গত বছরের জুলাই-আগস্টের গণহত্যা মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তার (আইও) কাছে জবানবন্দি দিয়েছিলেন কিংবদন্তি লেখক, চিন্তাবিদ ও গবেষক বদরুদ্দীন উমর। তার দেওয়া সেই জবানবন্দি সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
প্রসিকিউশনের আবেদনের ওপর শুনানি শেষে গতকাল রোববার ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। প্রসিকিউশনের আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও গাজী এমএইচ তামিম।
এর আগে গত ৭ সেপ্টেম্বর সকালে ৯৪ বছর বয়সে মারা যান বামপন্থী রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলার সাক্ষী হিসেবে তিনি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দি দিয়েছিলেন। এর পর ৮ সেপ্টেম্বর প্রসিকিউটর মো. মিজানুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, তদন্ত কর্মকর্তার কাছে বদরুদ্দীন উমর যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন, সেটি গ্রহণের জন্য ট্রাইব্যুনালে আবেদন করবে প্রসিকিউশন।
বদরুদ্দীন উমর জবানবন্দি দিতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রাসঙ্গিক নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। শেখ মুজিব ও হাসিনার রাজনীতি ও রাষ্ট্র শাসন সম্পর্কে নিজের মূল্যায়ন ও দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন তদন্ত সংস্থার কাছে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীরের কাছে এই জবানবন্দি দেন সদ্য মরহুম বদরুদ্দীন উমর।
আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণ ৭ অক্টোবর : জুলাই-আগস্ট আন্দোলন ঘিরে আশুলিয়ায় ৬জনের লাশ পোড়ানোসহ সাতজনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক এমপি সাইফুল ইসলামসহ ১৬ আসামির বিরুদ্ধে সপ্তম দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে।
গতকাল রোববার বিকেলে ট্রাইব্যুনাল ২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেন। এ মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ৭ অক্টোবর দিন ধার্য করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
এদিন বেলা সোয়া ১১টায় ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ শুরু হয়। প্রথমেই জুলাই-আগস্টে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে হওয়া পৃথক দুই মামলার শুনানি হয়। এরপর আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর মামলায় জবানবন্দি দেওয়া ৯ নম্বর সাক্ষী একাত্তর টিভির স্থানীয় সাংবাদিক জাহিদুল ইসলাম অনিককে জেরা করেন পলাতক আট আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত দুই স্টেট ডিফেন্সসহ আইনজীবীরা। বিকেল ৫টার পর পর্যন্ত তার জেরা চলে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্য দিয়েছেন অনিক।
গতকাল ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ ও সাইমুম রেজা তালুকদার। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর আবদুস সোবহান তরফদার ও সহিদুল ইসলাম।
এর আগে, ২৫ সেপ্টেম্বর ষষ্ঠ দিনের মতো জবানবন্দি দেন দুজন। তবে অনিকের জেরা শেষ না হওয়ায় গতকাল পর্যন্ত মুলতবি করা হয়। ২৪ সেপ্টেম্বর প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সাক্ষ্য দেওয়া শফিকুল ইসলামকে জেরা করেন স্টেট ডিফেন্স ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। এরপরই আট নম্বর সাক্ষীর জবানবন্দি নেওয়া হয়।
এর আগে গত ২৩ সেপ্টেম্বর এ মামলায় সাত নম্বর সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন শফিকুল। একই দিন সাক্ষ্য দেন প্রত্যক্ষদর্শী মতিবর রহমান। ১৮ সেপ্টেম্বর এ মামলার তৃতীয় দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্য দেন দুজন সাক্ষী। ১৫ সেপ্টেম্বর প্রথম দিনের মতো এ মামলায় সাক্ষ্য দেন শহীদ আস সাবুরের ভাই রেজওয়ানুল ইসলাম ও শহীদ সাজ্জাদ হোসেন সজলের বাবা মো. খলিলুর রহমান।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর মামলার সূচনা বক্তব্য উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি গত বছরের ৫ আগস্ট আশুলিয়ার সেই বর্বরোচিত হত্যাকা-ের বর্ণনা তুলে ধরেন। ২১ আগস্ট এ মামলায় ১৬ আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
ওই সময় উপস্থিত আট আসামির সাতজনই নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। তবে দোষ স্বীকার করেছেন এসআই শেখ আবজালুল হক। একইসঙ্গে রাজসাক্ষী হতে চেয়ে মামলার ব্যাপারে যা জানেন সব আদালতের কাছে বলতে চেয়েছেন। পরে তার দোষ স্বীকারের অংশটুকু রেকর্ড করেন ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া রাজসাক্ষী হতে চাওয়া নিয়ে লিখিত আবেদন করতে বলা হয়। লিখিত আবেদনের পর রাজসাক্ষী হন তিনি।
এ মামলায় গ্রেপ্তার আসামিরা হলেন- ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. আব্দুল্লাহিল কাফী, ঢাকা জেলা পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহিদুল ইসলাম, পরিদর্শক আরাফাত হোসেন, এসআই মালেক, এসআই আরাফাত উদ্দিন, এএসআই কামরুল হাসান, আবজাল ও কনস্টেবল মুকুল। তবে সাবেক এমপি সাইফুলসহ আটজন এখনও পলাতক রয়েছেন।
গত ২ জুলাই মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জমা দেয় প্রসিকিউশন। আনুষ্ঠানিক অভিযোগের সঙ্গে অন্যান্য তথ্যসূত্র হিসেবে ৩১৩ পৃষ্ঠা, সাক্ষী ৬২, দালিলিক প্রমাণাদি ১৬৮ পৃষ্ঠা ও দুটি পেনড্রাইভ যুক্ত করা হয়। পরে এ মামলায় ১৬ জনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।
গত বছরের ৫ আগস্ট সাভারের আশুলিয়ায় পুলিশের গুলীতে প্রাণ হারান ছয় তরুণ। এরপর পুলিশ ভ্যানে তাদের লাশ তুলে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। নৃশংস এ ঘটনার সময় একজন জীবিত ছিলেন। কিন্তু তাকেও বাঁচতে দেননি তারা। পেট্রোল ঢেলে জীবন্ত মানুষকেই পুড়িয়ে মারা হয়।
এ ঘটনায় গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করা হয়।