রেমিট্যান্স বৃদ্ধি, নৈতিক ও দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে শিক্ষার সর্বস্তরে আরবি ভাষা পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্তিকরণ’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনারে দেশের শীর্ষ শিক্ষাবিদ ও ইসলামিক স্কলারগণ বলেন, রেমিট্যান্স বাড়াতে আরবি ভাষা শিক্ষার ওপর জনমত সৃষ্টি করা দরকার। মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের দেশের শ্রমিকেরা ভাষা না জানার কারণে অনেক সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছে। ভবিষ্যতে যাতে দেশের জনশক্তির অপচয় না হয় সেদিকে সবার খেয়াল রাখা দরকার। বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম শক্তি হচ্ছে রেমিটেন্স আর এই রেমিটেন্সের সিংহভাগ আসে আরব বিশ্ব থেকে। বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২০ সালে সব অধিবাসীরা ২১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার রেমিটেন্স বাংলাদেশে পাঠায়। এই বিপুলসংখ্যক রেমিটেন্সের ৭৩% আসে গালফভূক্ত অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্য থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের এ বিশাল শ্রমবাজারের প্রধান অবস্থান প্রতিষ্ঠা করা এবং তা উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশ সরকার আরও উদ্যোগী হতে হবে। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ জীবিকার তাগিদে কাজের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাচ্ছেন আরব-বিশ্বে। অথচ আরবি ভাষার সঙ্গে তাদের পূর্ব কোনো সম্পর্ক থাকছে না। তারা পেশাগতভাবে আরবি ভাষায় দক্ষ না হওয়ায় যথাযোগ্য বেতন-ভাতা ও নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ বিশাল শ্রমশক্তি আরবি ভাষায় সুদক্ষ না হওয়ায় যথাযথ মর্যাদা পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন।

গতকাল শনিবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক এডুকেশন এন্ড রিসার্চ ( IIER ) ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ কুরআন প্রচার ফাউন্ডেশন-এর আয়োজনে ‘রেমিট্যান্স বৃদ্ধি, নৈতিক ও দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে শিক্ষার সর্বস্তরে আরবি ভাষা পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্তিকরণ’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনারে বক্তারা এইসব কথা বলেন। বাংলাদেশ কুরআন প্রচার ফাউন্ডেশনের প্রধান উপদেষ্টা মো. তামজিদুর রহমানের সভাপতিত্বে সেমিনারে বক্তব্য রাখেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান, ইসলামি আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. শামসুল আলম, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের পো-ভিসি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি বিভাগে প্রফেসর ড. আব্দুল কাদির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপক তাজুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবু সায়েম, ইলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্য ড. মোঃ খলিলুর রহমান মাদানী, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাদরাসা ও কারিগড়ি শিক্ষা বিভাগের যুগ্মসচিব মো. মনিরুজ্জামান ভূইয়া, ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক এডুকেশন এন্ড রিসার্চ ( IIER ) পরিচালক অধ্যাপক ড. মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান, মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ হেদায়েতুল্লাহ, মানবাধিকার ও আইনী সুরক্ষা কেন্দ্র (মাসুক) নির্বাহী পরিচালক এড. সাবিকুন্নাহার মুন্নী প্রমুখ। জাতীয় সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন, জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটটি (নিপোর্ট), প্রাক্তন ইকোনমিক কাউন্সিল ও মিনিস্টার, বাংলাদেশ দূতাবাস সৌদি আরব ড. মো. আবুল হাসান। সার্বিক তত্বাবধানে-মাওলানা এফ এম ইবরাহীম, চেয়ারম্যান-বাংলাদেশ কুরআন প্রচার ফাউন্ডেশন।

অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, ‘রেমিট্যান্স বাড়াতে আরবি ভাষা শিক্ষা নেওয়ার ওপরে জনমত সৃষ্টি করা দরকার। মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের দেশের শ্রমিকেরা ভাষা না জানায় অনেক সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছেন। ভবিষ্যতে যাতে আমাদের জনশক্তির অপচয় না হয় সেদিকে সবার খেয়াল রাখা দরকার। মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া শ্রমিকদের ‘কাইফা হালুকা, আনা বিখায়ের’ শুধু এটুকু আরবি বাক্য জানলেই হবে না, একজন শ্রমিক যাতে আরবি বুঝতে ও বোঝাতে পারে পাশাপাশি লিখতে পারে সেটা জানা খুবই দরকার। এ জন্য দেশ থেকেই আরবি ভাষা শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠাতে হবে। যদি তা করা না হয় তাহলে মানবিক মর্যাদা, সামাজিক মর্যাদা এবং আর্থিক মর্যাদায়ও আমরা অন্যদের থেকে পিছিয়ে থাকব।’

