আজ ১৬ জুলাই বুধবার। ২০২৪ সালের এদিনটি ছিল মঙ্গলবার। এদিন বাংলাদেশে একটা স্ফুলিঙ্গ ঘটে। প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ। যা এর আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটেনি। সমন্ত অন্যায় অনাচার আর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দেওয়ার স্ফুলিঙ্গ। বন্দুকের সামনে জীবন বিলিয়ে দিয়ে প্রতিবাদ করার স্ফুলিঙ্গ। আবু সাঈদ। হ্যাঁ, রংপুরের কৃতী সন্তান বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী আবু সাঈদের বন্দুকের সামনে বুক চিতিয়ে দিয়ে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করার স্ফুলিঙ্গ দেশ ও বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এ প্রতিবাদের প্রখরতা স্বৈরাচারের মসনদ টলিয়ে দেয়। বিদায় ঘণ্টা বাজিয়ে দেয় ১৬ বছরের একগুঁয়েমি ও আধিপত্যের দোসর হাসিনার ক্ষমতার তখতের। এদিন রংপুরে আন্দোলনকারী বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের বুলেটে নিহত হওয়ার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে। স্বাধীনতার আগ থেকেই এই দেশে বহু প্রতিবাদ হয়েছে। প্রতিবাদের ভাষা যে এমন হতে পারে তা কেউ দেখেছে বলে আজো উচ্চারিত হয়নি কোন বিপ্লবীর মুখে। এভাবে বন্দুকের মুখে বুক চিতিয়ে দিয়ে প্রতিবাদ করার ভাষা কেউ দেখেছে বলেও জানা নেই কারো। আবু সাঈদের সাহসিকতা আর প্রতিবাদের ভাষার কাছে অতীতের সব প্রতিবাদের ভাষা হার মেনে যায়। ছাত্র-জনতার অন্তর থেকে সব ভয় দূর করে দেয় বিপ্লবী শহীদ আবু সাঈদ। জানিয়ে দেয়, হে বাংলার দামাল ছেলেরা স্বৈরাচার সহ্য করার সময় নাই আর।

এদিন বিকালে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে খুব কাছে থেকে পর পর তিনবার গুলী করে হত্যা করে পুলিশ। ভিডিওতে দেখা যায় আবু সাঈদ বন্দুকের সামনে বুক চিতিয়ে দিয়েছে। সেদিন আবু সাঈদের পাশে থাকা আয়ানের বয়ান থেকে জানা যায়, পর পর দুইবার গুলী করা হয় আবু সাঈদকে। তখন রাস্তায় বসে পড়লে দৌড়ে আসে আয়ান। আবু সাঈদকে মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তার মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য রিকশার ওপর তৃতীয়বার গুলী চালায় একজন হেলমেটধারী পুলিশ। পরম বাস্তবতা হলো সেই ঘাতক পুলিশকে এখনো চিহ্নিত করা যায় নি।

রংপুরে এদিন আবু সাঈদের বুক চিতিয়ে দিয়ে বন্দুকের সামনে দাঁড়ানোতে পুরোদেশের আন্দোলনকারীরা নড়েচড়ে বসে। তার এই বুক চিতিয়ে দেওয়ার দৃশ্য লাখ লাখ আবু সাঈদের জন্ম দেয়। রাজপথে নেমে আসে লাখো আবু সাঈদ। পুরোদেশ গরম হয়ে ওঠে। পুরো দুনিয়াজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়িয়ে বিস্ফোরণ ঘটে দেশ বিদেশের আনাচে কানাচে। নারী পুরুষ নির্বিশেষে লোকজন রাস্তায় নেমে আসে। সেদিন আবু সাঈদ ছাড়াও আরও কয়েকজনকে হত্যা করে নরপিশাচরা।

