প্রতিকিমি দেড় হাজার কোটি টাকা নির্মাণ খরচের পরও ২ বছরের মাথায় ত্রুটি

বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প হিসেবে মেট্রোরেলের নাম এসেছে অনেক আগেই। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার লুটপাটের অন্যতম খাত বানিয়েছে মেট্রোরেলকে। প্রতি কিলোমিটার মেট্রোরেলের নির্মাণে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে। আশপাশের দেশের তুলনায় এ খরচ অনেক বেশি, এমনকি বিশ্বের মধ্যে শীর্ষে। মূলত রাজনৈতিক খায়েশ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ২০২৪ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার তাড়াহুড়া করে মেট্রোরেল চালু করে।

সূত্র জানায়, এতো ব্যয়বহুল প্রকল্পে নি¤œমানের যন্ত্রাংশ ব্যবহারের অভিযোগ শুরু থেকেই। সর্বশেষ ফার্মগেটে বিয়ারিং প্যাড ধসে পড়ে আবুল কালাম নামের একপথচারীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এদিকে দুর্ঘটনার পরপরই ৫ সদস্যদের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল পথে ৬২০ পিলারে ইস্পাতের রক্ষাকবচ বসানোর সিদ্ধান্ত হয়।

সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের এক সভায়ও বিষয়টি উঠে এসেছে। মেট্রোরেলে ব্যবহারের আগে বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগে এসব বিয়ারিং প্যাডের কারিগরি মান পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় দেখা গেছে, একাধিক বিয়ারিং প্যাডের মান যথাযথ নয়। ঐ বৈঠকে বলা হয়েছে, মেট্রোরেল প্রকল্পে নি¤œমানের বিয়ারিং প্যাড সরবরাহের ঘটনাটি ঘটেছে উত্তরা-আগারগাঁও অংশের প্যাকেজ ৩ ও ৪-এর নির্মাণ কাজে।

সূত্র জানায়, ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পথে প্রথম মেট্রোরেল চালু হয়। মতিঝিল পর্যন্ত সব স্টেশনে যাত্রী ওঠানামা শুরু হয় ২০২৩ সালের শেষ দিনে। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ২০২৪ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার তাড়াহুড়া করে মেট্রোরেল চালু করে। যদিও তখন যাত্রী নিয়ে চলার আগে পরীক্ষামূলকভাবে চালানো হয়েছে। নিরাপত্তার নানা বিষয় দেখা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তৃতীয় পক্ষ দিয়ে পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা পরীক্ষা করা হলে সব ত্রুটিবিচ্যুতি ধরা পড়ত। যেহেতু ‘বিয়ারিং প্যাড’ খুলে পড়ার ঘটনা দুবার ঘটেছে, তাই এখন নিরাপত্তা নিরীক্ষা করা উচিত। উল্লেখ্য, বিয়ারিং প্যাড মেট্রোরেলের ভায়াডাক্ট বা উড়ালপথ ও পিলারের মধ্যে সংযোগকারী।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী শেখ মইনউদ্দিন বলেন, ‘বিয়ারিং প্যাডে সাধারণত ২০ থেকে ২৫ বছরের আগে সমস্যা হয় না। ঢাকার মেট্রোরেলে এটি খুলে পড়ার ঘটনা অস্বাভাবিক। তদন্তে কারণ বেরিয়ে আসবে বলে আশা করছি।

তিনি বলেন, ‘যেকোনো প্রকল্প চালুর আগে এর মান ও নিরাপত্তাব্যবস্থা থরো চেক (বিস্তারিত যাচাই) করার নিয়ম আছে। সেটা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে করতে হয়। যদি না হয়ে থাকে, সেটা ঠিক হয়নি। এখন আমরা নিরাপত্তা ও কাজের মান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা এবং প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণে আলাদা একটি দল গঠন করব।’

