আগামীতে ক্ষমতায় গেলে প্রথম ১৮০ দিনের অর্থনৈতিক কর্ম পরিকল্পনা কী হবে তা ঘোষণা করেছে বিএনপি। গতকাল বুধবার দুপুরে গুলশানে চেয়ারপার্সনের কার্যালয়ে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী দলের এই কর্মপরিকল্পনার একটা সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন।
তিনি বলেন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা, মানুষের আস্থা অর্জন এবং ভবিষ্যতের জন্য দৃঢ় ভিত্তি গড়তে প্রয়োজন স্বচ্ছ, অংশগ্রহণমূলক ও উদ্ভাবনী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। গতানুগতিকতা ছেড়ে সাহসী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠনের পর প্রথম ১৮০ দিনের(ছয় মাস)মধ্যে আমাদের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা নির্বাচনের আগেই নির্ধারণ করা হবে। এই ১৮০ দিনের পরিকল্পনার ভিত্তিতে একটি অ্যাকশন-ওরিয়েন্টেড রোডম্যাপ প্রণয়ন করা হবে। বিভিন্ন সেক্টরে বিএনপি কী কী পদক্ষেপ গ্রহন করবে আমরা সেগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে চাই।
দলের ১৮০ দিনের ভেতরে শিক্ষা ব্যবস্থা, স্বাস্থসেবা, নারীর ক্ষমতায়, শহীদদের স্বীকৃতি, কৃষিখাত ও গ্রামীন উন্নয়ন, শিল্পখাত, তথ্য প্রযুক্তিখাত, প্রবাসী কল্যাণ, নগর ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ ব্যবস্থাপনা, আইনশৃঙ্খলা এই ১১ টি খাতকে বিএনপি অগ্রাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করে করণীয় ঠিক করার কথা সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরা হয়।
এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান : আমির খসরু বলেন, বিএনপির প্রধান অঙ্গীকার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। সরকার গঠন করলে বিএনপি এক কোটি মানুষের জন্য নতুন কর্মের সংস্থান করবে। তিনি বলেন, সার্বিক উন্নয়ন ও নতুন কর্মসংস্থানের জন্য বিএনপি এবার দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৮ শতাংশ। মূলত ১০টি খাতকে সার্বিক উন্নয়ন তথা কর্মসংস্থানের জন্য বিএনপি পরিকল্পনা তৈরি করেছে। এগুলো হচ্ছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ম্যানুফ্যাকচারিং, কৃষি, বিদেশে শ্রম রপ্তানি, আইসিটি ও ফ্রিল্যান্সিং, সেবা খাত, সবুজ জ্বালানি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এবং অন্যান্য।
শিক্ষাকে অগ্রাধিকার : আমির খসরু বলেন, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের অর্থনৈতিক সুবিধা ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা এবং তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় আনা হবে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্লাম্বিং, ইলেকট্রিশিয়ান, মেকানিক্স, ডেন্টাল হাইজেনিস্ট, মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান ইত্যাদির স্বল্পমেয়াদি ‘ট্রেড কোর্স’ চালু করা হবে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাস্তবমুখী করতে এপ্রেন্টিসশিপ, ইন্টার্নশিপ এবং ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। জেলা পর্যায়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনোভেটিভ বিজনেস আইডিয়া বাণিজ্যিকিকরণ করতে প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়ায় সিড ফান্ডিং বা ইনোভেশন গ্র্যান্ট প্রদান করা হবে।
স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন : আমির খসরু বলেন, রোগ প্রতিরোধকে প্রাধান্য দিয়ে টিকাদান, স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং সচেতনতা তৈরির একাধিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, স্যানিটেশন এবং পুষ্টির উপর জনগণের মধ্যে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি করা হবে, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য স্পেশালাইজড ট্রেনিং স্কিম শুরু করা হবে। আধুনিক পরিশোধন ব্যবস্থা ও বৃষ্টির পানি সংগ্রহের জন্য পর্যায়ক্রমে দেশব্যাপী রিসার্ভার তৈরী করা হবে।
