের বাসায় আসে। পুলিশের সাথে সিভিল বেশে আসে। ১৯৭১ সালের মতো। তারা জিজ্ঞেস করে এখানে কারা কারা ছাত্র থাকে। আমিও ব্যাচেলর ছিলাম বলে আমার বাসাতেও তাই করে। যাদের পেয়েছে তাদের ধরে নিয়ে আসে। আমাকে ধরে আনতে পারেনি একারণে যে, আগেই জানতে পেরেছিলাম-- জায়গায় জায়গায় রেইড করা হচ্ছে। এজন্য আমরা বাইরে ছিলাম। ৫ তারিখ যাত্রাবাড়ি থানার পশ্চিম পাশে আমি আন্দোলনে যোগ দেই। পূর্বপাশে শনির আখড়া রায়েরবাগের দিকে তারা অবস্থান নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাসেল মাহমুদের নেতৃত্বে লোকজন ছিল রাস্তার পূর্বপাশে আমরা ছিলাম পশ্চিম পাশে। সকাল বেলা পরিবেশ ভালই ছিল। দুপুর ১২টার দিকে মূলত সেখানে গোলাগুলী শুরু হয়। তার আগে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়েছে কিন্তু লাশ পড়েনি। ১২টার পর আমরা অনেক গুলীবিদ্ধ লোকজনকে ধরে ধরে হাসপাতালে পাঠাতে থাকি। একজন আহতকে একজন করে লোক দিয়ে পাঠিয়ে দেই। বাকীরা আন্দোলনে থাকি। আমরা পুলিশ এবং সেনাবাহিনীকে অনুরোধ করেছি অনেকবার যে আমরা শাহবাগে যাবো। সেনাবাহিনী বলে আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে থাকেন। আমরা পুলিশের সাথে কথা বলছি। কয়েকদফা কথা বলার পরও ওপাশ থেকে লোকজনকে এপাশে অর্থাৎ পাশ্চিম পাশে আসতে দিচ্ছিল না। তখন আমরা তিন ভাগ হয়ে যাই। আমরা মনে করেছিলাম যে প্রায় লাখ খানেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। সবাইকে নিয়েই যাবো।
দৈনিক সংগ্রাম : ৫ তারিখে লাখ মানুষ ছিল?
মোহাম্মদ মাসুম : জি¦। তার চেয়ে বেশি মানুষ ছিল। একদম মেডিকেল থেকে শুরু করে যাত্রাবাড়ি পর্যন্ত মানুষ আর মানুষে সয়লাব ছিল। আর এই পাশ থেকে গুলীস্তান পর্যন্ত মানুষ ছিল। দেড়টা দ্ইুটার দিকে যখন দেখি যে কোনভাবেই আসতে দিচ্ছে না পুলিশ; তখন আমরা একসাথে দাঁড়িয়ে থাকি। সুযোগের অপেক্ষায় থাকি। কিছুক্ষণ পরই পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলী শুরু করে। তাতে বেশ কিছু মানুষ মারা যায়। আমরা তখন দৌড়াদৌড়ি শুরু করি। সেনাবাহিনীও ছিল। তখন আমরা কাকে নিয়ে কোথায় যাবো এমন হা-হুতাশ করছি। মানুষ মারা গেলো লাশ আনতে দিচ্ছে না পুলিশ। আমার কাছে ভিডিও ছিল রাস্তায় কিভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। সেদিন বেলা আড়াইটার দিকে আমরা জানতে পেরেছি