সার ডিলার নিয়োগ ও সার বিতরণসংক্রান্ত সমন্বিত নীতিমালা করছে সরকার। কিন্তু আসন্ন বোরো মৌসুমে এ নীতিমালার বাস্তবায়নে সরকারের সিদ্ধান্ত ডিলারদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে, যার কারণে দেশে সারের সংকট আরও প্রকট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে এ নীতিমালার বাস্তবায়ন পেছানোর দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন (বিএফএ)।
গতকাল বুধবার ধানমন্ডির সীমা ব্লোসম টাওয়ারের একটি কনফারেন্স রুমে সম্প্রতি ঘোষিত সার ডিলার নিয়োগ ও সার বিতরণ সংক্রান্ত সমন্বিত নীতিমালা-২০২৫ এবং বেসরকারি পর্যায়ে নন-ইউরিয়া সার আমদানির ভর্তুকি প্রদান পদ্ধতি-২০১৫ সংক্রান্ত এক মতবিনিময় সভা ও সাংবাদিক সম্মেলনে এসব দাবি জানানো হয়।
একইসঙ্গে সার ডিলারদের কমিশন বাড়িয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ, অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে সার ডিলার ও আমদানিকারকদের এই সংগঠন।এতে সারাদেশের ডিলারদের উপস্থিতিতে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক চেয়ারম্যান কফিল উদ্দিন আহমেদ।
কফিল উদ্দিন আহমেদ বলেন, সারের ডিলার নিয়োগের নতুন নীতিমালা করে ইউনিয়নভিত্তিক নতুন ডিলার নিয়োগ করা হবে, যা এই সময়ের জন্য বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নয়। কারণ বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী একজন ডিলারকে একটি গুদাম ও একটি বিক্রয়কেন্দ্র পরিচালনা করতে হয়। কিন্তু নতুন নীতিমালা অনুযায়ী একজন ডিলারকে ৩টি বিক্রয়কেন্দ্র এবং একটি গুদাম পরিচালনা করতে হবে। এতে করে ডিলারদের পরিচালনা ব্যয় তিন গুণ বেড়ে যাবে। কিন্তু কমিশন আগের মতো প্রতি কেজিতে ২ টাকা থাকবে। এতে করে সার সরবরাহে সংকট তৈরি হতে পারে।
তিনি বলেন, এখন হুট করে এ নীতিমালা হলে সারের সরকারি দামে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, পরিবহন খরচ এবং নিরাপত্তাজনিত সমস্যার কারণে কোনোভাবেই ডিলারশিপ ব্যবসাটি আর কার্যকর থাকবে না। আর এখন নতুন করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঠিক সময় নয়। কারণ বর্তমানে মিনি পিক সিজন এবং বোরোর ভরা মৌসুম আসন্ন। এই মৌসুমে নতুন নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে গেলে মাঠে এক ধরনের অরাজকতা তৈরি হতে পারে।
জানা গেছে, ১৯৯৫ সালে ডিলারশিপ প্রথা চালু হওয়ার পর থেকে প্রতিটি উপজেলায় এবং পরবর্তী সময়ে ২০০৯ সালে জারিকৃত ডিলার নিয়োগ ও নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিটি ইউনিয়নের ডিলাররা সারাদেশে সুষ্ঠুভাবে সার সরবরাহ করে আসছে। সারাদেশে সব মিলিয়ে ১০ হাজার ৮০০ জন ডিলার এবং প্রায় ৪৫ হাজার খুচরা বিক্রেতা রয়েছে।
বিএফএ-এর সাবেক এই সভাপতি দাবি করেন, নীতিমালায় পরিবর্তন আনার পূর্বে অবশ্যই অংশীজনের সঙ্গে সভা করা ও মাঠ পর্যায়ের প্রকৃত তথ্য নেওয়া দরকার ছিল। সেটা করা হয়নি। সুতরাং আমাদের দাবি এ ধরনের নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য এপ্রিল-মে মাসের পর অর্থাৎ লিন পিরিয়ডে (মন্দার সময়কাল) করার। এছাড়া আমরা চাই অবশ্যই অংশীজনদের মতামত নিয়ে সঠিক সময়ে এ নীতিমালা করা হোক। সময় নিয়ে ভেবেচিন্তে বাস্তবায়ন করার দাবি জানাচ্ছি। কারণ, মাঠপর্যায়ে সার সরবরাহ অস্থিতিশীল এবং সংকট হলে এর দায় সরকারের ওপরই বর্তাবে।
