বিচারব্যবস্থা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত সম্প্রসারণে সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছে। তবে ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে যেসব উপজেলা জেলা সদরের কাছাকাছি, সেখানে আদালত স্থাপনের বিপক্ষে মত দিয়েছে দলগুলো। কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়, উপজেলা সদরের ভৌগোলিক অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য, জেলা সদর থেকে দূরত্ব ও যাতায়াতব্যবস্থা, জনসংখ্যার ঘনত্ব ও বিন্যাস এবং মামলার চাপ বিবেচনা করে কোন কোন উপজেলায় স্থায়ী আদালত স্থাপন করা প্রয়োজন, তা নির্ধারণ করতে হবে।

বর্তমানে যেসব উপজেলায় চৌকি আদালত পরিচালিত হয়, সেগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে সবগুলো চৌকি আদালতকে স্থায়ী আদালতে রূপান্তরিত করা প্রয়োজন নাকি সে ক্ষেত্রেও পুনর্বিবেচনা ও পুনর্বিন্যাসের সুযোগ রয়েছ, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবে। বাস্তব পরিস্থিতির নিরিখে উপজেলা সদরে স্থাপিত কোনো আদালতের জন্য একাধিক উপজেলাকে সমন্বিত করে অধিক্ষেত্র নির্ধারণ করার প্রয়োজন হলে তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

প্রস্তাবে বলা হয়েছে, উপজেলা আদালতগুলোতে সিনিয়র সহকারী জজ ও প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের বিচারকদের পদায়ন করতে হবে। দেওয়ানি মামলা গ্রহণে সিনিয়র সহকারী জজের আর্থিক এখতিয়ার বাড়িয়ে বাস্তবানুগ করাও প্রয়োজন। আইনগত সহায়তা কার্যক্রম উপজেলা পর্যায়ে সম্প্রসারিত করতে হবে। কয়েকটি দলের পক্ষ থেকে আগামী কত বছরের মধ্যে উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত সম্প্রসারণ করা হবে, তা নির্দিষ্ট করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

জামায়াতের অবস্থান :

বিচার ব্যবস্থাকে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে অধস্তন আদালতকে উপজেলা পর্যায়ে নিয়ে যেতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবে সায় দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। সোমবার (৭ জুলাই) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের বৈঠকের দ্বিতীয় পর্যায়ের দশম দিনের বিরতিতে সাংবাদিকদের এমন তথ্য দিয়েছেন দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ।

তিনি বলেন, ‘অধস্তন আদালতের বিকেন্দ্রীকরণÑঅর্থাৎ অধস্তন আদালতকে জেলা থেকে উপজেলা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাবে একমত পোষণ করেছে জামায়াত। আমরা তাদের প্রস্তাবে সমর্থন দিয়েছি। কারণ হচ্ছে, আজকে যে ঐকমত্য কমিশন, আজকে যে অন্তর্বর্তী সরকার, আজকে যে বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থানÑ৫ আগস্টের পরিবর্তনের যে জনআকাক্সক্ষা, সেটিকে কেন্দ্র করে। আমরা জনস্বার্থে আদালতকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে চাই।’

কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জামায়াতের এই কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ‘একজন উপজেলায় বসবাসকারী নাগরিক যদি বিচারপ্রার্থী হন, তাকে যোগাযোগের বিরাট জটিল অবস্থা অতিক্রম করে জেলায় যেতে হয়। ফলে এখানে অর্থনৈতিক একটি বিষয় আছে। দূরত্ব ও সময়ও একটি বিষয়। সেখানে গিয়ে জেলা পর্যায়ে আইনজীবী ঠিক করে বিচার পাওয়াÑএই যে মানসিক দুর্ভোগÑথাকা-খাওয়াÑসবমিলিয়ে একটা কষ্টকর অবস্থা তার হয়।’

‘বিশেষ করে, বিচারপ্রার্থী যদি একটু আর্থিকভাবে স্বচ্ছল না হন, তার জন্য আরও দুর্বিষহ পরিস্থিতি চলে আসে। এ জন্য আমরা বলেছি যে জনগণের কষ্ট লাঘব করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে বিচারকে সহজীকরণের জন্য এবং মামলার চাপ কমানোর জন্য আমরা এটিকে সমর্থন করেছি। এটি যেন উপজেলা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ৪৯৫টি উপজেলা আছে। আবার বেশ কিছু বর্তমানে সংবিধানের ভিতরেই আছে, বিচারের জন্য কিছু চৌকি স্থাপন করা আছে। এখানে আমরা প্রস্তাব দিয়েছি, পর্যায়ক্রমে যাতে সব উপজেলায় বিচার-আদালত নিয়ে যাওয়া হয় আর চৌকিগুলোকে স্থায়ী আদালতে রূপান্তর করা হয়।’

