* জুলাই জাগরণ আয়োজন দেশের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান

মুহাম্মদ নূরে আলম: শ্রাবণের বৃষ্টিকে ওপেক্ষা করে সকাল থেকেই সরব হয়ে ওঠে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সেই সরবতা অব্যাহত ছিল দুপুর ও বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত অবধি। সেই সরবতার মাঝে মিশেছিল গানের সুর, কবিতার শিল্পিত উচ্চারণসহ বুহমাত্রিক সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। প্রদর্শিত হয়েছে গণঅভ্যুত্থানের ঘটনানির্ভর তথ্যচিত্র এবং বাস্তবতার সাথে মিল রেখে তৈরি করা হয়েছিল আয়নাঘর। সেই প্রতিকী আয়নাঘরের সামনে সব বয়সী মানুষের দীর্ঘ লাইন, ভিতরে ঢুকতে আপ্রাণ চেষ্টা। যে ভয়কংর আয়নাঘরের নাম শুনলে এসময় মানুষ একসময় আতৎকে উঠত। সেই আয়নাঘরের ভয়ংকর দৃশ্যের বর্ণনা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার আজমী ও ব্যারিস্টার আরমান। চারদিন ব্যাপী এই কালচারাল ফেস্টে বড়দের পাশাপাশি ছোটদের মন রাঙাতে ছিল বায়োস্কোপের প্রদর্শনী। উদ্যানের সবুজ ঘাসে ভেসে উঠেছে জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের মুখচ্ছবি। এভাবেই গত সোমবার শেষদিনে বৈচিত্র্যময়তার আলিঙ্গনে মুখরিত হয়ে ওঠে এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সাক্ষ্যবহ এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আঙিনা। এখানেই গত শুক্রবার শুরু হয়েছিল চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের স্মৃতিতাড়িত জুলাই জাগরণ সাংস্কৃতিক উৎসব। চার দিনব্যাপী এ উৎসবের আয়োজক সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী।

গত সোমবার সকাল ১১টায় প্রথম অধিবেশন শুরুর মধ্য দিয়ে ৪র্থ দিনের মতো আয়োজন শুরু হয় এবং দুপুর ২.৩০ টা থেকে শুরু হয় শেষ অধিবেশন। রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী আয়োজিত কালচারাল ফেস্ট “জুলাই জাগরণ” গত চারদিন ব্যাপী চলেছে। অনুষ্ঠানের শুরুতে যথারীতি পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হয়। গতকাল সোমবার অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাইমুমের চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, দীর্ঘদিন জালিমের বন্দীশালায় বন্দী থাকা জামায়াত নেতা এম আজহারুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমদ, বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম খান মিলন, সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল করিম, সাইমুমের ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম সাদ্দাম, গুমের শিকার বন্দীগণ ও অন্যান্য অতিথি প্রমুখ।

অতিথিরা তাদের বক্তব্যে সাইমুমের উক্ত আয়োজনকে সাধুবাদ জানান এবং এই ধরণের আয়োজন দেশের প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান। মেহমানগন একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ, বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনে সবাইকে এগিয়ে আসার আহবান করেন। তারা বলেন জুলাই বিল্পব আমাদের আকাঙ্খার বিল্পব, হাজারো শহিদের রক্তের বিনিময়ে আমরা একটি নতুন স্বাধীন দেশ পেয়েছি, আমরা আমাদের এই স্বাধীনতা কখনোই ভূলুণ্ঠিত হতে দিতে পারি না। মানুষের মাঝে সুস্থ সংস্কৃতির এই আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। তাহলেই আমরা একটি সুন্দর শান্তির দেশ পাবো, যেখানে খুন, গুম, হামলার শিকার হতে হবে না কাউকে। জুলাইয়ে স্পিরিটকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে সাইমুমকে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে।

শেষ দিনের পরিবেশনায় সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর পাশাপাশি কলরব শিল্পীগোষ্ঠী, জাগরণ শিল্পীগোষ্ঠী, সেইসাথে ছিল শহীদ ও জুলাই আহতদের নিয়ে একক পরিবেশনা। সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর পরিবেশনায় মঞ্চ নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। এর পাশাপাশি জুলাই আন্দোলনে “সাংস্কৃতিক কর্মীদের অবদান” এবং “পেশাজীবি মানুষের অবদান” নিয়ে ডকুমেন্টারী প্রদর্শীত হয়। ৩৬ জুলাই কালাচারাল ফেস্ট : জুলাই জাগরণ অনুষ্ঠানটির সার্বিক পরিচালনায় ছিলেন এইচ এম আবু মুসা, ব্যবস্থাপনায় ছিলেন সাইমুমের পরিচালক শিল্পী জাহিদুল ইসলাম।

জাহিদুল ইসলাম বলেন, এই সরকার বিপ্লবের চেতনা ধারণ করে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশ খুব ধীরগতিতে এগোচ্ছে। আমাদের ব্যর্থতা হলো, এখনো কোনো হত্যাকারীকে ফাঁসিতে ঝোলাতে পারিনি। অনেকে এখন ক্রেডিট নেওয়ার রাজনীতি করছে, কিন্তু এই আন্দোলনে কেউ ক্রেডিটের জন্য আসেনি। সবাই এসেছে ফ্যাসিবাদকে উৎখাত করতে। আমরা জুলাইয়ের চেতনাকে ধারণ করে নতুন বাংলাদেশ গড়ব। উল্লেখ্য যে, চার দিনব্যাপী এই আয়োজনে ছিল জুলাইয়ের ওপর নির্মিত চলচ্চিত্র ও প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী, মঞ্চনাটক ও আবৃত্তি পরিবেশনা, শহীদ পরিবার ও আহতদের গল্প এবং স্মৃতিচারণ, শিশুদের জন্য কিডস জোন ও খেলার আয়োজন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জুলাই চলাকালে আঁকা গ্রাফিতি প্রদর্শনী ও শহীদদের স্মরণে তৈরি বিশাল ক্যানভাসে বাংলাদেশের মানচিত্র আরও থাকছে ফুড স্টল, গ্রাফিতি ওয়াল, “আয়নাঘর” নামক বিশেষ প্রদর্শনী এবং প্রতিদিন সন্ধ্যায় ছিল মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

আবু মুসা বলেন, ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠী এ দেশের মানুষের বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও জাতীয় চেতনাকে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নানা শাখায় কাজ করে যাচ্ছে। বিগত স্বৈরশাসন আমলে সাইমুমের ওপর চালানো হয় ভয়াবহ নিপীড়ন, নেতদের একাধিকবার গ্রেফতার করে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়, সংগঠনের অফিস থেকে কম্পিউটার, হার্ডডিস্ক, সিডি, ডিভিডিসহ গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং সংগঠনের প্রতিবাদী কণ্ঠকে দমন করার বহু চেষ্টা চালানো হয়। তবুও সাইমুম থেমে যায়নি।