থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে হয়ে গেল দু’দিনব্যাপী বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চল বিমসটেক সম্মেলন। সেখান থেকে দুই বছরের জন্য সংস্থাটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পেয়েছে বাংলাদেশ। সম্মেলনে অংশ নেন বঙ্গোপসাগরের চারপাশের দেশগুলোর সরকার প্রধানগণ। এখন প্রশ্ন হলো এই বিমসস্টেক সম্মেলন থেকে কী পেল বাংলাদেশ? বিমসটেক সম্মেলনের দেনা-পাওনার হিসেব করলে অনেক কিছুই অর্জন করেছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমসটেক থেকে মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা একটি মাইলফলক অর্জন ড. ইউনূসের। এর আগে রাজনৈতিক সরকারগুলোর পক্ষ থেকে বহু চেষ্টা করেও যে কাজটি করতে পারেনি; ড. ইউনূসের কূটনৈতিক দক্ষতা এবং আন্তর্জাতিক ইমেজ এই সাফল্য এনে দিয়েছে বাংলাদেশকে। তদুপরি, বাকী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার তৎপরতাও অব্যাহত থাকছে বলে জানানো হয়েছে দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে।
বিমসটেক সম্মেলনের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো ইউনূস-মোদির বৈঠক। বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়েছেন। সেইসাথে সীমান্ত হত্যা কমিয়ে আনা, গঙ্গা-তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনায় ন্যায্যতা নিশ্চিত করাসহ অনেকগুলো অমীমাংসিত ইস্যু আলোচনা হয়েছে বৈঠকে। শেখ হাসিনার দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র নিয়েও সরব ছিলেন প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। ১০ বছর আগের পুরনো ছবি উপহার দিয়ে পুরনো বন্ধুত্ব মনে করিয়ে দিয়েছেন নোবেল বিজয়ী ইউনূস। এটা ছিল তার কূটনীতির অনন্য কৌশল। সবার কাছে এই ঘটনা প্রশংসা পেয়েছে। দেশের স্বার্থ রক্ষায় এর চেয়ে সুন্দর কূটনীতি আর কি হতে পারে।
কূটনৈতিক দিক থেকে হিসেবে করলে দেখা যায় সাত দেশের সরকার প্রধানদের সাথে আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে নতুন দিক উন্মোচিত হয়েছে। থাইল্যান্ডের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় ভিসা সুবিধা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন প্রফেসর ইউনূস। তিনি বলেছেন, বিমান ভাড়া কমানোর পাশাপাশি যাতে টাইমিংটা কমিয়ে আনা হয়। তাতে বাংলাদেশের মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার জন্য বেশি করে আসতে পারবে। থাইল্যান্ড বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিয়েছে বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী। অন্যদিকে শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার জন্য কারিগরি সহযোগিতা চেয়েছেন ড. ইউনূস। নেপাল ও ভুটান থেকে কিভাবে বিদ্যুৎ আনা যায় তা নিয়েও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন বিমসটেক সম্মেলনে।
আগামী দুই বছর বাংলাদেশ বিমসটেকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করবে। সেখান থেকে প্রফেসর ইউনূস সবচেয়ে বেশি বেনিফিট এনে দেবেন বলেই মনে করা হচ্ছে। তিনি শুরুতেই সদস্য দেশের যুবকদের নিয়ে একটি সম্মেলনের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন। বলা হচ্ছে, এই যুবকদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্জন চান প্রফেসর ইউনূস। বিশেষ করে তাদের উদ্ভাবনী শক্তি এবং মেধাকে দেশের স্বার্থে কাজে লাগানোর জন্য মূলত এই প্রস্তাব প্রফেসর ইউনূসের।
এদিকে বহুপক্ষীয় কারিগরি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য বে অফ বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ (বিমসটেক) ষষ্ঠ শীর্ষ সম্মেলনে বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এই সম্মেলনে প্রথমবারের মতো গৃহীত হয়েছে ভিশন ডকুমেন্ট হিসেবে ‘ব্যাংকক ভিশন ২০৩০’। গতকাল শনিবার বিমসটেকের প্রধান অফিস এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়, বিমসটেকের সদস্য রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের অংশগ্রহণে ষষ্ঠ শীর্ষ সম্মেলন ৪ এপ্রিল থাইল্যান্ডের