গত শুক্রবার ঘটে যাওয়া এ যাবৎকালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর শনিবার আরও তিনদফা ভূকম্পনের ঘটনায় দেশব্যাপী আতংক এখনো কাটেনি। অনেকেই এখনো শুক্রবারের কথা মনে করে উৎকন্ঠায় দিনাতিপাত করছেন। বিশেষ করে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নিয়ে খুবই চিন্তিত। অধিকাংশ অভিভাবক গতকাল রোববার তাদের সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাননি। যারা পাঠিয়েছেন তারা সন্তানদের ভূমিকম্প হলে কি করতে হবে, তা বলে দিয়েছেন। এদিকে ভূমিকম্পের ঘটনায় বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া কয়েকটির পরীক্ষা বন্ধ রাখা হয়েছে।

শুক্রবার (২১ নভেম্বর) আচমকা এক ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে পুরো দেশ। সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে আঘাত হানে ৫.৭ মাত্রার এ ভূমিকম্প। মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতি পাল্টে যায়, দেশজুড়ে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে চরম ভীতি ও আতঙ্ক।

ভূমিকম্প পরবর্তী ছোট ছোট কম্পন বা ‘আফটারশক’ নিয়ে মানুষের মনে আতঙ্ক রয়ে গিয়েছে। ঢাকার এক বেসরকারি চাকরিজীবী নারী জানান, আফটরশকের আশঙ্কায় তার পরিবার এখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তিনি বলেন, পরিবারের সবাই সারাক্ষণ খবরের আপডেট নিচ্ছে। ঢাকার বাইরের আত্মীয়স্বজনরা আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে খোঁজ নিচ্ছেন। কেউ কেউ জরুরি পরিস্থিতির জন্য হাতের কাছে বাঁশি প্রস্তুত রেখেছেন।

পরিবারের বাইরে থাকা শিক্ষার্থীরাও চরম ভীতির মধ্যে পড়েছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) তারামন বিবি হলের আবাসিক শিক্ষার্থী আনিকা রহমান অর্পা জানান, ঠিকমতো ঘুমাতে পারছি না। ভয় হয়, হয়তো ঘুম থেকে ওঠার আগেই ভবনটি ধসে পড়বে।

জানা গেছে, ভূকম্পনের আঘাতে দেশের অনেক স্থানে ভবন, সড়ক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ফাটল দেখা দিয়েছে। দুইদিন পেরিয়ে গেলেও জনমনে আতঙ্ক এখনো কাটেনি। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি অণ্যদিনের তুলনায় কম। নরসিংদীতে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হযেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে বসবাসরত শিক্ষার্থীদের জন্য ওপরের তলা থেকে দ্রুত নিচে নেমে আসাটা বড় চ্যালেঞ্জ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজিলাতুন্নেছা হলের আবাসিক শিক্ষার্থী শ্রাবণী জামান জ্যোতি বলেন, মনে হচ্ছে আমরা যেন এক মৃত্যুকূপের মধ্যে বসবাস করছি। ভূমিকম্পের সময় ওপরের তলায় থাকা মেয়েরা সবচেয়ে বেশি আথংকের মধ্যে রয়েছেন। বেশ কয়েকবার ছোট ছোট কম্পন আমাদের আরও বেশি ভীত করে তুলেছে। তিনি জানান, নিরাপদে বের হওয়াটা অত্যন্ত কঠিন, কারণ এ সময় লিফট ব্যবহার করা যায় না এবং জরুরি সিঁড়িগুলো তার রুম থেকে অনেক দূরে।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ভূমিকম্পের পর অবকাঠামোগত উন্নতির বিষয়টি যেমন জরুরি, তেমনি মানসিক আঘাত বা ট্রমা প্রশমন করাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. শাহানুর হোসেন বলেন, মানুষ প্রায়ই ট্রমা নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা করে। তিনি বলেন, যেকোনো ঘটনা যত বেশি আলোচনা বা স্মরণ করা হয়, মানুষের স্মৃতিতে তা তত বেশি স্থায়ী হয়ে যায়। তাই এ অভিজ্ঞতাটিকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করার জন্য সচেতনভাবে চেষ্টা করতে হবে। অবকাঠামোগত ঝুঁকি নিয়ে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।