‘আমরা নীতিগতভাবে একমত হয়েছি, জনস্বার্থে বিচার ব্যবস্থাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে হবে। এখানে আরেকটি সমস্যা হচ্ছে যে বিচার ব্যবস্থা যদি অধস্তনে চলে যায়, তাহলে দুর্নীতি বাড়বে, আমাদের দেশে যে দালাল চক্র আছে, তারা বিচারপ্রক্রিয়ায় জড়িত লোকদের সাথে যোগসাজশ করে অথবা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে প্রতারণা করবে। আলোচনায় এই কথাটা উঠে এসেছে।’

কিন্তু মাথাব্যথা হলে মাথা কেটে না ফেলে চিকিৎসা নিতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মানুষের মধ্যে যদি মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে, জনসচেতনতা বাড়ে, মানুষকে শিক্ষিত করা গেলে এই জিনিসগুলো দূর করা যাবে। আর দুর্নীতি কোথায় নেই? জেলা পর্যায়ের বিচারে কি দুর্নীতি হয় না। হাইকোর্টের বিচারপতির সই জাল করে রায় বের করার নিউজ তো আপনারাই করেছেন।

আলোচনায় গ্রাম আদালতের বিষয়টিও উঠে এসেছে জানিয়ে জামায়াতের এই সহকারী সেক্রেটারি বলেন, ‘গ্রাম আদালতে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, সেটিকে আরও কার্যকর করার কথাও আমরা বলেছি। যেমন, এখানে সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান আছে। সেই জায়গায়, এখতিয়ার যদি একটু বাড়ানো যায়।’

‘সেখানে সালিশ করার মতো লোকের অভাব রয়েছে। তাদের যদি প্রশিক্ষণের মধ্যে আনা যায়, সবদিক থেকে আরও এখতিয়ার ও পাওয়ার ফাংশন দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হলে অনেক বিষয় ইউনিয়ন পর্যায়ের গ্রাম আদালতে এসে শেষ হয়ে যেতে পারে। বিচার আদালতের দ্রুত নিষ্পত্তির একটি মাধ্যম হতে পারে এটি,’ যোগ করেন আযাদ।

বিএনপি যা বলছে:

উপজেলা পর্যায়ে আদালত বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়ে কিছু দিকনির্দেশনাসহ সবাই একমত হয়েছেন বলে দাবি করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, অধস্তন আদালত বিকেন্দ্রীকরণে একটি জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের বৈঠকের দ্বিতীয় পর্যায়ের দশম দিনের শেষে সাংবাদিকদের তিনি এমন তথ্য দিয়েছেন।

অধস্তন আদালতের ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিষয় সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘যেমন, জেলা সদরে অবস্থিত উপজেলায় আদালত প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন নেই। যেহেতু, সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা সদর উপজেলা আদালত জেলা সদরে জেলা জজকোর্টের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়া যায়, তাতে জেলা সদরে উপজেলা আদালত প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়।

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশেÑযেগুলো ব্রিটিশ আমালের চৌকি হিসেবে চিহ্নিত ছিলÑসেগুলো, দ্বীপাঞ্চল ও কিছু কিছু উপজেলায় আদালত প্রতিষ্ঠিত আছে। সেই সংখ্যাটা ৬৭, যেটা আমরা পরিসংখ্যানে পেয়েছি। কম-বেশিও হতে পারে। এগুলো প্রতিষ্ঠিত থাকবে। তবে সেখানে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা নির্মাণ করা প্রয়োজন।

