আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল বুধবার নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রেস সচিব শফিকুল আলম। প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় দুই ঘণ্টার অধিক সময় ধরে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। পরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এ নিয়ে ব্রিফিং করেন প্রেস সচিব।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ার ডিসইনফরমেশন, নির্বাচনের আগে গুরুত্বপূর্ণ পদায়ন, নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টার বৈঠক হয়। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, নির্বাচন বানচালে দেশের ভেতর ও বাহিরে থেকে অনেক শক্তি কাজ করবে। ছোটখাটো নয়, বড় শক্তির কাছ থেকে আক্রমণ চলে আসতে পারে। এই নির্বাচন চ্যালেঞ্জিং হবে। যত ঝড় আসুক না কেন, আমাদের সেটা অতিক্রম করতে হবে। আগামী ১৫ নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচনসংক্রান্ত প্রাথমিক প্রস্তুতি শেষ করতে বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা।
ভুয়া তথ্য ও অপতথ্য মোকাবিলায় দুটি কমিটি হবে
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপতথ্য ও ভুয়া তথ্যের বিষয়ে প্রেস সচিব বলেন, নির্বাচনে ভুয়া তথ্য ও অপতথ্য মোকাবিলায় দুটি কমিটি গঠনের বিষয়ে সভায় আলোচনা হয়েছে। দুটি কমিটিই উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত কাজ করবে এবং তাৎক্ষণিকভাবে ছড়িয়ে পড়া অপতথ্য বা ভুয়া তথ্যের ফ্যাক্ট যাচাই করে তা প্রকাশ করবে। এর জন্য কারিগরি সহায়তা দেওয়ার জন্য আইসিটি মন্ত্রণালয় ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও কথা হবে। আক্রমণ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব শফিকুল বলেন, এই আক্রমণ বলতে শুধু শারীরিক আক্রমণ নয়, বরং সাইবার অ্যাটাক বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ডিজ-ইনফরমেশন (অপতথ্য) ছড়ানোকেও বোঝানো হচ্ছে। যারা পতিত স্বৈরাচার এবং তার দোসর, তারা দেশে একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হোক, তা চাইবে না। এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
প্রেস সচিব জানান, নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন নিয়ে আলাপ হয়েছে। সেনাবাহিনীর তরফ থেকে বলা হয়েছে, ৯২ হাজার ৫০০ জন সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্য মোতায়েন থাকবে। তার মধ্যে ৯০ হাজার সেনা সদস্য, বাকিটা নৌবাহিনী। সেনাবাহিনী বাংলাদেশের প্রত্যেক উপজেলায় এক কোম্পানি করে মোতায়েন থাকবে। এছাড়া নির্বাচনের ৭২ ঘণ্টা আগে এবং নির্বাচনের পরে উদ্ভূত পরিস্থিতি স্থানীয় জনগণ, স্বেচ্ছাসেবক সম্পৃক্ত করে কীভাবে সামলানো যায়; সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ হয়েছে।
সামাজিক মাধ্যমের অপতথ্যের নিয়ন্ত্রণের প্রস্তুতি বিষয়ে প্রেস সচিব বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন- সোশ্যাল মিডিয়ার অপপ্রচার আসবে, নির্বাচনকে বানচাল করার জন্য দেশের ভেতর ও বাহিরে থেকে খুবই পরিকল্পিতভাবে নানা রকম অপপ্রচার চালানো হবে। এআই ছবি-ভিডিও তৈরি করে ছেড়ে দেওয়া হবে। এটাকে সামাল দিতেই হবে। একটা অপপ্রচারের রচনা হওয়া মাত্র সেটা ঠেকাতে হবে, যেন ছড়াতে না পারে। প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, আগামী নির্বাচন সুন্দর ও উৎসবমুখর করতে হলে মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে। নির্বাচনী নীতিমালা, ভোট কেন্দ্রের নিয়ম, কিভাবে ভোট প্রদান করতে হবে, কোথাও বিশৃঙ্খলা হলে কি করতে হবে, এসব বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে। এই আলোকে ইলেকশন কমিশন এবং কালচারাল মিনিস্ট্রিকে টিভিসি বা ডকুমেন্টারি তৈরি করতে হবে।
প্রেস সচিব বলেন,বৈঠকে নির্বাচনকারী নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে- নির্বাচনে আর্মি ও নেভির ৯২ হাজার ৫০০ এর মত সদস্য মোতায়েন থাকবে। এর মধ্যে ৯০ হাজার থাকবে সেনা সদস্য বাকিটা নৌবাহিনী সদস্য। এছাড়া নির্বাচন দিনের ৭২ ঘণ্টা আগে এবং নির্বাচনের ৭২ ঘণ্টা পরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মোকাবিলা বিশেষ প্রস্তুতি থাকবে।