বুয়েটের ব্যুরো অব রিসার্চ, টেস্টিং অ্যান্ড কনসালট্যান্টের পরিচালক ড. সামছুল হক বলেন, সেতু, ফ্লাইওভারের মতো অবকাঠামোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ এ বিয়ারিং প্যাড। এটির মান খারাপ হলে কাঠামোগত ত্রুটি দেখা দেবে। এর প্রভাবে চলাচলের সময় ঝাঁকুনি অনুভূত হতে পারে। এমনকি এটা পিলারের ফাউন্ডেশনেরও ক্ষতি সাধন করতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে এটি ব্যবহারের দিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না।

সূত্র জানায়, বর্তমানে মেট্রোরেলে দৈনিক যাতায়াত করেন সাড়ে চার লাখ যাত্রী। মেট্রোরেলের নিরাপত্তার বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে রোববার ফার্মগেট স্টেশন এলাকায় বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে আবুল কালাম নামের এক যুবক নিহত হওয়ার পর। ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর একই এলাকায় বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল। তখন কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

ডিটিসিএর কর্মকর্তারা বলছেন, মেট্রোরেল চালুর পর থেকে ডিএমটিসিএল একটি নিরাপত্তা প্রতিবেদনও জমা দেয়নি। মেট্রোরেলের কার্যক্রম শুরুর আগে সনদ গ্রহণের জন্য স্বতন্ত্র তৃতীয় পক্ষের কোনো সংস্থাকে নিয়োগ দিতে নির্দেশনা দিয়েছিল ডিটিসিএ। কিন্তু সে কাজ এখনো সম্পন্ন হয়নি।

ডিএমটিসিএল সূত্র জানিয়েছে, সব কটি পিলারের বিয়ারিং পরীক্ষা করা হয়েছে। সে সময় বিয়ারিং সরে যাওয়া কিংবা বিচ্যুতির তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ড্রোন দিয়ে ছবি তোলা হয়নি। অন্যদিকে ইস্পাতের কাঠামো যুক্ত করার বিষয়ের সঙ্গে অর্থ ব্যয় যুক্ত। ফলে কাজটি ঠিকাদার করবে, নাকি মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ করবে-এটি নিয়ে দেনদরবার চলছে।

সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনার পর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। মেট্রোরেল পরিচালনা কোম্পানির পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) আবদুল বাকী মিয়ার নেতৃত্বে ১০ সদস্যের কমিটির ছয়জনই ছিলেন নিজস্ব কর্মকর্তা। চারজন ছিলেন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি।

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে তখন বলা হয়, দৈনন্দিন ট্রেন চলাচলের কারণে গার্ডারের (মেট্রোরেলের কংক্রিটের কাঠামোর অংশ) বিচ্যুতি এবং সংকোচনের ঘটনা ঘটতে পারে। এ জন্য উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল পথের সব বিয়ারিং পরীক্ষা করা এবং ড্রোনের মাধ্যমে ছবি তুলে তা সংরক্ষণের পরামর্শ দেওয়া হয়। পাশাপাশি বিয়ারিংগুলো আটকে রাখার জন্য ইস্পাতের কাঠামো যুক্ত করার সুপারিশ করা হয়।

ডিএমটিসিএল সূত্র জানিয়েছে, সব কটি পিলারের বিয়ারিং পরীক্ষা করা হয়েছে। সে সময় বিয়ারিং সরে যাওয়া কিংবা বিচ্যুতির তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ড্রোন দিয়ে ছবি তোলা হয়নি। অন্যদিকে ইস্পাতের কাঠামো যুক্ত করার বিষয়ের সঙ্গে অর্থ ব্যয় যুক্ত। ফলে কাজটি ঠিকাদার করবে, নাকি মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ করবে-এটি নিয়ে দেনদরবার চলছে। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়েও এর সুরাহা করতে পারেনি।