অধ্যাপক ড. নকীব মোহাম্মদ নসরুল্লাহ বলেন, ‘কারিগরি শিক্ষাবোর্ড অন্তত লাখ কোটি সার্টিফিকেটধারী লোক সৃষ্টি করেছে। সেই সার্টিফিকেটধারী লোকেরা বিদেশ হয়তো গিয়েছে বা যায়নি। যদি না যায়, তাহলে কেন যায়নি। অর্থাৎ আমাদের এখানে বড় একটা শুভংকরের ফাঁকি বা অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা কাজ করেছে বলেই আজকে রেমিট্যান্স প্রাপ্তিতে এই দুর্গতি। অথচ এরাই আমাদের মানবসম্পদ।’

ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের পো-ভিসি অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কর্মীরা মধ্যপ্রাচ্যে অধস্তনের অধস্তন হিসেবে কাজ করে। সবচেয়ে প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে পাকিস্তানি ও শ্রীলঙ্কান বা অন্যরা হচ্ছে বাংলাদেশিদের বস। এটার অন্যতম কারণ ভাষা জানা। তারা ভাষা জানার কারণে মালিকদের কাছাকাছি যেতে পারলেও আমরা যেতে পারি না, তাদের বোঝাতে পারি না। যেকারণে চাইলেও মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের শ্রমিকেরা বড় কোনো পদে যেতে পারেন না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি বিভাগে প্রফেসর ড. আব্দুল কাদির বলেন, ‘জমিজমা বিক্রি করে শ্রমিকেরা মধ্যপ্রাচ্যে গিয়েই টেনশনে পড়েন কীভাবে সেই টাকা তুলবেন। বিদেশে গিয়ে শুধুমাত্র আরবি ভাষা না জানার কারণে তারা নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। এরপর বিদেশে নানান চড়াই উতরাই পেরিয়ে যখন দেশে ফিরে আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধা, তখন বিমানবন্দরে তাদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়Í মনে হয়, একজন আসামি এসেছে। আমাদের এই মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক মূল্যবোধগুলো পরিবর্তন আনা দরকার।’

ইলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্য ড. মোঃ খলিলুর রহমান মাদানী বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত তিনটি ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেগুলো হলো: রেমিট্যান্স, গার্মেন্টস ও গ্রামীণ উন্নয়ন। প্রবাসীদের বলা হয় রেমিট্যান্স যোদ্ধা। সত্যিকার অর্থে তারাই আসল যোদ্ধা। আমরা জাতিগত ভাবে স্বাধীনতা লাভ করেছি। তবে অর্থনৈতিকভাবে এখনো স্বাধীনতা অর্জন করতে পারিনি। এ জন্য বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্যদের কাছে কম্প্রোমাইজ করতে হয়েছে। প্রবাসীরা যে কয় টাকার বেতনে চাকরি করে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি অর্থ দেশে পাঠায়। তারা ওভারটাইম করে বাড়তি আয় করে। বৈদেশিক মুদ্রার পুরোটাই তারা দেশে পাঠায়। প্রবাসীরাই অর্থনৈতিক মুক্তিযোদ্ধা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাদরাসা ও কারিগড়ি শিক্ষা বিভাগের যুগ্মসচিব মো. মনিরুজ্জামান ভূইয়া বলেন, আরবি ভাষা বিশ্বের প্রায় ২৮টি দেশের মাতৃভাষা। ২৫ কোটি মানুষ আরবিকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ব্যবহার করে। এ ভাষার অনেক গুরুত্ব থাকার কারণে ১৯৭৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে আরবি ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ইউনেস্কো ২০১২ সালে ১৮ ডিসেম্বরকে আরবি ভাষা দিবস হিসেবে নির্ধারণ করে। ২০১৩ সালে ইউনেস্কোর উপদেষ্টা পরিষদ আরবি সংস্কৃতি তুলে ধরার লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী এই দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। আফ্রিকান ইউনিয়ন, ওআইসিসহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক সংস্থার অফিশিয়াল ভাষা আরবি। শুধু তাই নয়, ব্যবসায়িক ভাষা ( Trade Language ) হিসেবে-এ ভাষা অনারব দেশের প্রায় প্রতিটি পণ্যের মোড়কে শোভা পায়। পণ্যের গুণগত মান ও বিজ্ঞাপনসংবলিত আরবি লেখা আমাদের দেশের ৫ টাকার বিস্কুটের প্যাকেট লক্ষ্য করা যায়। এতে অতি সহজেই আমাদের কাছে আরবি ভাষার মর্যাদা, গুরুত্ব ও এ ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুমিত হয়। বাংলাদেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের আরবি ভাষায় দক্ষতা আরও বাড়াতে পারলে আমাদের রেমিট্যান্স অনেক গুণ বেড়ে যাবে।