পদায়নের ক্ষেত্রে কর্মকর্তার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, শারীরিক যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা, গণমাধ্যমে অনিয়মের প্রতিবেদন হয়েছে কি না, তা দেখা হবে বলে জানান শফিকুল আলম। তিনি বলেন, সবচেয়ে ফিট কর্মকর্তাকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় পদায়ন করা হবে। তবে নিজ জেলা বা শ্বশুরবাড়ির এলাকায় কাউকে পদায়ন করা হবে না। তাঁদের কোনো আত্মীয়স্বজন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কি না, পদায়নের ক্ষেত্রে সে বিষয়েও লক্ষ রাখা হবে। আগামী ১ নভেম্বর এগুলো শুরু হবে। শফিকুল আলম আরও বলেন, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও সভায় জানিয়েছেন যে পুলিশের পদায়নের বিষয়েও একইভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৬৪ জেলার এসপিদের তালিকা করা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন,সবচেয়ে যোগ্য লোকগুলোকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নিয়োগ করতে হবে। বিগত তিনটি নির্বাচনে ডিসি, এডিসি ও নির্বাহী কর্মকর্তা ও ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তাদেরকে এবারে নির্বাচনে যুক্ত না রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান প্রেস সচিব।
পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার নেওয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার গ্রহণের বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বলতে পারবেন। আর আজকের সাক্ষাৎকার (রয়টার্স) আমরা আগে পড়ি, তারপর এ বিষয়ে মন্তব্য করতে পারবো।
প্রেস সচিব বলেন, একটা বিষয়ে আমরা বারবার বলছিÑ এটা জাতিসংঘের রিপোর্টেও প্রমাণিত যে এই একবিংশ শতাব্দীতে ওনার (শেখ হাসিনা) চেয়ে বড় খুনি বা মানবাধিকার লঙ্ঘন, এরকম ভয়ানকভাবে কেউ করেননি। এটা আমরা বারবার বলছি এবং এটা জাতিসংঘের রিপোর্টেও স্পষ্টভাবে এসেছে। পরবর্তীকালে আল জাজিরা তাদের এক ঘণ্টার একটা প্রোগ্রাম করেছে, সেখানে দেখা গেছে যেÑ উনি খুন করার নির্দেশ দিচ্ছেন। যারা ওনাকে ইন্টারভিউ করছেন, আমরা মনে করি, অবশ্যই এই কনটেক্সট (পটভূমি) যেন কেউ ভুলে না যান। আমরা এটা দেখছি, উনি যেই দাবিগুলো করেন, সেটা যেন আনকনটেক্সট না থাকে। গতকাল (মঙ্গলবার) একটা স্থানীয় মিডিয়ায় দেখলাম, আন্তর্জাতিক আদালতে তার দল একটা... সেখানে তিনি যে ভয়ানক রকম মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন, তার কোনো উল্লেখ আমরা সেখানে দেখি নাই। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে শফিকুল আলম বলেন, আমরা ইন্টারভিউ এখনও দেখি নেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ তো কোথাও নাই। আমরা তো আওয়ামী লীগকে দেখি না। দুই-একটা ঝটিকা মিছিল করে, সেই অনুযায়ী কেউ দুই-একটা ডলার পায়।
প্রেস সচিব বলেন, আওয়ামী লীগ দাবি করছে ৪০০ জন মারা গেছে। অভিযোগ যারা জমা দিয়েছেন, আমাদের টাকা চুরি করেছেন, সেই টাকা দিয়ে যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে দামি ল ফার্মকে নিয়োগ করে, এই ধরনের কাজ তারা করছেন। আমাদের দেশের চুরির টাকায় এই কাজটি করেছেন, এটাকেও আবার কেউ কেউ প্রমোট করছেন। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেকোনও পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে প্রস্তুত আছে। নির্বাচন কমিশন সংসদ টিভিকে নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহার করতে চাইছে।
প্রেস সচিব আরও জানান, কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ (ট্রেনিং) নিয়েও সভায় আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে আনসার সদস্যদের প্রশিক্ষণ আরও কার্যকর করার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। বডি ওর্ন ক্যামেরা নিয়েও প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়ে কথা হয়েছে। প্রশিক্ষণসংক্রান্ত ভিডিও ও উপকরণগুলো যেন ১৫ নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট, টিভি বা বিটিভিতে আসে, সে বিষয়ে দ্রুত কাজ করার জন্য বলা হয়েছে। সংসদ অধিবেশন না থাকায় এখন সংসদ টেলিভিশন ব্যবহৃত হচ্ছে না, তাই নির্বাচন কমিশন সংসদ টিভিকে ব্যবহার করে নির্বাচন সম্পর্কিত যাবতীয় প্রচার করতে চাইছে। নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব বলেন, নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে বলেছে যে তারা ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তারিখ জানাবে।
বৈঠকে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বিশেষ সহকারী আব্দুল হাফিজ, বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, মুখ্য সচিব সিরাজউদ্দিন মিয়া, নির্বাচন কমিশন সচিব আখতার আহমেদ, স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গনি, মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশিদ, প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল কামরুল হাসান, পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম, র্যাব মহাপরিচালক একেএম শহিদুর রহমান, ডিজি কোস্টগার্ড রিয়ার এডমিরাল জিয়াউল হকসহ এনএসআই, ডিজিএফআই প্রতিনিধিরা ছিলেন।