জুলাই আন্দোলনে কবি-সাহিত্যিকদের ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। তারা বিভিন্ন স্লোগান রচনার পাশাপাশি রাজপথেও নেমেছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। দৈনিক সংগ্রামকে সেসব ঘটনা শুনিয়েছেন, বিক্ষুব্ধ কবি লেখক সমাজের আহ্বায়ক কবি আবিদ আজম। লিখেছেন ইবরাহীম খলিল।
দৈনিক সংগ্রাম : সব আন্দোলনেই কবি সাহিত্যিকদের একটা ভূমিকা থাকে। জুলাই আন্দোলনের পক্ষে আপনাদের কি ভূমিকা ছিল?
কবি আবিদ আজম : ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড় বুক পেতেছি গুলী কর, এমন অসংখ্য কালজয়ী পংক্তি আছে কিংবা আমিরুল মোমেনীন মানিক লিখেছেন ‘ আবু সাঈদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ, এমন অনেক পংক্তি আমাদের জুলাই উত্থানে, আন্দোলনে,ছাত্র জনতা এবং বিপ্লবীদের সাহস জুগিয়েছে। কবি আল মাহমুদের অসংখ্য লাইন আছে ‘ পৃথিবীতে যত গোলাপ ফুল ফোটে, তার লালবর্ণ আমাদের রক্ত, তার সুগন্ধ আমাদের নি:শ^াস বায়্।ু কিংবা নজরুল, ফররুখ আহমদ আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। জুলাই অভ্যূত্থানেও ব্যাপারটা আমরা লক্ষ্য করেছি। আপনি দেখবেন যে ফরাসি কিংবা রুশ বিপ্লবেও সাহিত্যের অনন্য ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশেও তা হতে পারতো। তা অবশ্য হয়নি। জুলাই অভ্যূত্থানে কবি সাহিত্যিকদের একাংশ, বলতে গেলে বড় একটা অংশ অভ্যূত্থানে ভূমিকা রেখেছে। শুরুতে তারা ফেসবুকে লেখনীর মাধ্যমে ভূমিকা রেখেছে। ছাত্র-জনতাকে অনুপ্রাণিত করতে এমন অসংখ্য স্লোগানও দেখেছি আমরা অভ্যূত্থানকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। আবু সাঈদের শাহাদাত কিংবা মুগ্ধের শাহাদাতের পাশাপাশি বলা হয় যে, জাতিকে ভাষা দেন রাজনীতিকরা আর বিপ্লবীদের ভাষা দেন কবি সাহিত্যিকরা। দৃশ্যত কবি সাহিত্যিকদের একটা সমাবেশ হয়েছে। দুই তারিখে বাংলামোটরে আমরা এক দফা ঘোষণা করি। সেখানে এক থেকে দেড়শ’ কবি সাহিত্যিক ছিলেন। সেখানে দেখা গেছে অনেক কবি সাহিত্যিকদের আমন্ত্রণ জানিয়েও আনতে পারিনি। আবার অনেক কবি স্বর্তস্ফূর্তভাবে এসেছেন এবং মিডিয়াগুলো সাপোর্ট দিয়েছে। এভাবে আমরা লেখালেখি করেছি। সংগঠিত করেছি। লড়েছি। বিক্ষুব্ধ কবি লেখক সমাজের সংগঠক এবং আহবায়ক হিসেবেও বিষয়টা আমার কাছে গৌরবের ব্যাপার। কাজটা হয়তো অত্যন্ত ছোট, কিন্তু প্রভাবটা ছিল অনেক বড়। পরদিন তিন আগস্ট এক দফা ঘোষণা করা হয়। সেই অভ্যূত্থানের প্রধান নেতৃবৃন্দ তারাও বলেছেন আগের দিন সকাল বেলার বাংলা মোটরের একদফা একই সময়ে শুরু হয়েছিল, ধানমন্ডিতে নিপীড়ন বিরোধী শিল্পী সমাজের আরেকটা সমাবেশ ছিল। এই দুটো সমাবেশের কারণে তারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন যে এক দফা ঘোষনা করা যায়। সেজন্য আমরা বলতে পারি যে এক দফায় আমাদের একটা অবদান আছে।
দৈনিক সংগ্রাম : বলা হচ্ছিল যে আপনারা প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন। পরবর্তীতে আপনারা স্বশরীরে রাস্তায় নামলেন। আসলে এটার চিন্তাটা কখন থেকে শুরু হয়?