বলা হয়ে থাকে, স্বৈরাচার হাসিনার জন্য দিনটি ছিল ভয়ানক আতংকের। ১৬ জুলাই দুনিয়া কাঁপানো বিস্ফোরণের দিন। ‘ছাত্রলীগ মনে করেছিল ১৫ জুলাইয়ে হামলা করেই আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া যাবে। কিন্তু ১৬ জুলাই আরও বেশি শিক্ষার্থী শহীদ মিনারে জড়ো হয়। সবাই একত্রিত হওয়ার পর বিক্ষোভ মিছিল করে শিক্ষার্থীরা।

১৬ জুলাই দুপুরে অনলাইন মিটিং করেন নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, আসিফ মাহমুদ, বাকের, হাসিব থেকে শুরু করে নেতৃস্থানীয়রা। এসময় খবর আসে যে, রংপুরে আবু সাঈদকে পুলিশ গুলী করে হত্যা করেছে। তখন মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় আর কোনো সংলাপ হবে না। রক্ত মাড়িয়ে কোনো সংলাপ নয়। এদিন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন। নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে বুধবার গায়েবানা জানাযা ও কফিন মিছিল করবেন বলে জানিয়ে দেওয়া হয়।

মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টা ২০ মিনিটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে এই কর্মসূচির ঘোষণা দেন কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ। ফেসবুক পোস্টে আসিফ মাহমুদ লেখেন, পুলিশ-ছাত্রলীগের যৌথ হামলা ও গুলীবর্ষণে শহীদদের জন্য গায়েবানা জানাযা ও কফিন মিছিল করবেন তাঁরা। বুধবার বেলা দুইটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এই কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকায় অবস্থানরত সবাইকে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে যাওয়ার অনুরোধ জানান তিনি। একই সঙ্গে সারা দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, জেলায় জেলায় গায়েবানা জানাযা ও কফিন মিছিল কর্মসূচি পালনের জন্য আন্দোলনকারীদের প্রতি আহ্বান জানান আসিফ মাহমুদ।

এর আগে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা বিকেলে শহীদ মিনারে সমাবেশ করেন। এরপর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবনের দিকে যাওয়ার ঘোষণা দেন। ভিসির বাসভবনের সামনে কিছুক্ষণ অবস্থানের পর দিনের কর্মসূচি সমাপ্তির ঘোষণা দেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়কারী হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, রাতে আলোচনা করে ঘোষণা করা হবে। হাসনাত আবদুল্লাহর এই বক্তব্যের পর রাত নয়টার দিকে আন্দোলনকারীরা ভিসির বাসভবনের সামনে থেকে চলে যেতে থাকেন।

১৬ জুলাই ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, আন্দোলন যাবে, আন্দোলন আসবে। কিন্তু ছাত্রলীগ থাকবে। সবকিছুই মনে রাখা হবে এবং জবাব দেওয়া হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সংঘর্ষে কমপক্ষে ছয়জন নিহত হয়। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিতাড়ন করে ‘রাজনীতিমুক্ত’ ঘোষণা করে আন্দোলনকারীরা। বন্ধ করে দেওয়া হয় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ছয় জেলায় মোতায়েন করা হয় বিজিবি।

১৬ জুলাই সারাদেশে শিক্ষার্থীরা ব্যাপক বিক্ষোভ করে। আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ ক্ষমতাসীন দলের লোকজন হামলা চালায়। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের তুমুল সংঘর্ষে অন্তত ছয়জন নিহত হয়। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ নিহত হওয়ার ফুটেজ ও ছবি এদিন ভাইরাল হওয়ায় রাতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা পাল্টা লড়াই করে ছাত্রলীগকে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাড়িয়ে দেয়। তারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নেতাদের কক্ষ ভাংচুর করার পাশাপাশি ঢাবি ও রাবি হলের বেশির ভাগ হলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। এর প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনার সরকার দেশব্যাপী স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়। তবে পরদিন গায়েবানা জানাযা ও কফিন মিছিলের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে শিক্ষার্থীরা।