ভয় কাটাতে তিনি কিছু পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন। তিনি জানান, শিশুদের ভয় দূর করতে তাদের বাইরে খেলাধুলায় উৎসাহিত করা যেতে পারে। পাশাপাশি তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব সম্পর্কেও সতর্ক করে দেন। সেখানে ছড়িয়ে পড়া এ সংশ্লিষ্ট ভিডিও বা কনটেন্ট মানুষের মধ্যে ‘ সেকেন্ডারি ট্রমা’ তৈরি করতে পারে। তাই ভয় বা অনিশ্চয়তা বাড়ায়- এমন কনটেন্ট প্রচার নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা থাকা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ভূমিকম্পের মত দুর্যোগের পর মানসিক ধাক্কা খাওয়া যেকোনো মানুষের জন্য স্বাভাবিক। একে দুর্বলতা হিসেবে দেখা উচিত নয়। তিনি বলেন, প্রাকৃতিক বা মানুষের তৈরি করা যেকোনো আকস্মিক দুর্যোগ মানুষের মনে ভীতি সৃষ্টি করে, যা থেকে অনেক সময় প্যানিক তৈরি হয়। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের মানুষ বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে যতটা পরিচিত, ভূমিকম্পের সঙ্গে ততটা পরিচিত নয়। তাই বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে আমরা মানিয়ে নিতে শিখেছি, কিন্তু ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে তা পারিনি। এ অপরিচিত বিষয়টি আমাদের মনের উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, যারা ‘প্যানিক অ্যাটাকে ভুগছেন, তাদের জন্য কাউন্সিলিং বা চিকিৎসাসেবা সহায়ক হতে পারে। তবে জনসচেতনতা বাড়ানোও সমানভাবে জরুরি, যাতে এমন কঠিন পরিস্থিতিতে মানুষ শান্ত থাকতে পারে। তিনি পরামর্শ দেন, যারা আতঙ্কে ভুগছেন তাদের স্বাভাবিক রুটিন মেনে চলতে হবে। দৈনন্দিন কাজ ও বিনোদনমূলক অভ্যাসগুলো চালিয়ে যেতে হবে। যদি লক্ষণগুলো তীব্র হয়, তবে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

গবেষণায় দেখা গেছে, ভূমিকম্পে বেঁচে যাওয়া মানুষেরা প্রায়ই ট্রমা, ভয় এবং ঘটনা অস্বীকার করার মত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যান। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞরা অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করা, আবেগ প্রকাশ করা এবং সামাজিক সহায়তা নেওয়ার পরামর্শ দেন। এতে ‘পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার’ (পিটিএসডি), বিষণ্নতা এবং উদ্বেগের মতো দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়।

এদিকে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে বারবার ভূমিকম্পের কারণে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পর এবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) চারদিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে সোমবার সকাল ১০টার মধ্যে ছাত্রীদের হল ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গতকাল রোববার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জরুরি এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, আমরা আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ ঘোষণা করেছি। অর্থাৎ ২৭ তারিখ পর্যন্ত সকল ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ থাকবে।আমরা একটি তদারকি কমিটি গঠন করেছি। বিশেষজ্ঞ দ্বারা আমাদের ভবনগুলো পরীক্ষা করা হবে। ৪ ডিসেম্বরের মধ্যে এই রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। রিপোর্ট সাপেক্ষে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর মধ্যে ৩০ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনলাইনে ক্লাস চলবে।

এর আগে, গতকাল শনিবার ১৫ দিনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং গতকাল বিকেল ৫টার মধ্যে শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল ছাড়তে বলা হয়। ভূমিকম্প সতর্কতায় রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের গতকাল রোববারের সব পরীক্ষা স্থগিত রাখা হয়েছে। ভিকারুননিসার প্রথম থেকে নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা এবং একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিশেষ কুইজ প্রতিযোগিতা হওয়ার কথা ছিল। তবে কলেজ শাখার একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পাঠদান কার্যক্রম যথারীতি চলবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করা হলো।