আজ ২৯ জুলাই মঙ্গলবার। ২০২৪ সালের এই দিনটি ছিল সোমবার। এদিন আন্দোলন থামাতে মরণ কামড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় স্বৈরাচার হাসিনার সরকার। আন্দোলনকারীদের জঙ্গী আখ্যা দিয়ে তাদের ধরপাকড় করার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মারণাস্ত্র ব্যবহার অব্যাহত রাখে। ছাত্রদের আটক করে তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখা হয়। সেইসাথে বড় ধরনের ক্র্যাকডাউন পরিচালনা করে। কয়েক হাজার শিক্ষার্থী এবং রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আটক করা হয়। সরকার ছাত্র নেতাদের মুক্তির আল্টিমেটাম উপেক্ষা করার পরে ছাত্র এবং জনগণ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বড় আকারের বিক্ষোভ পুনরায় শুরু করে। ঢাকায় ২ হাজার ৮২২ শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশ। এদিন শিক্ষার্থীদের সংহতি জানিয়ে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রাস্তায় নামেন। তারা বৈষম্যবিরোধী নানা স্লোগান দেন।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার খবর অনুযায়ী এদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৪ দলের বৈঠক হয় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে। তাতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে জঙ্গীবাদী কাজ হিসাবে উল্লেখ করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, জামায়াত-শিবির, বিএনপির জঙ্গীরা আমাদের ওপর থাবা দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে যে ঘটনাগুলো ঘটছে, আসলে এটা কোনো রাজনৈতিক কিছু নয়। এটা সম্পূর্ণ জঙ্গিবাদী কাজ। বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ১৪ দলের বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সোমবার সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত ১৪ দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে সূচনা বক্তব্য রাখতে গিয়ে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। বৈঠক শেষে গণভবনের বাইরে সাংবাদিকদের ব্রিফ করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ১৪ দলের বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে উগ্র সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী সংগঠন জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গণভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ১৪ দলের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমু, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছাড়াও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়–য়া ছাড়াও ১৪ দলের ফজলে হোসেন বাদশা, শিরীন আখতার, সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভা-ারী, ডা. শাহাদাত হোসেন, ডা. অসীত বরণ রায়, আওয়ামী লীগের ড. আবদুর রাজ্জাক, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান, মাহবুবউল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলন প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, এদের উদ্দেশ্যটা এখন বোঝা যাচ্ছে যে, কোটা কোনো ইস্যু নয়। একে একে যে কয়টা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের সেবা দেয়, যে কয়টা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান উন্নত করে, সেটাই ধ্বংস করা। তিনি বলেন, আজকে বাংলাদেশের উন্নয়ন হয়েছে, উন্নয়নের ফলে বাংলাদেশ আজকে বিশ্বব্যাপী একটা মর্যাদার আসন পেয়ে গেছে। বাংলাদেশের নাম শুনলে সবাই সমীহ করে চলে। সবাই সম্মানের চোখে দেখে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশকে আমরা তুলে আনতে সক্ষম হয়েছি, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে, অবকাঠামোগত উন্নয়নের মধ্য দিয়ে। বৈঠকে কোটা আন্দোলনের আড়ালে বিএনপি-জামায়াত জোটের ভয়াল ধ্বংসযজ্ঞ-সহিংসতা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস এবং হতাহতের ঘটনা নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি অপশক্তিদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার কৌশল নিয়েও আলোচনা হয়। এর আগে গত ১৯ জুলাই ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে অনুষ্ঠিত ওই সভায় উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে দুষ্কৃতকারীদের আগুনে পুড়ে যাওয়া বনানীর সেতুভবন ও মহাখালীর দুর্যোগ ভবন সোমবার দুপুরে পরিদর্শন করেছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের জোট সঙ্গী ১৪ দলের নেতারা। নিজেদের দেখা সেই ভয়াল ধ্বংসযজ্ঞও আলোচনায় স্থান পায়।