যে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছে। তবে দেশ ছেড়ে পালিয়েছে কি-না সেটা জানি না। তবে সবাই আন্দোলন থামিয়ে গণভবনের দিকে যাওয়ার কথা। আমরা তখন প্রস্তুতি নিচ্ছি যে লাশগুলো নিয়ে আসার। থানার পাশে রেলিং। রেলিংয়ের পাশে অনেকগুলো লাশ পড়ে ছিল। লাশগুলোর কাছে যেতে দিচ্ছিল না। পুলিশ বাধা দিচ্ছিল। সেনাবাহিনী সেদিন নিরব ভূমিকায়। পুলিশকেও কিছু বলছে না। আমাদেরকেও কিছু বলছে না। কেবল বলছে আপনারা এখান থেকে সবাই চলে যান। আমরা বলছিলাম যে, থানার সামনে থেকে লাশগুলো আনার জন্য সাহায্য করেন। আমাদের লাশগুলো আনার ব্যবস্থা করেন। এভাবে আপনাদের সামনে মানুষকে গুলী করে হত্যা করছে এগুলোতো আমরা মানতে পারছি না। আমরা দাড়িয়ে ছিলাম থানার একদম অপর পাশে। সেনাবাহিনী পুলিশের সাথে কথা বলে আমাদের জানায়, এখানে ২০/২৫টার মতো লাশ আছে এগুলো নিয়ে যাও। আমরা তখন দুইটা ভ্যান গাড়িতে ১২/১৩টা লাশ উঠিয়ে ঢাকা মেডিকেলের দিকে রওয়ানা দেই। বাকী লাশগুলো সেনাবাহিনীর গাড়ির সামনে রেখে সেটা পুলিশ ফাঁড়ির সামনে রেখে সেনাবাহিনীকে বলেছি যে, আপনারা এটার একটা বিহীত করে যাবেন। তখন সেখানে সেনাবাহিনীর তিন-চারটা সাঁযোয়া যান ছিল। ২০/২৫ জন অফিসার ছিল।
দৈনিক সংগ্রাম : সারা দিনে কতজনের লাশ দেখেছেন?
মোহাম্মদ মাসুম : দুপুর ১২টা থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত ৬০ থেকে ৭০টা লাশ দেখেছি। তারপর আমি গুলী খাওয়ার পর আরও বহু মানুষ মারা গেছে। আমরা যখন লাশ উঠানো শুরু করি তখন অনেক লাশ ছিল। তখন আনুমানিক তিনটা দশ বাজে। আমরা কাজ করছি আর বলছি সেনাবাহিনীকে একটা বিহীত করতে। আমার গায়ে ৩টা বেজে ২০ মিনিটের দিকে গুলী করে পুলিশ। ৩টা দশের দিকে আমরা অনেকভাবে বলেছি যে এর একটা বিহীত করতে। তখন সেনাবাহিনীর অফিসাররা বলে আমাদের ওপর থেকে অর্ডার এসেছে। আমাদের এখনই এই স্থান ত্যাগ করতে হবে। আপনারা যদি আমাদের যেতে না দেন তাহলে আমাদের কিছুই করার থাকবে না। আমাদের বাধ্য হয়েই যেতে হবে। তখন আমরা বলেছি যে এখানে যে লাশগুলো পড়েছে বিচারটা করে যান। পুলিশ তো মারা যায়নি। আমাদের হাতে কেবল লাঠি আর ইট পাটকেল। তখন পুলিশ সেনাবাহিনী দুই পক্ষই বলছে যে আমাদের করার কিছুই নাই। আমাদের যেতে দিন। এসব কথার মাঝখানেই থানার ভেতর থেকে বের হয়। আনুমানিক ৩শ’র ওপরে। দেখলাম মৌচাকের ঝাঁকের মতো বের হচ্ছে।
দৈনিক সংগ্রাম : মানে থানা থেকে বাইরে বের হচ্ছে?