৪ কোটি পরিবারের ফ্যামিলি কার্ড : প্রায় প্রান্তিক চার কোটি পরিবারের মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে ৫০ লক্ষ দরিদ্র গ্রামীণ পরিবারের জন্য ‘ফ্যামিলি কার্ড’ চালু করা হবে। এই কার্ড মূলত পরিবারের নারী প্রধানের নামে ইস্যু করা হবে। নারীদের জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে ডেডিকেটেড সাপোর্ট সেল প্রতিষ্ঠা করা হবে।
শহীদদের স্বীকৃতি : আমির খসরু বলেন, জুলাই গঅভ্যুত্থানে এবং ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সকল শহীদের তালিকা প্রস্তুত করে নিজ-নিজ এলাকায় তাদের নামে সরকারি স্থাপনার নামকরণ করা হবে। শহীদ পরিবারগুলোসমূহকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করা হবে। গণঅভ্যুত্থানে ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে যেসব গণতন্ত্রকামী ব্যক্তি পঙ্গু হয়েছেন, চোখ হারিয়েছেন তাদেরকেও স্বীকৃতি ও চাকরির সহায়তা প্রদান করা হবে।
প্রান্তিক কৃষকদের জন্য ফার্মার্স কার্ড : কৃষকের নামে জমির পরিমাণ ও খতিয়ানসহ প্রয়োজনীয় তথ্যসংবলিত ‘ফার্মার্স কার্ড’ চালু করা হবে। কৃষকের কাছ থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে রাষ্ট্র ন্যায্যমূল্যের ভিত্তিতে সরাসরি উৎপাদিত পণ্য ক্রয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করবে এবং দেশব্যাপী কোল্ড স্টোরেজ তৈরির কাজ শুরু হবে। কৃষিজাত পণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ, মানোন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করে কৃষি খাতকে রফতানিমুখী করে গড়ে তোলা হবে। কৃষকের জমির ও উৎপাদিত ফসলের পরিমানের তথ্য-উপাত্ত নির্ণয় করে টার্গেটেড পলিসি সাপোর্ট দেওয়া হবে।
আমির খসরু বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উন্নয়নের জন্য দেশব্যাপী প্রোডাকশন ফেসিলিটি, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং ট্রেনিং প্রোগ্র্যাম হাতে নেয়া হবে। তারা আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে সরবরাহকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পণ্য বিশ্বব্যাপী বিক্রি করতে সক্ষম হবেন। বাংলাদেশে ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব, ইত্যাদি সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মের অফিস খোলার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। ফ্রিল্যান্সার তরুণ-যুবকদের সুবিধার্থে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাংলাদেশে পেপাল এবং অন্যান্য পেমেন্ট মেথডসহ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম শুরু করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। ফ্রিল্যান্সিং, আউটসোর্সিং এবং ডাটা প্রসেসিংকে উৎসাহিত করার জন্য জেলা পর্যায়ে যোগ্যতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম এবং মানব সম্পদ উন্নয়ন কার্যক্রম নেয়া হবে।
জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ২০৩৪ এ ওয়ান ট্রিলিয়ন ডলার : ১ ট্রিলিয়ন ডলার ইকোনোমির রোড ম্যাপের এফডিআই-জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা দশমিক ৪৫% থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশ নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে বিএনপি। বিএনপি ২০৩৪ সালের মধ্যে জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ১ ট্রিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করতে চায়। জনগনের ঘাড় থেকে বাড়তি ট্যাক্সের লাগাম টেনে ধরা। শিল্প খাতের বিকাশে বিনিয়োগ বান্ধব নীতি গ্রহণ করে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা হবে। যেসব বিনিয়োগে বিপুল পরিমান কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, সেই ধরণের প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। নতুন শিল্প সৃষ্টির জন্য কৃষি, মৎস্য ও অন্যান্য উৎপাদনমুখী খাতকে প্রাধান্য দেওয়া হবে। আওয়ামী দুঃশাসনে বন্ধ হয়ে যাওয়া পাটকল, বস্ত্রকল, চিনিকলসহ মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পসমূহের তালিকা প্রস্তুত করে সেগুলো পুনরায় চালুর দৃশ্যমান উদ্যোগ নেওয়া হবে।