এদিকে বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, আজ আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ১৪ দলের নেতাদের এক জরুরি বৈঠকে দেশের সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত সন্ত্রাস নাশকতা, নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা, জনগণের জানমাল রক্ষার লক্ষ্যে আইন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে জনমনের স্বস্তি ফিরিয়ে আনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান ১৪ দলের নেতারা। পরিপূর্ণ স্বস্তি আনার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সামরিক বাহিনীর অগ্রণী ভূমিকা রাখার জন্য তাদের প্রতিও নেতারা ধন্যবাদ জানান। তিনি আরও বলেন, নেতারা মনে করে বিএনপি-জামায়াত, ছাত্রদল-শিবির এবং তাদের দোসর উগ্রবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তারা সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও হত্যাকা-ের মাধ্যমে দেশকে অকার্যকর করার ষড়যন্ত্র করছে। অতি সম্প্রতি চোরাগোপ্তা হামলা করে এবং গুলিবর্ষণ করে সরকারের ওপর দায় চাপাতে তারা দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। পুলিশ বাহিনীর সদস্যসহ মানুষ হত্যা করে লাশ পর্যন্ত ঝুলিয়ে রেখেছে। এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যে প্রক্রিয়ায় এসব হত্যাকা- ঘটিয়েছে তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। জাতীয় স্বার্থ দেশবিরোধী এ অপশক্তিকে নির্মূল করা প্রয়োজন।
ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, ১৪ দলের এ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়, জামায়াত-শিবির গোষ্ঠীর অপশক্তির রাজনীতি নিষিদ্ধ করার জন্য। তিনি আরও বলেন, ১৪ দল মনে করে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, তাদের শিক্ষাজীবনের সুরক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে সরকারকে পর্যায়ক্রমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। নেতারা মনে করেন কোনো শিক্ষার্থী এবং নিরপরাধ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয় সে বিষয়টিকেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে।বিএনপি-জামায়াত নৈরাজ্যের মাধ্যমে দেশকে অকার্যকর করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। জাতীয় স্বার্থে দেশবিরোধী অপশক্তি নির্মূল করার জন্য ১৪ দলের বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত সরকার দ্রুত বাস্তবায়ন করবে। তরিকত ফেডারেশনের সভাপতি সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভা-ারী বলেন, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ হলে তারা আর সংবাদ সম্মেলন কিংবা অন্য কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি করতে পারবে না। ওদিকে ৬ সমন্বয়ক তখনও ডিবি হেফাজতে।
একইদিন দুপুরে কোটা আন্দোলনকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ অন্যান্য নিহতদের স্মরণে ৩০ জুলাই মঙ্গলবার একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়। এদিন কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘাত-সহিংসতায় নিহতদের স্মরণে রাষ্ট্রীয় শোক পালন করার কথা জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে বিকালে সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, আজকের বৈঠকে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি জানান, আজকের বৈঠকে কোটা আন্দোলন নিয়ে যে পরিস্থিতি হয়েছিল, সে বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। পরে এ নিয়ে আলোচনা হয়। সেই আলোচনার ভিত্তিতে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় এবং আগামীকাল দেশব্যাপী শোক পালনের সিদ্ধান্ত হয়। পরদিন কালো ব্যাজ ধারণ এবং মসজিদে দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হবে। এ ছাড়া মন্দির-গির্জা-প্যাগোডায় বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হবে বলেও জানানো হয়। মো. মাহবুব হোসেন জানান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রোববার এ ঘটনায় ১৪৭ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছিলেন। তারপর আরও তিনজনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে। অর্থাৎ এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা এখন ১৫০। তবে সরকার ঘোষিত মঙ্গলবারের রাষ্ট্রীয় শোক প্রত্যাখ্যান করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। এর বদলে এদিন একক বা ঐক্যবদ্ধভাবে লাল কাপড় মুখে ও চোখে বেঁধে ছবি তোলা এবং অনলাইনে প্রচার কর্মসূচির ঘোষণা করা হয়। ২৯ জুলাই সরকার ছাত্র নেতাদের মুক্তির আল্টিমেটাম উপেক্ষা করার পরে ছাত্র এবং জনগণ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বড় আকারের বিক্ষোভ পুনরায় শুরু করে। ঢাকায় ২ হাজার ৮২২ শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশ। সোমবার ২৯ জুলাই দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার সামনে ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষক সমাবেশ’ হয়। এ সমাবেশে অংশ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক নামের সংগঠনের শিক্ষকেরা এসব দাবি জানান। তাঁরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিটি দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। সমাবেশের শুরুতে আন্দোলন ঘিরে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষ ভাবা হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের খোলনলচে পাল্টে দিতে এসেছেন। স্বাধীনতার পর থেকে গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রে যে লাগাতার নৈরাজ্য চলেছে, হলগুলোয় যে সুপরিকল্পিত নিপীড়ন চলেছে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনেরÑসেই সবকিছু পাল্টে নতুন ইতিহাস লেখার পথ তৈরি করেছেন এই শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের প্রতিটি দাবির প্রতি তাঁরা সমর্থন জানান। আন্দোলন ঘিরে দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যুর