মোহাম্মদ মাসুম : জি¦ থানা থেকে বের হচ্ছে। আমরা কিন্তু থানার সামনেই দাঁড়ানো। পুলিশ কি করলো থানার সামনে এক সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে গুলী করা শুরু করে। আমরা আনুমানিক ৬০/৭০ জন মানুষ গোল করে দাঁড়িয়ে সেনাবাহিনীর সাথে কথা বলছিলাম। গুলী শুরুর সাথে সাথে কিছু মানুষ যারা আম পাবলিক ছিল দৌড়ে পিছন দিয়ে পালায়। আর আমরা দৌড়ে লাশগুলোর সামনে এলাম। লাশের হাতটা ছেড়ে দৌড় দিতে লাগলাম আর আমার পায়ে গুলী করলো পুলিশ। আমি সাথে সাথে রাস্তায় পড়ে গেলে আমার ওপর আরও কয়েকজন গুলী খেয়ে পড়ে যায়। একজন এসে আমার গায়ের ওপর পড়ে যায়। তারা দুজনই জ্ঞানহীন ছিল। প্রথমে আমি মনে করেছিলাম যে আমি বুঝি তাদের ধাক্কায় পড়ে গেছি। গুলী লাগেনি। আমি সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি, একজনের পর একজন গুলী খেয়ে পড়ছে রাস্তার উপর। আর পিছন থেকে গুলী করতে করতে আমাদের দিকে আসছে পুলিশ। আমি শুয়ে শুয়ে ভাবছি আজ আর বাঁচার উপায় নাই। কারণ গুলী করতে করতে আমার দিকেই আসছে পুলিশ। ২০ সেকেন্ড পর আমি অনুভব করি যে, আমার পা শির শির করছে। রক্ত বের হচ্ছে। এসময় আমার গায়ের ওপর যে মুরব্বী পড়েছিল তাকে ধাক্কা দিয়ে ্উপর থেকে সরাই। আমি পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি হাড্ড্টিা ভেঙ্গে উল্টোমতো হয়ে গেছে। পায়ের চামড়া এবং হাড্ডি কিছুই নাই। ছিদ্র হয় এপার ওপার হয়ে গেছে। হাড্ডিগুড্ডি সব চুরমার হয়ে গেছে। কিছু নাই। তা দেখে আমি ঘাবড়ে গেছি যে, আমি মনে হয় আর বাচুম না। পুলিশ প্রায় আমার কাছে এসে পড়েছিল। মাত্র ১০ ফুট দূরে। আমি তখনও শুয়ে আছি। দুইতিনজন পুলিশ সদস্য দৌড়ে আসছিল আমাদের এখানে দেখার জন্য। এখানে কেউ বেঁচে আছে কি না। পুলিশ দেখছে যে আমি বেচে আছি। কিন্তু আমার ওপর লাশ থাকার কারণে গুলী করলে গায়ে লাগবে কি-না এই সন্দেহে হয়তো গুলী করেনি। ঠিক এমন সময় থানার উল্টো দিক অর্থাৎ শহীদ ফারুক সড়ক থেকে ৪/৫ জন বড় বড় ইট নিয়ে পুলিশকে মারা শুরু করে। রাস্তার উপর রেলিং ছিল, রেলিংয়ের সাথে স্টিল লাগানো থাকায় তাদের গুলী করতে পারছিল না। একারণে পুলিশ আমাদের দিকে না এগিয়ে পেছনে চলে যায়। এদিকে এই লোকগুলো চিৎকার করে বলছে যে কে বেঁচে আছেন? কে বেঁচে আছেন? হাত তোলেন। তখন আমি একটু করে হাত জাগাই (হাত উঁচু করি)। তখন আমাকে একজন কোমরের বেল্টে ধরে আরেকজন গেঞ্জের কলারে ধরে দুজনে নিয়ে দৌড় দেয়। তখন আমার গুলী লাগা পা মাটিতে স্যাচড়াচ্ছিল। তারপর একজন আমার পা ধরে। তিন জনে মিলে আমাকে শহীদ ফারুক রোডের দিকে নিয়ে যায়। পরে একটা রিকশায় নিয়ে একটা ভাই ছিল বাইক চালায় তাকে দিয়ে ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে ঢাকা মেডিকেল পর্যন্ত আনে। পরে শুনেছি পাবলিক নাকি থানা পুড়িয়ে দিয়েছে। এরপর থেকে ১১ মাস ধরে মেডিকেলে আছি। পর পর ৫টা অপারেশন হয়েছে।