দেশে গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে দ্বীপ জেলা ভোলায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে আরো পাঁচটি গ্যাস কূপ খনন করবে পেট্রোবাংলা। এসব কূপ খননে মোট ব্যয় হবে ১ হাজার ৫৫৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। কূপগুলোর মধ্যে চারটি সংস্কার হবে, বাকি একটি নতুন কূপ। পেট্রোবাংলার সাবসিডিয়ারি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) এসব কূপ খনন প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে।

জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বুধবারের সভায় প্রকল্পটি পাশ হয়েছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ৩টি প্রকল্প, (১) ২০০০ হর্স পাওয়ার রিগ ক্রয় প্রকল্প’ এবং ৪টি মূল্যায়ন উন্নয়ন কূপ ও ১টি অনুসন্ধান কুপ খনন’ নেসকো এলাকায় নেটওয়ার্ক অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার মর্ডানাইজেশন প্রকল্প। প্রকল্পটি পাস হওয়ায় চলতি বছরের শুরু থেকে ২০২৮ সালের জুনের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করা হবে। বাপেক্সের নিজস্ব ও সরকারি অর্থায়নে ভোলায় এসব কূপ খনন করা হবে।

পেট্রোবাংলা সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভোলা অঞ্চলে চারটি মূল্যায়ন কাম উন্নয়ন কূপ ও একটি নতুন অনুসন্ধান কূপ খনন করা হবে। এর মধ্যে ভোলার শাহবাজপুর-৫, ৭ এবং ভোলা নর্থ-৩, ৪ এ মোট চারটি মূল্যায়ন কাম উন্নয়ন কূপ খনন করা হবে। এছাড়া শাহবাজপুর নর্থ ইস্ট-১ এ একটি অনুসন্ধান কূপ খনন টেস্টিং ও কমপ্লিকেশনের মাধ্যমে প্রস্তাবিত পাঁচটি কূপসহ মোট ২০টি কূপ খনন পরিকল্পনা রয়েছে বাপেক্সের।

প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয়ে সরকারি (জিওবি) ঋণ থেকে আসবে ১ হাজার ২৪৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা ও নিজস্ব অর্থায়নে ব্যয় করা হবে ৩১০ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের এডিপির নিজস্ব অর্থায়ন থেকে প্রায় ৮০ কোটি টাকা দেয়া হবে। প্রকল্প ব্যয়ে দেখানো হয়েছে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ব্যয় হবে ১ কোটি ৩২ লাখ টাকা, পাঁচটি কূপ খনন, টেস্টিং ও কমপ্লিকেশন ব্যয় হবে ১ হাজার ৪৩৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা, ড্রিলিং রিগ ও রিগ যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ২৯ কোটি ৩৪ লাখ, ব্যাংক চার্জ ৪৮ কোটি ৪৫ লাখ, কম্পিউটার সফটওয়্যার খরচ ধরা হয়েছে ১০ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।

দেশে গ্যাসকূপ খননের পাশাপাশি কূপ খননে বাপেক্স দুই হাজার হর্স পাওয়ার সক্ষমতার রিগ ক্রয় করবে। নতুন গ্যাসকূপ খনন, মূল্যায়ন কাম উন্নয়নে বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়াতে এ রিগগুলো কেনা হবে। রিগ ক্রয়ে খরচ হবে ৫৭৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা। যার মধ্যে ৫২০ কোটি টাকা দেবে সরকার। বাকি ৫৭ কোটি টাকা বাপেক্স নিজস্ব অর্থায়ন করবে।

বাপেক্সের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, ‘৫২টি কূপ খনন প্রকল্পের অংশ হিসেবে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। সেই সঙ্গে কূপ খনন তৎপরতা যাতে না কমে, সেজন্য রিগও ক্রয় করা হচ্ছে। নতুন রিগ ক্রয় করা হলে বাপেক্সের রিগের সংখ্যা ও সক্ষমতা যেমন বাড়বে, তেমনি কূপ খননে গতিও বাড়বে।’

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট নথি থেকে জানা গেছে, দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে বাপেক্স ২০২৮ সালের মধ্যে মোট ৫২টি কূপ খনন ও ১৬টি কূপের ওয়ার্কওভার করবে। বর্তমানে বাপেক্সের দুটি খনন রিগ ও দুটি ওয়ার্কওভার রিগ রয়েছে এবং একটি রিগ উন্নয়ন করা হয়েছে। এ পাঁচটি রিগ দিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এতগুলো কূপ খনন করা বেশ কঠিন। যে কারণে নতুন ও উন্নত মানের রিগ ক্রয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

রিগ ক্রয়ের বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বাপেক্সের মেশিনগুলো অনেক পুরোনো ও অদক্ষ হয়ে পড়েছে। সেজন্য রিগ ও নতুন যন্ত্রপাতি কিনতে হচ্ছে। এ রিগ কেনা হলে ২০৩০ ও ২০৪১ সাল পর্যন্ত কূপ খনন, উন্নয়নের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তা করা হবে।

জানা গেছে, দেশে গ্যাস সংকটের কারণে শিল্প-কারখানা সচল রাখা নিয়ে যখন উদ্বিগ্ন বিনিয়োগকারীরা, তখন ভোলার খননকৃত ৯টি কূপের ৫টিতে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা মূল্যের গ্যাসের মজুদ অলস পড়ে আছে। প্রস্তাবিত আরও ১৯টি কূপে ৫ লাখ কোটি টাকার গ্যাসের মজুতের কথা বলছেন ভূতাত্ত্বিকরা।

গেল ১৫ বছরে নতুন নতুন পরিকল্পনার ঘোষণা ছিল আওয়ামী লীগ মন্ত্রীদের রাজনৈতিক আশ্বাস। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি কিছুই। গড়ে ওঠেনি অর্থনৈতিক জোন। স্থবির পড়ে আছে শিল্পপার্কের উদ্যোগ। গত ১ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান গ্যাসফিল্ড পরিদর্শনে এসে এলাকায় অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যানকে ভোলা পরিদর্শনের কথা বলেন।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৫ সালের ৪ অক্টোবর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার শাহবাজপুর-১ কূপে উত্তোলিত গ্যাসে আগুন প্রজ্বালনের মধ্য দিয়ে প্রথম গ্যাসের মজুদ নিশ্চিত করেন। বাপেক্সের নিজস্ব প্রযুক্তিতে প্রথম খননকৃত কূপ এটি। দীর্ঘ ১৩ বছর পর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে খনন করা হয় দ্বিতীয় কূপ। ১২ বছরে খনন করা হয় আরও ৭টি কূপ। ৯টি কূপে গ্যাসের মজুদ রয়েছে প্রায় ২ দশমিক ১৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। নতুন করে আরও ১৯টি কূপ খননের পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে ৫টি কূপের টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। বাপেক্স ভূতাত্ত্বিক জরিপে পরিকল্পনা নেওয়া ৫টি কূপেও আরও এক ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুদ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।