বিশেষজ্ঞ ও মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বলছে, রোববার ফার্মগেটে যে বিয়ারিং প্যাড খুলে নিচে পড়ে যায়, তা ওই প্যাডের ক্ষয়ের কারণে হয়েছে বলে মনে হয়নি। বরং অবকাঠামোর নকশা বা নির্মাণে ত্রুটির কারণে হতে পারে। ভারী কংক্রিটের স্থাপনার চাপের মধ্য থেকে এটি ফসকে নিচে পড়ে যাওয়ার কথা নয়। ট্রেন চলাচলের ফলে সৃষ্ট কম্পন, তাপমাত্রাসহ নানা কারিগরি কারণে মূল স্থাপনার বিচ্যুতি হয়ে থাকতে পারে।

এদিকে রোববার খুলে পড়ে যাওয়া বিয়ারিং প্যাডের জায়গায় নতুন প্যাড বসিয়ে দুটি ইস্পাতের রক্ষাকবচ দেওয়া হয়েছে। সব কটি পিলারেই এটা করা হবে। তবে এ কাজ কে করবে, সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বলছে, এটি ঠিকাদারকেই করতে হবে। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল পথে ৬২০টি পিলার রয়েছে। এসব পিলারের নিচে বিয়ারিং প্যাড রয়েছে ২ হাজার ৪৮০টি। বিয়ারিং প্যাডগুলোর দৈর্ঘ্য সোয়া দুই ফুটের আশপাশে। চওড়া পৌনে দুই ফুট। আর এটির পুরুত্ব আধা ফুটের মতো। ওজন ৫০ থেকে ৮০ কেজির মধ্যে।

মেট্রোরেল পরিচালনাকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ জানান, রোববারই প্রকল্প পরিচালক ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়েছেন। এতে নিরাপত্তা নীতি অনুসারে দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ প্রদান, আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে সব কটি বিয়ারিং প্যাড পরীক্ষা এবং ক্ষতিগ্রস্ত কোনো প্যাড পেলে তা প্রতিস্থাপন করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটবে না এমন নিরাপত্তা নিশ্চয়তা সনদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অন্যথায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এর আইনি ও আর্থিক দায়ভার ঠিকাদার ও পরামর্শককে বহন করতে হবে বলেও হুঁশিয়ার করা হয়।

তিনি বলেন, কেন বিয়ারিং প্যাড নিচে পড়ল, তা নির্ধারণে তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। সব কটি বিয়ারিং প্যাড আটকে রাখার জন্য স্টিলের রক্ষাকবচ বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে যেসব মেট্রোরেল লাইন নির্মাণ করা হবে, সেগুলোতে বিয়ারিং প্যাড বসানোর জায়গায় কংক্রিটের বেষ্টনী দেওয়া হবে, যাতে এগুলো সরে না যেতে পারে।

এদিকে নকশাগত ও নির্মাণ ত্রুটি, মানহীন বিয়ারিং প্যাড, নির্মাণ পর্যায়ে তদারকির অভাবে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার মতো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে মনে করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞরা এবং মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকা সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) কর্মকর্তারা। এমন বাস্তবতায় অবকাঠামো বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ-মেট্রোরেলসহ অন্যান্য উড়াল সড়ক অবকাঠামো নির্মাণের সময় কোনো ধরনের ত্রুটি বা অনিয়ম হয়েছে কিনা এবং নির্মাণ উপাদানগুলোর মান কেমন তা যাচাইয়ে একটি স্বাধীন সেফটি অডিট পরিচালনা করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে এসব ঘটনার দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করে জড়িত ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

ফার্মগেটের ওই দুর্ঘটনার পর এরই মধ্যে মেট্রোরেল ও ফ্লাইওভারের বিয়ারিং প্যাডের মান নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া রিটে মেট্রোরেলের রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম যথাযথভাবে তদারকির জন্য একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি দেশের সব ফ্লাইওভারের নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করার দিকনির্দেশনাও চাওয়া হয়েছে।