কবি আবিদ আজম : এটার প্রস্তুতিটা ছিল যখন আমরা তারুণ্যটা শুরু হয়। পিছন থেকে বলি। আমি যখন তরুণ, কলেজ পেরিয়ে ভার্র্সিটিতে ভর্তি হই; তখন থেকেই দেখি ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া গিয়ে উঠেছে। নানানভাবে আমরা লেখালেখি করেছি। ২০১০ সালে লিখলাম ‘বন্ধু এখন শান্তি নামের সকল দ্বার, ইবলিস-ই আজ স্বাধীন দেশের দখলদার। ২০১৪ সালে কবি আল মাহমুদের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করার কারণে একটা সংগঠনের নাম দিলাম কালের কলস। কালের কলসটা করতে আমি গেলাম বনধুজন এবং ভাই কবি আবুল হাসান তাহেরের অফিসে। সরকার বিরোধী কাজ দেখে পুলিশ আমাদের গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। নানা রকম শারীরিক ও মেন্টাল টর্চার করে। তাহের ভাই অনেকদিন জেল খেটেছেন। তখন থেকে আমার গায়ে সরকার বিরোধী ট্যাগ লেগে যায়। আমি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে স্টুডেন্ট না। কিন্তু সেখানে আমি তিনবার নিপীড়নের শিকার হয়েছি। টেলিভিশনে ভারতের করিডোর বিরোধী রিপোর্ট করার কারণে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হয়। আমাকে চাকুরীচ্যুত করা হয়েছে। আমরা মূলত কালের কলস গ্রুপ থেকে প্রথমে ফেসবুক পরে ওয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে আমরা লেখালেখি করি। আমরা বলা শুরু করলাম যে কবি সাহিত্যিকরাতো রাস্তায় নামছে না। আবু সাঈদকে হত্যার পর সরকারের পক্ষ থেকে সংলাপের কথা বলা হলো। আমি তখন ফেসবুকে লিখলাম, গর্দানের সাথে সংলাপ হয় না তলোয়ারের। মানুষের সাথে সংলাপ হয়? মিথ্যাবাদীর ফলোয়ারের? আমরা দেখছিলাম যে রাস্তায় নামার পরিবেশ নাই। গুলী হচ্ছে। খুন জখম করা হচ্ছে। এভাবে ১৯ তারিখ চলে এলো। তখন আমি পুরোপুরি রাজপথে নেমে গেলাম। প্রথমে কয়েকজনের সাথে আলাপ করলাম। কিন্তু কেউ সাহস করলো না নামতে।
দৈনিক সংগ্রাম : তারপর কি হলো ?
কবি আবিদ আজম : কথা বলতে বলতে দু’একজন সাহস দিলো। এর মধ্যে ছিল নাহিদ যাযাবর, ইমরান মাহফুজ, নিমগ্ন দুপুর, হালিমা মুক্তা, ফারুক হোসেন খান এবং সরোজ মেহেদী। তারা আমাকে সাহস দিলেন। তারা আমাকে বললেন করা যায়। আমি খোঁচা দিলাম, সবাই রাজপথে দাঁড়াচ্ছে তবে কবি সাহিত্যিকরা নয় কেন? আমরা ১ আগস্ট সিদ্ধান্ত নিলাম যে কালকেই অর্থাৎ ২ আগস্ট আমরা পথে দাঁড়াচ্ছি। তাতে সবাই চাঙা হয়ে উঠলো যে, রাজপথে দাঁড়াচ্ছি। তো আমরা অনলাইন মিটিং করলাম। আমি প্রস্তাব করলাম যে ব্যানারের শিরোনাম হবে, জুলাই হত্যা এবং দেশব্যাপী নিপীড়নের প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ কবি সমাজ। আমরা পরদিন রাস্তায় দাঁড়ালাম। আমাদেরকে সংবাদ পাঠক পাঠিকা উপস্থাপিকা শাহীনা ইসলাম সহায়তা করেন।
দৈনিক সংগ্রাম : ২ আগস্ট যখন রাস্তায় দাঁড়ালেন তখনতো আপনাদের ওপর আক্রমণ হয়েছিল। সেই ঘটনা যদি বলেন।
কবি আবিদ আজম : ২ তারিখে আমরা যখন দাঁড়াই। বিশ^সাহিত্য কেন্দ্রের সামনে। আপনি জানেন বিশ^সাহিত্য কেন্দ্রকে জানে সবাই আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে। কিন্তু অভ্যূত্থানে তাদের দ্ইু পয়সারও ভূমিকা নাই। আমরা যখন সেখানে দাঁড়াচ্ছিলাম, দাঁড়াতেই দেয়া হচ্ছিল না। পরে বিশ^সাহিত্য কেন্দ্রের গলি ছেড়ে মূল রাস্তায় দাঁড়াতে বাধ্য হলাম। এখনো সেখানে গেলে দেখবেন গ্রাফিতি নাই। আছে প্যাঁচার ছবি। বৈশাখের কিংবা হিন্দুয়ানি মুভমেন্ট আছে। অভ্যূত্থানের কোন স্মৃতিচিহ্ন নাই। আমরা যখন মেইন রাস্তায় দাঁড়িয়েছি তখন ১৪৪ ধারা চলে। এবং আদালতের দ্বারা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বিশৃঙ্খলাকারী। আমাদেরকে দেখা মাত্রই গুলী করা যাবে। সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেওয়া হয়েছিল। তুমুল বৃষ্টি ছিল সকাল দশটা থেকে। বৃষ্টি উপেক্ষা করেই আমরা সেখানে দাঁড়িয়েছি। আশপাশে গাড়ি ছিল। গোয়েন্দা সংস্থার। আপনি জানেন যে জুলাইয়ে যারাই রাস্তায় নেমেছে মৃত্যুর একটা প্রন্তুতি নিয়ে নেমেছে।
দৈনিক সংগ্রাম : কবি সাহিত্যিকরাও তাই করেছে ?
