ফ্যাসিবাদের পক্ষে সম্মতি উৎপাদন না করতে গণমাধ্যমের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মোঃ মাহফুজ আলম। তিনি বলেন, অপকর্মের সম্মতি উৎপাদনের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার গণমাধ্যমকে ব্যবহার করেছে। গতকাল সোমবার তথ্য ভবনে বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস ২০২৫ উপলক্ষে বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে 'ফ্যাসিবাদী শাসনামলে সাংবাদিক হত্যা-নিপীড়ন' শীর্ষক সেমিনারে উপদেষ্টা এই আহ্বান জানান।

বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলের সমালোচনা করে তিনি বলেন, গুম, অপহরণ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপকর্মের সম্মতি উৎপাদনের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার গণমাধ্যমকে ব্যবহার করেছে। এসব অসৎ উদ্দেশ্যেই আওয়ামী লীগ সরকার গণমাধ্যম তৈরি করেছে। বিগত সরকারের আমলে যেসব গণমাধ্যমকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোর অনুমোদন প্রক্রিয়া তদন্ত করা হবে।

মাহফুজ আলম বলেন, কিছু গণমাধ্যম 'জুলাই গণঅভ্যুত্থান'-কে আন্দোলন হিসাবে অভিহিত করছে। এর পাশাপাশি বর্তমান সরকারকে পটপরিবর্তনের পরবর্তী সরকার বলা হচ্ছে। বিষয়টি দুঃখজনক। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো গণমাধ্যমকে কিছু বলা হয়নি। আমরা মনে করি, জনগণ বিষয়টি মূল্যায়ন করবে।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা চাই না কোনো গণমাধ্যম সরকারের পক্ষে লিখুক। সরকারকে প্রশ্ন করুন। সরকারকে প্রশ্ন করলে সরকার আরও বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে। উপদেষ্টা বলেন, গত বছরের ১৯শে জুলাই থেকে ৫ই আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে যে পরিমাণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, এত স্বল্প সময়ে ফিলিস্তিনেও এই পরিমাণ মানুষ হত্যা করা হয়নি। জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অন্য কোনো হত্যাকাণ্ড তুলনীয় নয়।

আলোচনায় অংশ নিয়ে দৈনিক সংগ্রামের প্রকাশক আবুল আসাদ বলেন, জুলাই বিপ্লবের দাবি পূরণ করা দরকার। গণতন্ত্র চাইলে বিপ্লবের মূল্য দিতে হবে। একটা সিস্টেম তৈরির দায়িত্ব সরকারের। এই বিপ্লব থেকে শিক্ষা না নিলে সামনে আরও ভয়ংকর বিপদ আসবে।

দৈনিক আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের ৪৪ ধাপ অবনতি হয়েছে। এর মাধ্যমে আওয়ামী লীগের শাসনামলে গণমাধ্যমের চিত্র উপলব্ধি করা যায়। বিগত সরকারের আমলে সাংবাদিক নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, শেখ হাসিনার নির্দেশেই তাঁর ওপর হামলা করা হয়েছে। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামলের সঙ্গে অন্য কোনো শাসনামলের তুলনা চলে না। এ বিষয়ে কোনো দ্বিধা থাকা উচিত নয়। তিনি আরও বলেন, ফ্যাসিবাদ ও স্বাধীন গণমাধ্যম একসঙ্গে চলতে পারে না। তিনি ফ্যাসিবাদের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত বিচারের দাবি জানান।

কুষ্টিয়ার আদালত চত্বরের সেই দিনের কথা স্মরণ করে আমার দেশ সম্পাদক বলেন, আক্রমণ চলাকালে বিএনপি চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে একটি দলীয় সভা চলছিল, তাতে সভাপতিত্ব করছিলেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তাকে বলা হলো মাহমুদুর রহমানের জীবন বিপন্ন, আপনি সরকারের সঙ্গে কথা বলে দেখেন তাকে অন্তত বাঁচানো যায় কিনা। তিনি তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে ফোন করে যখন বললেন, মাহমুদুর রহমানকে কী আপনারা মেরে ফেলবেন আজকে! তাকে তো বাঁচাতে হবে। আসাদুজ্জামান কামালের জবাব ছিল, এখানে আমার কিছু করার নেই, এটা উপরের নির্দেশ। তার মানে ফ্যাসিস্ট সরকারের মন্ত্রী স্বীকার করে নিচ্ছেন, আমার ওপরে আক্রমণের নির্দেশদাতা ছিলেন স্বয়ং শেখ হাসিনা। সেখানে কামালের কিছু করার নেই।