১৬ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে সমাবেশ করে ছাত্রলীগ। অন্যদিকে শহীদ মিনারে সমাবেশ করে বৈষম্য বিরোধী শিক্ষার্থীরা। আবু সাঈদের হত্যার খবরে শহীদমিনারে অবস্থান নেওয়া শিক্ষার্থীদের রক্ত টগবগিয়ে ওঠে। প্রতিশোধের স্পৃহা তাদের মধ্যে কাজ করতে থাকে। সবাই প্রস্তুতি নেয় রাজু ভাষ্কর্যের দিকে যাবে বলে। আসিফ মাহমুদ জানান দেয় হাজার হাজার শিক্ষার্থী প্রস্তুত, তারা যেভাবেই হোক রাজু ভাস্কর্যে যাবে। তখন একজন সমন্বয়ককে দায়িত্ব দেওয়া হয় বিএনপির হাই কমান্ড, ভিপি নুরুল হক ও ছাত্রশিবিরের সাথে যোগাযোগ করার জন্য। তাদের প্রস্তাব দেওয়া হয় যেন, শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনার থেকে রাজু ভাস্কর্যের উদ্দেশে গেলে অন্যান্য দল বা সংগঠনগুলোও যেন প্রস্তুত থাকে।

সেদিন ছাত্রলীগ স্বশস্ত্র প্রস্তুতি নিয়েই রাজু ভাস্কর্যে অবস্থান করে। তখন ছাত্রলীগের প্রস্তুতির খবর পাওয়ার জন্য একজন সাংবাদিককে ব্যবহার করা হয়। রাজু ভাস্কর্যের পরিস্থিতি দেখার জন্য সেখানে পাঠানো হয়।

অবশেষে হতাহত এবং পারিপার্শ্বিক চিন্তা করে রাজুভাষ্কর্যে যাওয়ার চিন্তা বাদ দেওয়া হয়। তবে এটা মনে করা হয় যে সেদিন ঢাবি শিক্ষার্থীদের দখলে চলে গেলে ইতিহাস অন্যরকম হতো।

১৬ জুলাই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করতে গেলে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশ ছাত্রছাত্রীদের ওপর গুলীবর্ষণ করলে উত্তেজিত ছাত্র-জনতা সদর দক্ষিণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার গাড়িতে আগুন দেয়, যা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৬ জুলাই বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সাথে সহিংসতায় মঙ্গলবার সারা দেশে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে শিক্ষার্থী ও পথচারী রয়েছে। ১৬ জুলাই মঙ্গলবার সকালে ঢাকাসহ সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করতে শুরু করে। ফলে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বগুড়াসহ অনেক শহরের প্রধান সড়কগুলো অচল হয়ে যায় এবং মহাসড়কেও যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরাও সড়কে অবস্থান নেয়ায় কয়েকটি স্থানে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। অনেক স্থানে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। ছাত্রলীগ কর্মীদের সাথে তাদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, ইট পাটকেল নিক্ষেপের মতো ঘটনা ঘটে। রংপুরে লাঠিচার্জ ও গুলী করে পুলিশ ।

যুক্তরাষ্ট্র এবং অ্যামনেস্টির নিন্দা

এদিকে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা এবং সহিংসতার ঘটনায় নিন্দা জানায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেন, বাংলাদেশের চলমান শিক্ষার্থী বিক্ষোভের ঘটনা তারা পর্যবেক্ষণ করছেন। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে যে কোন ধরনের সহিংসতার নিন্দা জানান তিনি। তিনি বলেন, আমরা ঢাকা ও বাংলাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়া শিক্ষার্থী বিক্ষোভের বিষয়ে সচেতন আছি ও পর্যবেক্ষণ করছি, যেখানে দুজন নিহত হয়েছে এবং শত শত আহত হয়েছে। তবে মি. মিলার দুইজন নিহত হবার যে তথ্য দিয়েছেন, তা বিবিসি নিশ্চিত করতে পারেনি। ওদিকে, মি. মিলারের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মি. মিলার বলেন, “মতপ্রকাশ ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা যেকোনো ক্রমবিকাশমান গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য বিষয়। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে যেকোনো সহিংসতার নিন্দা জানাই। যারা সহিংসতার শিকার হয়েছেন, তাদের প্রতি সমবেদনাও জানান মি. মিলার।