আমির খসরু বলেন, নারীদের সার্বক্ষণিক নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে প্রাথমিকভাবে ঢাকার বিভিন্ন রুটে ‘শুধুমাত্র নারী যাত্রী’ বাস চালু করা হবে। পরীক্ষামূলকভাবে সেখানে ড্রাইভার ও সহকারী হিসেবেও নারীরা থাকবেন। ট্রাফিক সমস্যার সমাধানে দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞ সমন্বয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। ট্রাফিক লাইটে আর্টিফিশিয়ালইন্টেলিজেন্স ব্যবহারের পাশাপাশি ট্রাফিক আইনের কঠোর প্রয়োগ, জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি, লেইন-ভিত্তিক যানবাহন প্ল্যান ইত্যাদি উদ্ভাবনী সমাধান বাস্তবায়ন করা হবে।
সন্ত্রাস-নৈরাজ্যে জিরো টলারেন্স : আমির খসরু বলেন, ধর্ষণ, ছিনতাই, রাহাজানি, চুরিসহ সকল নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের মাধ্যমে কঠোর অবস্থান নেওয়া হবে। যেকোনো মূল্যে বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হবে।
পরিবেশ ব্যবস্থাপনা : আমির খসরু বলেন, ৫ বছরে ২৫ থেকে ৩০ কোটি বৃক্ষ রোপনের কর্মসূচি ইতিমধ্যে ঘোষিত হয়েছে। তৃনমূল থেকে শুরু করে রাজধানী পর্যন্ত ব্যাপকভাবে বৃক্ষ রোপন কর্মসূচি ও বৃক্ষমেলা আয়োজন করা হবে। পলিথিন নিষিদ্ধ করে পাটজাত ব্যাগকে উৎসাহিত করা হবে। সকল ‘ইকো-ফ্রেন্ডলি’ ও ‘সাস্টেইনেবল প্রোডাক্ট’কে উৎসাহিত করা হবে।
বেসরকারি খাতে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির টার্গেট : বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে বিএনপি সরকার বহুমুখী কৌশল গ্রহণ করবে। এই কর্মকৌশল কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে,‘বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবে, উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করবে। এ লক্ষ্যে নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামো সহজীকরণ ও আমলাতান্ত্রিক বাধা কমানো,ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ এবং স্টার্টআপগুলোর জন্য অর্থায়নের সুযোগ বৃদ্ধি, অবকাঠামো ও শিল্পাঞ্চলে বিনিয়োগ, বহুমুখীকরণ, উৎপাদনশীলতা ও উদ্ভাবণ, আর্থিকখাতে স্থিতিশীলতা শক্তিশালীকরণ, ব্যাংকিংখাতকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের জন্য সহজীকরণ, পূঁজিবাজারের উন্নতির জন্য পদক্ষেপ, আর্থিক পণ্যের বহুমুখীকরণ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ কৌশল প্রণয়ন, নীল অর্থনীতি, সৃজনশীল শিল্প অর্থনীতি, বানিজ্য সহসীকরণ ও শুল্ক পদ্ধতি উন্নয়ন, ডিজিটাল আর্থিক সেবার ব্যবহার বৃদ্ধি, কর্পোরেট গভর্ন্যান্স ও সামাজিক দায়বদ্ধতা উন্নতকরণ, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ শক্তিশালীকরণ, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও সবজু প্রবৃদ্ধি বাড়াতে অর্থায়ন ও বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে জানান তিনি।
বাজেট প্রক্রিয়ার সংস্কার : আমির খসরু বলেন, আমাদের বাজেটে প্রক্রিয়ায় সংস্কার দরকার। পুরনো স্টাইলে বাজেট প্রণয়ন করতে করতে কিছু লোক বাজেট তারা নিজেরাই প্রণয়ন করে এটাকে জনমখুী করা স সম্ভব হচ্ছে না বহু বছর ধরে। বাজেট অনুমোদনের জন্য প্রচলিত সাংবিধানিক পদ্ধতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে। জবাবদিহিতা এবং বাংলাদেশে সংসদীয় তদারকি শক্তিশালী করার জন্য মৌলিক সাংবিধানিক ও পদ্ধতিগত সংস্কারও করা হবে।