কিছু এলাকায় কৃষকদের সার না পাওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে বিএফএ-এর সাবেক পরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ পর্যাপ্ত নয় বলেই দেশে সারের সংকট দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে আবার ভরা মৌসুমে নীতিমালা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটা ভরা মৌসুমের পর বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছি, যাতে করে ভরা মৌসুমে সারের কোনো ধরনের সরবরাহ ঝুঁকি তৈরি না হয়।
বিএফএ-এর সাবেক চেয়ারম্যান ফাইজুর রহমান বকুল বলেন, আমরা সরকারের সঙ্গেই কাজ করছি এবং করতে চাই। এর মধ্যে বৈষম্য হোক সেটা আমরা চাই না। বেসরকারি আমদানি ও সরবরাহে যাতে স্বচ্ছতা থাকে, সেটা আমরা চাই। এ সময় আরও বলা হয়, সার সরবরাহ সুষ্ঠু করতে হলে ডিলারদের পরিবহন খরচ ও কমিশন বৃদ্ধি করতে হবে। ২০০৮ সালের পর থেকে জ্বালানি তেলের দাম কয়েক দফা বৃদ্ধি পাওয়ার পরও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি হয়নি। তাছাড়া ব্যাংক সুদ, গুদাম ভাড়া, কর্মচারী ব্যয়, লোড-আনলোডসহ আনুষঙ্গিক যাবতীয় খরচ বৃদ্ধি পাওয়ার পরও বিক্রয় কমিশন বৃদ্ধি হয়নি। পরিবহন খরচ ও বিক্রয় কমিশন বৃদ্ধি ব্যতিরেকে সার ডিলার নিয়োগ সমন্বিত নীতিমালা-২০২৫ বাস্তবায়ন করা যাবে না।
সরকারি আমদানিতে খরচ বেশি হলেও দেশের ৭০ শতাংশ সার সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএডিসি আমদানি করছে। যে কারণে প্রকৃত আমদানি খরচ নির্ণয়পূর্বক অধিক পরিমাণে সার বেসরকারি আমদানিকারকদের মাধ্যমে আমদানি করলে সরকারের অর্থ সাশ্রয় হবে। এছাড়া বিএডিসি অতীতে সার সরবরাহের কাজে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, ফলে এখনো বিএডিসি-এর মাধ্যমে আমদানি প্রক্রিয়ায় সরকার বিপুল পরিমাণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ডিলারদের পাশাপাশি খুচরা বিক্রেতারাও সার সরবরাহে সরকারকে সহযোগিতা করতে পারে। ফলে নতুন নীতিমালায় এসব খুচরা বিক্রেতাদেরকে অন্তর্ভুক্ত রাখার দাবি জানাচ্ছি। ডিলারদের কমিশন বাড়িয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ, বোরো মৌসুমে নতুন নীতিমালা বাস্তবায়ন না করা, কোনো ডিলার অসাধু আচরণ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, বিএডিসি-এর পরিবর্তে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানিকারকদের আমদানির পরিমাণ বৃদ্ধি করা।
সরকার দেশে সারের সরবরাহ ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের জন্য নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। যেখানে প্রতিটি ইউনিয়নে তিনজন করে সারের ডিলার থাকবে। বর্তমান ব্যবস্থায় একজন ডিলারের একটি করে বিক্রয়কেন্দ্র এবং একটি গুদাম পরিচালনা করা হলেও নতুন নীতিমালায় একেকজন ডিলারের তিনটি করে বিক্রয়কেন্দ্র এবং একটি করে গুদাম পরিচালনা করতে হবে। ডিলার ছাড়া কেউ সার বিক্রি করতে পারবেন না। এছাড়া বিসিআইসি ও বিএডিসি-এর ডিলারশিপ বর্তমানে আলাদা থাকলেও নতুন নীতিমালায় এটি আর আলাদা থাকছে না। একই ডিলার সরকারি ভর্তুকির ইউরিয়া ও তিন ধরনের নন-ইউরিয়া সার বিক্রি করবে।
সরকার আগামী বোরো মৌসুমে অর্থাৎ ১ জানুয়ারি এই নীতিমালা বাস্তবায়নের ঘোষণা প্রদান করলেও এখনো পর্যন্ত বর্তমান ডিলারদের সঙ্গে কোনো বৈঠক করেনি, তাদের মতামতও গ্রহণ করেনি।