এদিকে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলী সাবরিন মঙ্গলবার দুপুরে এক বিবৃতিতে বলেন, “মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে দুইজনের মৃত্যুর যে দাবি করেছেন, তার স্বপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। যাচাই না করে ভিত্তিহীন তথ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এমন মন্তব্য সহিংসতাকে উসকে দিতে পারে।

অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সারাদেশে কোটা বিরোধী বিক্ষোভে হামলার তীব্র নিন্দা জানায়। সংস্থাটি 'বিক্ষোভকারীদের পূর্ণ নিরাপত্তা এবং আহতদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য' সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।

সারাদেশের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভ কর্মসূচির অংশ হিসেবে মঙ্গলবার দুপুর দুইটার দিক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা মিছিলসহ ঢুকতে শুরু করে। নানা ধরনের পোস্টার, প্লাকার্ড হাতে নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রবেশ করতে দেখা যায়।

এদিকে, ঢাকার নতুন বাজার এলাকা ছাড়াও প্রগতি সরণি, বনানী, উত্তরা এলাকায় সড়ক অবরোধ করে অবস্থান নেয় বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে প্রগতি সরণি অবরোধ করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। রামপুরা ব্রিজ এলাকায় থাকা বিবিসির সংবাদদাতা মুকিমুল আহসান জানান, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা এসে রামপুরা ব্রিজের ওপর অবস্থান নেয়ায় রাস্তার দু’পাশেই যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া, বনানীর কাকলি এলাকায় সড়কে অবস্থান নেয় প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। একারণে শহরের ব্যস্ততম এলাকাটিতে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। একই পরিস্থিতি তৈরি হয় নগরীর আরেক ব্যস্ত এলাকা মিরপুর-১০ গোলচত্বরে। সেখানেও আশেপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেয়।

এদিকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিসির সংবাদদাতা আবুল কালাম আজাদ জানান, পুরো ক্যাম্পাসই এখন শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণে এবং তারা লাঠিসোঁটা নিয়ে মিছিল করছে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট মিটিং চলছে এখন।

এছাড়া, ঢাকার বাইরে ময়মনসিংহে টাউন হল এলাকায় সড়ক অবরোধ করে অবস্থান নেয় কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। ফলে শহরের ভেতরে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আর ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে কয়েকটি এলাকা প্রদক্ষিণ করে কলেজের সামনের সড়কে অবস্থান নেয়। রাজশাহীতে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের রাস্তায় অবস্থানের খবর পাওয়া যায়। ঝিনাইদহে একটি স্কুলের মাঠে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা হয় এবং এ ঘটনায় কয়েকজন আহত হয়।

এদিন ভয়েস অব আমেরিকার খবরে বলা হয়, বাংলাদেশে চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলন এখন সারাদেশের ক্যাম্পাস ছাড়িয়ে নগর ও সড়ক-মহাসড়কে বিস্তৃত হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে হামলার ঘটনা ঘটেছে। কোথাও কোথাও সহিংসতা দেখা গেছে। বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ হয়েছে। চট্টগ্রাম ও রংপুরে চারজন নিহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। আর, ঢাকায় মারা গেছে একজন। অন্যদিকে, ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মিছিলে হামলা হয়েছে। এ ঘটনায় গুলীবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছে ৪ জন।