‘যেসব উপজেলা জেলা সদরের খুব কাছে, যোগাযোগ ব্যবস্থা যেহেতু আগের তুলনায় উন্নত হয়েছে, সে জন্য কোনো উপজেলা সদর উপজেলা হেডকোয়ার্টার্সের ১৫ বা ২০ কিলোমিটারের মধ্যে থাকলে সরকারিভাবে আরেকটি স্থাপনা নির্মাণ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাস ও তা রক্ষণাবেক্ষণ করা খুবই ঝামেলাপূর্ণ ব্যাপার। সেই বিবেচনায় একটি বিস্তারিত জরিপ পরিচালনা শেষে সেসব উপজেলা সদর বা হেডকোয়ার্টার্সে আদালত স্থাপনের প্রয়োজন নেই বলে মতামত দেওয়া হয়েছে,’ যোগ করেন তিনি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘উপজেলার দূরত্ব, জনঘনত্ব ও অর্থনৈতিক অবস্থা, যোগাযোগ, কোন কোন উপজেলায় কত মামলা আছে ও অন্যান্য বিষয়াবলি বিবেচনা করতে বলা হয়েছে। এরপর একটি জরিপ কার্যক্রম করে পর্যায়ক্রমে সমস্ত উপজেলায় আদালত স্থাপনে সম্মতি দেওয়া হয়েছে। ‘আইনি সহায়তা উপজেলা পর্যায়ে বিস্তৃত করার বিষয়েও একটা ঐকমত্য এসেছে। মোটামুটি এই বিষয়গুলো নজরে রেখে উপজেলা আদালত কিংবা অধস্তন আদালত বিকেন্দ্রীকরণে একটি জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়েছে।

বিভাগীয় শহরে হাইকোর্টের বেঞ্চ স্থাপনের ক্ষেত্রে বিচার বিভাগকে সম্পৃক্ত করার পরামর্শ দিয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিগত দিনে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ বিভাগীয় শহরে স্থাপনের বিষয়ে যে আলাপ হয়েছিল, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে সেই একই বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। আমরা বলেছি, হাইকোর্টে স্থায়ী বেঞ্চ বিভাগীয় শহরে স্থাপনের বিষয়ে বিচার বিভাগের সাথে আলোচনা করতে হবে। কারণ এ বিষয়ে ১৯৮৮ সালে সুপ্রিমকোর্টের একটি রায় আছে, সেই সংবিধান সংশোধনীকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়েছিল। তখন সেটা স্থাপিত হয়নি। সামনে যাতে একই জটিলতায় পড়তে না হয়, সে জন্য আমরা বলেছিÑবিচার বিভাগের সাথে আলোচনা করে, তাদের সম্পৃক্ত করে একটি সমাধানে আসতে হবে। সেই দায়িত্ব জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও সরকারের।

এরআগে উপজেলা পর্যায়ে আদালত প্রতিষ্ঠা করা হলেও তা তুলে দেওয়া হয়েছে, এখন সেটা আবার পুনর্প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘১৯৯১ সালে বিএনপির নেতৃত্বে সরকার প্রতিষ্ঠা করা হলে তখনকার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও জাতীয় সেন্টিমেন্টের সাথে একমত হয়ে উপজেলা পর্যায়ের আদালত কিছুটা ব্যতিক্রম ছাড়া তুলে দেওয়ার বিষয়ে সবাই একমত হয়। সেই বিষয়ে তখন কোনো আপত্তি জাতীয়ভাবে আসেনি। তবে বর্তমানে যে ৬৭টি আদালত আছে, সেটাও তখনকার সিদ্ধান্ত। এটা তখনকার অবস্থা। কিন্তু তার ৩৫ বছর পরে সময়ের প্রয়োজনে সেই বিবেচনা পাল্টাতে হয়েছে।

এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, কোনো কিছু চাপিয়ে দিচ্ছে না ঐকমত্য কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলোর অনুভূতি এবং বক্তব্য ধারণ করে সংশোধন প্রস্তাব আনছে কমিশন। ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিতীয় পর্যায়ের ১০ম দিনের আলোচনার শুরুতে অধ্যাপক আলী রীয়াজ এ সব কথা বলেন।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল নিয়ে অধিকাংশ দলের আপত্তি থাকার কারণে ভিন্ন ভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যাতে কোনো ভুল বুঝাবুঝি না হয়, সেদিকে কমিশন নজর রাখছে। এর ফলে অনেক কিছু বাদ দিয়ে আমরা আলোচনায় অংশগ্রহণ করছি। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ইতিবাচক আলোচনা হচ্ছে উল্লেখ করে আলী রীয়াজ আরো বলেন, এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। যতটা সম্ভব বেশি সময় মিলিত হয়ে যেন দ্রুত কাজ শেষ করা যায়, সেজন্য সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। আলোচনায় নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন এই তিনটি বিষয়ে আলোচনা হওয়ার ক্ষমতা রয়েছে।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় এদিন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টিসহ ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিগণ অংশগ্রহণ করেন। এদিন উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালতের সম্প্রসারণ, জরুরি অবস্থা ঘোষণা, নারী প্রতিনিধিত্ব এ তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়ার হয়।