বাংলাদেশ দূতাবাস সৌদি আরবের প্রাক্তন ইকোনমিক কাউন্সিলর ও মিনস্টার মোহাম্মদ আবুল হাসান সেমিনার প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ‘আমরা আরবি ভাষা শিখি ধর্মীয় কারণে, কিন্তু দুনিয়ার কারণে আরবি ভাষা শেখে ফিলিপিন, চাইনিজ, শ্রীলঙ্কা ও ভারতীয়রা। আমি পুরো আরবি ভাষায় বক্তৃতা শুনেছি রিয়াদের চাইনিজ অ্যাম্বাসেডর ও শ্রীলঙ্কান অ্যাম্বাসরকে। আমার দেখা বাংলাদেশি সরকারি কর্মকর্তা যেমন হজ কাউন্সিলর, জেদ্দা, ডিফেন্স অ্যাটাচে, রিয়াদ, সৌদি আরব, ডেপুটি চিপ অব মিশনে রয়েছেন, যারা আরবিতে অনর্গল কথা বলেছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ভাষা শিক্ষা ও শিখানোর ব্যাপারে তৎপর। আরবি ভাষায় প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিজের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) টেকনিক্যাল অ্যান্ড ভোকেশনাল এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট প্রস্তুত রয়েছে। আমরা ওয়াইআইসির ইউনিভার্সিটির মাধ্যমে অনলাইনে প্রশিক্ষণ অনায়াসে চালু করতে পারি। তাদের অফিশিয়াল ভাষা হলো আরবি ও ফার্সি। আমাদের চিকিৎসক, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের আরববিশ্বে চাকরির পথ সুগম করতে দ্রুত অনলাইনে আরবি ভাষা প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করা যেতে পারে। সাধারণ শিক্ষার পাঠ্যক্রমে আরবিকে অন্তর্ভুক্ত করায় সরকারকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। তার সঙ্গে এই ব্যবহারিক আরবি শিক্ষাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নিলে বাংলাদেশর সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’

মানবাধিকার ও আইনী সুরক্ষা কেন্দ্র (মাসুক) নির্বাহী পরিচালক এড. সাবিকুন্নাহার মুন্নী বলেন, বিশ্বের অনেক দেশ আরব বিশ্বে জনশক্তি রপ্তানির জন্য তাদের আরবি ভাষায় দক্ষ করে তোলে। অথচ আমরা আরবি ভাষাকে অবহেলার কারণে সৌদি আরবে অধিকাংশ বাঙালি নিম্ন পর্যায়ের কাজ করতে দেখা যায়। আরবি ভাষার অদক্ষ হওয়ার কারণে তারা অত্যন্ত নিম্ন পর্যায়ে শ্রমিকের মর্যাদা পায়। অপরপক্ষে আরবিতে দক্ষ হওয়ার কারণে ভারত এবং পাকিস্তানের শ্রমিকদের অফিশিয়াল বিভিন্ন কাজে নিয়োগ পেতে দেখা যায়। একটি সমীক্ষায় দেখ যায়, সৌদি আরব থেকে হাজারো বাংলাদেশি যে রেমিটেন্স পাঠান, তার চেয়ে বেশি পাঠান ডেনমার্কের মাত্র ৩০০ জন সৌদিতে কর্মরত ডেনিস নাগরিক। মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিপাইনের লোকেরা বাংলাদেশিদের চেয়ে চার গুণ বেশি বেতন পান। কারণ তারা অনর্গল আরবি বলতে পারেন। তিনি বলেন, আমরা যদি শ্রমিকের বদলে আধা দক্ষ (সেমি স্কিলড) জনশক্তিও বিদেশে পাঠাতে পারি, তাহলে আমাদের রেমিট্যান্স কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। দেশের অদক্ষ, স্বল্প দক্ষ এবং অর্ধশিক্ষিত যে শ্রেণিটি বিদেশে যায়, তাদের সংখ্যা বিশাল, মোট ৮৬ লাখ প্রবাসীর মধ্যে ৫৩ লাখ (৬১ দশমিক ৬ শতাংশ) যারা এসএসসি পাস করেনি। আবার তাদের মাধ্যমেই আসে আমাদের রেমিট্যান্স আয়ের সিংহভাগ।