চট্টগ্রামে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো অনেকে। মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) নগরীর ষোলশহর থেকে মুরাদপুর এলাকার মধ্যে এ ঘটনা ঘটে। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, নিহতদের মরদেহ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। তিনি আরো জানান, নিহতদের মধ্যে রয়েছেন চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র আকরাম (২৪) ও পথচারী ফারুক (৩৫)। অন্য নিহত ব্যক্তির পরিচয় এখনো জানা যায়নি বলে জানান তিনি। ফারুকের শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তবে, আকরামের শরীরে দৃশ্যমান কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি বলে জানান পুলিশ কমিশনার। ফলে তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ কমিশনার সাইফুল ইসলাম বলেন, ষোলশহরের ২ নম্বর গেট ও মুরাদপুরসহ নগরীর একাধিক স্থানে সংঘর্ষ হয়েছে। ফলে ঠিক কোন স্থানে মৃত্যুগুলো হয়েছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীনও মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন। মঙ্গলবার বিকেল ৪ টার দিকে দ্বিতীয় দিনের মতো সংঘর্ষ শুরু হয়। পুরো ষোলশহর ২ নম্বর গেইট থেকে মুরাদপুর পর্যন্ত পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলে। এর আগে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলনে বিকাল ৩টা থেকে ষোলশহর স্টেশনে সমবেত হওয়া শুরু করে। এরপর তারা বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। অন্যদিকে, চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনির নেতৃত্বে ছাত্রলীগের একটি অংশ মিছিল নিয়ে দুই নম্বর গেট থেকে মুরাদপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এরপর বিকেল ৪ টার দিকে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ শুরু হয়। এসময় উভয় পক্ষের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনায় পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। থেমে থেমে ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে; কারো কারো হাতে অস্ত্রও দেখা যায়।

ঘটনাস্থলে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের অবস্থান চোখে পড়েনি। নগরীরর কেজিডিসিএল কার্যালয়ের সামনে পুলিশ সদস্যরা অবস্থান করে। মঙ্গলবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত মুরাদপুর-ষোলশহরে সংঘর্ষ চলে। আন্দোলনকারীরা বলেন, তারা মুরাদপুর হয়ে অবস্থান কর্মসূচি সফল করতে ষোলশহর এলাকায় যাওয়ার পথে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের ওপর হামলা করে। এরপর তারা আত্মরক্ষার্থে পাল্টা হামলা চালান। এসময় তাদের পক্ষের ২ জন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয় বলে জানান আন্দোলনকারীরা।

এদিকে, রংপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী নিহত হন। নিহত আবু সাঈদ রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে।

এদিন বিকেলে রাজধানীর ঢাকা কলেজের সামনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় নিহত হন এক যুবক। তার মাথায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। নিহত যুবককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। তবে এখনো তার পরিচয় জানা যায়নি। পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার মো. রিফাতুল ইসলাম জানান, বিকেলে ঢাকা কলেজের সামনের সড়কে একদল লোক এক ব্যক্তিকে পেটাতে দেখেন তিনি। পরে জানতে পারেন যে, সেই ব্যক্তি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন।

কোটা সংস্কারের দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের সামনে আন্দোলনরত চার শিক্ষার্থী গুলীবিদ্ধ হন। মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) এই শিক্ষার্থীদের গুলী করে আহত করা হয়। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তারা যখন রায়সাহেব বাজারের দিকে যাচ্ছিলেন তখন একটি গলি থেকে গুলী ছোঁড়া হয়, এতে চার শিক্ষার্থী আহত হয়। এদের মধ্যে ব্যবস্থাপনা বিভাগের ফেরদৌস আহমেদ ও অনিক গুরুতর আহত হন। আহতদের ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

ঢাকা কোতোয়ালি জোনের এএসপি নজরুল বলেন, গুলীর খবর শুনেছি। কিন্তু আমরা দেখলাম মাত্র একটি দল মিছিল করছে। আমরা হামলাকারীকে দেখিনি। ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ইনচার্জ ডা. আরিফ জানান, গুলীবিদ্ধ চার শিক্ষার্থীসহ আরো একজন আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে আনা হয়। গুলীবিদ্ধ শিক্ষার্থীদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে এবং অন্য আহত শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে বলে জানান ডা. আরিফ।