কবি আবিদ আজম : কবি সাহিত্যিকরা কিছুটা ভীরু এবং কাপুরুষ। ওই দিনে আমাদের মধ্যে কি যেন হয়েছিল। আমরা যারা স্লোগান দিচ্ছিলাম তাদের মধ্যে একটা অগ্নি স্ফুলিঙ্গ জ¦লে উঠছিল। রক্তে বারুদ জ¦লছিল। ওই দিন আবার তুমুল বৃষ্টির মধ্যে টোকন ঠাকুর, বকুল আশ্রাফ থেকে শুরু করে কাজল শাহনেওয়াজ, কবি নাজিম উদ্দিন, জব্বার আল নাঈমরাও ছিলেন আমাদের মধ্যে। আমি স্লোগান তুলছিলাম। দেখলাম সাদা পোশাকধারী ব্যক্তি আমার ছবি তুলছে। আমি বুঝলাম যে এরা কারা। সেদিন রাতে আমার কাছে ফোন আসে যে আপনাদের তালিকা আমরা পেয়েছি। সম্ভবত ডিবি থেকে ফোনটা আসে। আরেকটা ফোন আসে বিদেশ থেকে। আমি বললাম আমাদের তালিকাতো পেয়েছেন, আপনাদের তালিকা আমরা করা শুরু করে দিয়েছি। একথা বলে ফোনটা কেটে বন্ধ করে দিয়েছি। এরপর থেকে আর বাসায় ফিরতে পারিনি। লুকিয়ে নানা জায়গায় থাকতে হয়েছে।
একটা মজার বিষয় হলো সেদিন কারো কারো কাছে ছাতা ছিল। কে যেন বললো বিপ্লবের মধ্যে আবার ছাতা থাকবে কেন ? বৃষ্টিতে ভিজবো, এটাই আমাদের দ্রোহ, এটাই প্রতিবাদ। সেটা অন্যরকম অনুভূতি। আমরা তিন ঘন্টার মতো বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম। আমাদের এই প্রতিবাদ দেখে সারাদেশে ছোট ছোট প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে। পরদিন কবি আব্দুল হাই শিকদার এবং ফরহাদ মজাহারের নেতৃত্বে জাতীয় প্রেসক্লাবে একই শিরোনামে এবং একই ব্যানারে আমাদের নামটাই ওনারা নিলেন বিক্ষুব্ধ কবি এবং লেখক সমাজ। তারা বললেন আপনাদের নামটাই আমরা ব্যবহার করি। আমরাও সেখানে অ্যাটেন্ড করেছি। একদফা ছাত্রদের সাথে গিয়ে মিলিত হয়েছি শহীদ মিনোরে। আমি সাত থেকে আটবার মৃত্যুর মুখোমুখী হয়েছি। পুলিশ গুলি করছে আমরা সরে যাচ্ছি। এরকম তিন/চার বার মনে হয়েছে এই গেলাম। চারপাশ থেকে অনেকেই গুলি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে। আমার দুটো শার্ট রক্তাক্ত হয়েছে। আমার বাসায় সংরক্ষণে আছে। ৫ তারিখে গণভবন থেকে একটা কিল লিস্ট উদ্ধার হয়। যারা রাষ্ট্রদ্রোহিতার ভূমিকায় ছিল। সেখানে আমার নামও আছে ফোন নাম্বারসহ। আমার গ্রামের বাড়ি কোথায় কোন এলাকায় থাকি।
দৈনিক সংগ্রাম : শেষ প্রশ্ন বাংলা একাডেমি থেকে জুলাই সংকলন বের হচ্ছে। সেখানে আপনার একটা ভূমিকা রয়েছে। সেখানে লেখার মানটা কি রকম বলে আপনার মনে হয় ? আসলে সেখানে জুলাইকে কতটা ধারণ করা হয়েছে?
কবি আবিদ আজম : সারাদেশ থেকে প্রায় তিন হাজারের মতো ছড়া এসেছে। প্রায় তিনশ’ ছড়া বাছাই করা হয়েছে। অসাধারণ সব ছড়া এসেছে। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের কবিরা এতো চমৎকার লেখেন। তাদের এসব লেখা গণমানুষকে অনুপ্রাণিত করে। জুলাই চেতনাকে ধারণ এবং লালন করার জন্য অনেক বড় ভূমিকা পালন করবে। এজন্য বাংলা একাডেমির মহাপরিচালককে ধন্যবাদ জানাই। অধ্যাপক ড. মো. আজম সাহেবকে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে আরও বৈপ্লবিক উদ্যোগ প্রত্যাশা করি।