ব্যাংককে অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে ২ এপ্রিল ২৫তম বিমসটেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সভা এবং ৩ এপ্রিল ২০তম বিমসটেক মন্ত্রিপর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং টোবগে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, মিয়ানমারের প্রধানমন্ত্রী জেনারেল মিন অং হ্লাইং, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি, শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী ড. হারিনী আমারাসুরিয়া এবং থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পায়োংটার্ন সিনাওয়াত্রা।
‘সমৃদ্ধ, সহিঞ্চুতা এবং উন্মুক্ত বিমসটেক’ শীর্ষক প্রতিপাদ্য নিয়ে ষষ্ঠ শীর্ষ সম্মেলনে সদস্য রাষ্ট্রগুলো নিরাপত্তা এবং উন্নয়নমূলক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহযোগিতা বাড়ানোর ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। বিমসটেকের লক্ষ্য অর্জনের জন্য এই আঞ্চলিক সংস্থাকে একটি নতুন প্রেরণা দেয়। ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের মূল ফলাফলগুলো, ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণাপত্র গ্রহণ, যা নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভবিষ্যতের সহযোগিতার জন্য তাদের সিদ্ধান্ত এবং নির্দেশনা প্রতিফলিত করে।
বিমসটেকের প্রথম ভিশন ডকুমেন্ট, ব্যাংকক ভিশন ২০৩০ গৃহীত হয়েছে, যা সমৃদ্ধ, সহিষ্ণুতা এবং উন্মুক্ত বিমসটেকের দৃষ্টিভঙ্গি অর্জনে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ভবিষ্যত সহযোগিতার জন্য একটি বিস্তৃত এবং বাস্তবসম্মত রোডম্যাপ প্রদান করে। সামুদ্রিক পরিবহন সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। সামুদ্রিক সংযোগ বৃদ্ধির জন্য আঞ্চলিক অংশীদারত্ব জোরদার করার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা সদস্য দেশগুলোর মধ্যে আরও বাণিজ্য এবং ভ্রমণ সক্ষম করবে।
বিমসটেক এবং ইন্ডিয়ান ওশান রিম অ্যাসোসিয়েশনের (আইওআরএ) মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর, যা আইওআরএ এবং বিমসটেকের মধ্যে ভবিষ্যৎ অংশীদারিত্বকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়। বিমসটেক এবং জাতিসংঘের মাদক অপরাধ নিয়ন্ত্রক অফিসের (ইউএনওডিসি) মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর, যা ইউএনওডিসি এবং বিমসটেকের মধ্যে অংশীদারিত্বকে ভাগাভাগি করবে। বিমসটেক মেকানিজমের জন্য কার্যপ্রণালী গৃহীত হয়েছে। বিমসটেক সনদের সাথে কার্যপ্রণালীর নিয়মাবলী, বিমসটেকের অধীনে আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর একটি শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করে, যা বৃহত্তর দক্ষতা এবং ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে।
বিমসটেকের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা সম্পর্কিত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের গোষ্ঠীর প্রতিবেদন গ্রহণ, যাতে বিমসটেককে সংস্কার ও পুনরুজ্জীবিত করার জন্য বেশ কয়েকটি সুপারিশ রয়েছে।
গত ২৮ মার্চ মিয়ানমার এবং থাইল্যান্ডে আঘাত হানা ভূমিকম্পের প্রভাব সম্পর্কে বিমসটেক নেতাদের যৌথ বিবৃতির অনুমোদন। এটি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সমর্থন করার জন্য নেতাদের সমবেদনা, সংহতি এবং প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করে। এটি আঞ্চলিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থা শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে। বিমসটেক নেতারা শীর্ষ সম্মেলনে তাদের বিবৃতিতে বিমসটেকের প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। আঞ্চলিক সহযোগিতার অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রগুলি চিহ্নিত এবং সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব এবং উদ্যোগ উপস্থাপন করেছেন। তারা আন্তঃআঞ্চলিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, সংযোগ, পর্যটন, সংস্কৃতি বিনিময়, জলবায়ু কর্মকাণ্ড, সবুজ ও নবায়নযোগ্য শক্তি, টেকসই কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং নিরাপত্তা বাড়াতে অগ্রগতি অর্জনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।