৩৯ দিন রিমান্ডে থাকা সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে গিয়ে মাহমুদুর রহমান বলেন, ডিবির গারদে মাটিতে থাকতাম, ৩০-৩৫ জন গাদাগাদি করে থাকতাম। এর মধ্যে র‌্যাবের আয়নাঘর দেখা হয়ে গেছে। শেষদিন রাতে হঠাৎ ডাক পড়লো, আপনাকে ডিসি ডিবি ডেকেছেন। আমি যাওয়ার পর ডিসি ডিবি আমাকে আশ্চর্যজনকভাবে স্যার সম্বোধন করলেন। বললেন, স্যার, আপনি হয়তো আমাদের আচরণে রাগ করেছেন, রাগ করবেন না। আমাদের ওপর যে নির্দেশ ছিল, তার কিছুই আপনাকে করিনি। আমি জানতে চাইলাম, কী নির্দেশ ছিল? তখন বললেন, স্বয়ং শেখ হাসিনা জানতে চেয়েছেন যে, আমাদের একটা বিশেষ চেয়ার আছে, সেখানে খুব দ্রুত ঘোরানো হলে মানুষ বমি করতে করতে অজ্ঞান হয়ে যায়। আমাকে ওই চেয়ারে ঘোরানো হয়েছে কিনা।

দৈনিক যায়যায়দিনের সম্পাদক শফিক রেহমান বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে তার বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা নির্বাহী আদেশে একসঙ্গে প্রত্যাহার করতে হবে। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের কারণে কারাগার থেকে বের মুক্তি পেয়েছি। তার সঙ্গে মতপার্থক্য থাকলেও মানবিক মানুষ তিনি।

গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ বলেন, কমিশনের রিপোর্টে বিভিন্ন সমস্যা ও তার সমাধানের সুপারিশ খুব পরিষ্কার করে বলা হয়েছে। সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে স্বাধীন সাংবাদিকতা আশা করা যায় না।

তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবা ফারজানা বলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হওয়া ২৬৬টি মামলার বিষয়ে সরকার কাজ করছে। বিশ্লেষণ করে ৭৪টি হয়রানিমূলক মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ব্যক্তিগত মামলা ২৯টি। সরকার চাইলে এটা তোলা যাবে। এ ছাড়া চারটি মামলা ফ্যাসিস্ট হাসিনার সঙ্গে। বাকিগুলো রাজনৈতিক মামলা।

সেমিনারে সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম আবদুল্লাহ বলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক ৭৪টি মামলার যে তথ্য পাওয়া গেছে, তার মধ্যে অনেকেই রাজনৈতিক দলেরও নেতা। সে কারণে এগুলোকে সাংবাদিক হয়রানি বলা যায় না।

সেমিনারে ‘ফ্যাসিবাদী শাসনে সাংবাদিক হত্যা-নিপীড়ন’ শীর্ষক সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের একটি প্রকাশনার মোড়ক উন্মোচন করা হয়। এতে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত ১৫ বছরে ৬১ জন সাংবাদিককে হত্যা এবং ৩ হাজার ৫৮৮ জনকে নির্যাতনের তথ্য তুলে ধরা হয়।

সাংবাদিক হত্যা-নিপীড়ন বিষয়ে স্মৃতিচারণ করেন নিহত সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিমের স্ত্রী মনিরা বেগম, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহিদ সাংবাদিক হাসান মেহেদীর স্ত্রী ফারহানা ইসলাম ববি, শহিদ সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়র মা সামসি আরা জামান, নির্যাতনের শিকার সাংবাদিক আক্তারুজ্জামান ও সাংবাদিক রাশেদুল ইসলাম। সেমিনারে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, হত্যা-নিপীড়নের শিকার সাংবাদিক-পরিবারের সদস্য এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন বিএফইউজের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহীন, সহ-সভাপতি খায়রুল বাশার, প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ, দৈনিক নয়া দিগন্তের নির্বাহী সম্পাদক মাসুমুর রহমান খলিলি ও শীর্ষ নিউজের সম্পাদক একরামুল হক, সাংবাদিক কল্যাণ স্ট্রাস্টের পরিচালনা বোর্ডের সদস্য শাহীন হাসনাত, জুলাই আন্দোলনে শহীদ সাংবাদিক হাসান মেহেদীর স্ত্রী, জুলাই আন্দোলনের শহীদ তৌহিদ জামানের মা, ভুক্তভোগী সাংবাদিক রাশিদুল ইসলাম, ভুক্তভোগী সাংবাদিক আখতারুজ্জামান, জামালপুরের নিহত সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিমের স্ত্রী প্রমুখ।