ঘটনাকে ‘জুলাই হত্যাকা-’ নামে ডাকার আহ্বান জানান তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেন, ‘ব্লক রেইড’ দিয়ে শিক্ষার্থীদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এটা জেনেও যদি প্রতিবাদ না করা হয়, সেটি হবে অন্যায়। গণমাধ্যমে শুধু একটি দিকের বিবরণ (ন্যারেটিভ) প্রচার করা হচ্ছে যে দেশের সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু জানতে হবে, আসল সম্পদ হচ্ছে মানুষ। যখন ছাত্রছাত্রীদের ওপর গুলি করা হয়, ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন কোনো শিক্ষক ঘরে বসে থাকতে পারেন না। এই নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে। সমাবেশে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আবদুল হাসিব চৌধুরী বলেন, ১৯৬৯ সালে অধ্যাপক শামসুজ্জোহা ছাত্রদের রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন। এখানে যাঁরা (শিক্ষক) জমায়েত হয়েছেন, তাঁরা শহীদ শামসুজ্জোহার উত্তরসূরি। আর শিক্ষার্থীরা যাঁরা অধিকারের জন্য বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, লড়াই করছেন, তাঁরা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরি।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক নাসির উদ্দিন আহমদ বলেন, অযথা মিথ্যা মামলা দিয়ে ঘর থেকে শিক্ষার্থীদের ধরে আনা হচ্ছে। সরকারকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দিন। বাচ্চাদের পড়ালেখায় ফিরে আসতে দিন। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরে আসুন। স্বৈরতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় থেকে দেশের উন্নয়ন তো দূরের কথা, দেশের মানুষের কাছেও কোনো দিন পৌঁছানো যাবে না।
সমাবেশে অন্যদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক রুশাদ ফরিদী, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস ডিসিপ্লিনের শিক্ষক আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরী, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক সাইমুম রেজা তালুকদার প্রমুখ বক্তব্য দেন। সমাবেশ শেষে শিক্ষকেরা মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের জমায়েতস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে যান। সেখান থেকে তাঁরা আবার অপরাজেয় বাংলায় ফিরে আসেন। সমাবেশ শুরুর আগে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে জড়ো হন শিক্ষকেরা। পরে সেখান থেকে অপরাজেয় বাংলার সামনে আসেন তাঁরা।
এদিকে সেদিন্ রাষ্ট্রীয় শোক প্রত্যাখান বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। রাষ্ট্রীয় শোকের পরিবর্তে মঙ্গলবার লাল কাপড় মুখে ও চোখে বেঁধে ছবি তোলা এবং অনলাইনে ব্যাপক প্রচার কর্মসূচি ঘোষণা করে আন্দোলনকারীরা। সোমবার সন্ধ্যায় আন্দোলনের একাংশের সমন্বয়ক মো: মাহিন সরকারের পাঠানো এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানানো হয়। এর বদলে মঙ্গলবার লাল কাপড় মুখে ও চোখে বেঁধে ছবি তোলা এবং অনলাইনে ব্যাপক প্রচার কর্মসূচি ঘোষণা কওে আন্দোলনকারীরা। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতনের বিচার না করে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে প্রতিদিন যে নির্মম উপহাস করা হচ্ছে, তার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় শোককে প্রত্যাখান করে আগামীকাল লাল কাপড় মুখে ও চোখে বেঁধে ছবি তুলা এবং অনলাইনে ব্যাপক প্রচার কর্মসূচি করার জন্য অনুরোধ করছি।’ এতে আরও বলা হয়, ‘আমরা সরকারের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, ছাত্রসমাজের বুকে গুলি চালিয়ে বাংলার ইতিহাসে কোনো আন্দোলন দমন করা যায়নি। অবিলম্বে ছাত্রসমাজের নয় দফা দাবি মেনে নিয়ে দেশকে স্থিতিশীল করুন। প্রসঙ্গত আন্দোলনের কারণে গত ১৭ জুলাই থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সব স্কুল–কলেজসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই দিন থেকে দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও অনির্দিষ্টকাল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সরকারের দাবি, শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিএনপি ও জামায়াত–শিবিরের নেতাকর্মীরা ছদ্মবেশে প্রবেশ করে সহিংসতা উসকে দেয়। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয় রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম বিটিভি, বনানীর সেতুভবন, মহাখালির দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন, মেট্রোরেল স্টেশনসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায়।
পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গত ১৯ জুলাই রাত থেকে সারা দেশে কারফিউ জারি করে সরকার। মাঠে নামানো হয় সেনাবাহিনীর সদস্যদের। সহিংসতার ঘটনায় শুধু রাজধানীতে ২২৯টি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় হাজার হাজার মানুষকে গ্রেফতার দেখানো হয়। এদিন ডিবি কার্যালয়ে ৬ সমন্বয়কের কাছ থেকে বলপূর্বক স্টেটমেন্ট নেওয়ার নিন্দা জানিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেন, ‘ডিবি কার্যালয়ে সমন্বয়কদের জিম্মি করে, ব্ল্যাকমেইল করে এই লিখিত বক্তব্য পাঠ করানো হয়েছে। অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে বিবৃতি আদায় ছাত্রসমাজ মেনে নেবে না।