বিমসটেক মহাসচিব ইন্দ্র মণি পান্ডে নেতাদের উদ্দেশ্যে তার প্রতিবেদনে, ২০২২ সালের মার্চে কলম্বোতে অনুষ্ঠিত ৫ম বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের পর থেকে প্রাপ্ত অগ্রগতি তুলে ধরেন। তিনি এই অঞ্চলের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য বিমসটেক এজেন্ডাকে আরও এগিয়ে নেওয়ার জন্য তাদের নির্দেশনা চেয়েছেন। বিমসটেকের অধীনে আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করার জন্য সদস্য দেশগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার জন্য সচিবালয়ের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। শীর্ষ সম্মেলন শেষে বিমসটেকের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য বাংলাদেশ বিমসটেকের সভাপতিত্ব গ্রহণ করে। বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিমসটেক সহযোগিতাকে এগিয়ে নিতে অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতামূলকভাবে কাজ করার জন্য বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
বিমসটেকের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে বলা হয়েছে, ইতোমধ্যেই সম্মত সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলোতে এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর দ্বারা সম্মত হতে পারে এমন অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতে নির্দিষ্ট সহযোগিতা প্রকল্পগুলো শনাক্তকরণ এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা। সদস্য রাষ্ট্রগুলো পর্যায়ক্রমে সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো পর্যালোচনা করতে পারে। সমতা ও অংশীদারিত্বের চেতনায় যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত করা। অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রযুক্তিগত এবং বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে সাধারণ স্বার্থের বিষয়ে সক্রিয় সহযোগিতা এবং পারস্পরিক সহায়তা প্রচার করা। শিক্ষাগত, পেশাদার এবং প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ এবং গবেষণা সুবিধার আকারে একে অপরকে সহায়তা প্রদান করা। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার সহায়ক এবং পরিপূরক যৌথ প্রচেষ্টায় আরও কার্যকরভাবে সহযোগিতা করা, যার ফলে জনগণের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধিতে বাস্তব সুবিধা পাওয়া যায়, যার মধ্যে রয়েছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং পরিবহন ও যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নত করা।
বিমসটেক সদস্য রাষ্ট্রগুলির মধ্যে এমন প্রকল্পগুলোতে সহযোগিতা করা যা আঞ্চলিক ভিত্তিতে সবচেয়ে উৎপাদনশীলভাবে মোকাবেলা করা যেতে পারে এবং যা উপলব্ধ সমন্বয়কের সর্বোত্তম ব্যবহার করে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, আন্তর্জাতিক সংঘটিত অপরাধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সংক্রামক রোগ মোকাবেলায় ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। একই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পন্ন বিদ্যমান আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থাগুলোর সাথে ঘনিষ্ঠ এবং লাভজনক সহযোগিতা বজায় রাখা। বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চল থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রচেষ্টা করা। বহুমাত্রিক সংযোগ স্থাপনের জন্য, এই অঞ্চলে সংযোগ কাঠামোর মধ্যে সমন্বয়কে উৎসাহিত করা, যা ভাগাভাগি সমৃদ্ধির জন্য অর্থনৈতিক একীকরণের মূল সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য বাণিজ্য ও বিনিয়োগকে একটি প্রধান অবদানকারী উপাদান হিসেবে উৎসাহিত করা। বিষয়গুলোকে সামনে রেখে প্রতিটি সেক্টরে কিভাবে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখে কর্মসূচী সাজিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।