চব্বিশের জুলাই-আগষ্টের গনঅভ্যুত্থানে পুলিশের গুলিতে হতাহতের ঘটনায় সারা দেশে হওয়া ৩ হাজার ২ শত ৩৬ টি মামলায় আসামি হয়েছেন এক হাজার ৫ শত ১০ জন পুলিশ সদস্য। তাঁদের মধ্যে পুলিশের কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান মহাপরিদর্শক (আইজিপি) থেকে শুরু করে কনস্টেবল পদের সদস্যরা রয়েছেন। এসব মামলায় তাঁদের বিরুদ্ধে গুলি চালানোর কিংবা গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। এ মামলাগুলোর মধ্যে কোনটা থানায়, কোনটা আদালতে দায়ের করা হয়েছে। সর্বশেষ মামলাটি হয়েছে চলতি বছরের ২৩ জুলাই। ঢাকার একটি আদালতে দায়ের হওয়া এই মামলায় আসামী হয়েছেন পুলিশের ৫ সদস্য। খবর সংশ্লিষ্ট একাধিক সুত্রের।

এক হাজার ৫ শত ১০ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হলেও এ পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন মাত্র ৬৩ জন। ঘটনার এক বছরের পরও মামলার তদন্তের কাজ হয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি। তদন্ত নিয়ে ধীরে চলার অভিযোগ উঠলেও তদন্তের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা বলছেন, এসব স্পর্শকাতর মামলা। পুলিশ সদস্যরা আসামি থাকায় তদন্ত করতে হবে নির্ভুল। কারণ, তাঁদের বেশির ভাগ বাহিনীতে কর্মরত থাকায় তাড়াহুড়োর তদন্তে ভুল হলে বাহিনীতে ক্ষোভের সৃষ্টি হতে পারে। তাই প্রশ্ন ও বিতর্কমুক্ত রাখতে মামলাগুলোর তদন্ত ধীরেসুস্থে করতে চান তাঁরা। একই কারণে কর্মরত সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে অকাট্য প্রমাণ না পেলে গ্রেফতারও করা হবে না।

মামলার আসামি হলেও গ্রেপ্তার করা যায়নি বিতর্কিত সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মো. মনিরুল ইসলাম, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির ডিবির সাবেক প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, মেহেদী হাসান, অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আক্তারসহ অনেককে। তাঁদের অনেকে দেশত্যাগ করেছেন বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।

জুলাই-আগষ্ট হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা মামলার তদন্তে অগ্রগতি হয়েছে। একটি মামলায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ পুলিশের আট সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন ইতিমধ্যে দাখিল করা হয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, মামলাগুলোর সুষ্ঠু তদন্তের জন্য আটটি রেঞ্জেই অতিরিক্ত ডিআইজি (অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক) পর্যায়ের কর্মকর্তা দিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাঁরা কাজ করছেন।

এর আগে পুলিশের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে মামলা তদন্তে মনিটরিং কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছিল। যথাযথ তদন্তে সক্ষম পুলিশ সদস্যদের দিয়ে মামলার তদন্ত করা হবে। সারাদেশে বিভাগ অনুযায়ী ‘মেনটরিং অ্যান্ড মনিটরিং কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন, অভিজ্ঞ, প্রজ্ঞাসম্পন্ন এবং তদন্তে বিপুল অভিজ্ঞতা আছে, এমন সদস্যদের নিয়ে আলাদা ‘মেনটরিং টিম’ করা হয়েছে। তারা প্রতি জেলায় ও থানায় গিয়ে মামলার তদন্তে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিচ্ছেন বলে জানা গেছে।

জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে নির্বিচার গুলি ও মানুষ হত্যার ঘটনা বাহিনীর ভেতরে-বাইরে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। আন্দোলনকারীদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে বলপ্রয়োগের ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করার দাবি নানা মহল থেকে ওঠে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশ সদরদপ্তর থেকে পুলিশের সাবেক ও বর্তমান বেশ কিছু সদস্যকে গ্রেপ্তারের জন্য মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে আবেদন করা হয়। এর পর বিভিন্ন ধাপে গ্রেফতার প্রক্রিয়া শুরু হয়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয় পুলিশ সদর দফতরের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র দৈনিক সংগ্রামকে জানায়, গত বছরের ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে সারা দেশে হত্যা, হত্যাচেষ্টাসহ বিভিন্ন ঘটনায় এ যাবত ৩ হাজার ২ শত ৩৬ টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব মামলায় তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ, এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি পুলিশ সদস্যদেরও আসামি করা হয়। এসব মামলা করেন জুলাই অভ্যুত্থানে নিহতদের স্বজন এবং আহত ব্যক্তি ও তাঁদের স্বজনেরা। এসব মামলায় আসামি হিসেবে আছেন পুলিশের ১ হাজার ৫১০ পুলিশ সদস্য। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ৭ জন সাবেক আইজিপি, ৪৪ জন সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি, একজন অতিরিক্ত আইজিপি, ১৩ জন সাবেক ডিআইজি ও ১৫ জন বর্তমান ডিআইজি, ৪৭ জন অতিরিক্ত ডিআইজি, ২ জন সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজ, ৩ জন সাবেক পুলিশ সুপার, ৭৪ জন পুলিশ সুপার (এসপি), ৭৯ জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ৪১ জন সহকারী পুলিশ সুপার, ২৪৫ জন পরিদর্শক, একজন পরিদর্শক (সশস্ত্র), একজন টিআই, ৪২২ জন উপপরিদর্শক (এসআই-নিরস্ত্র), ৫ জন উপপরিদর্শক (সশস্ত্র), একজন টিএসআই, ১৪৮ জন এএসআই (নিরস্ত্র), ৮ জন এএসআই (সশস্ত্র), একজন এটিএসআই, ৯ জন নায়েক, ৩৩৪ জন কনস্টেবল। বাকি ৯ জন পদ উল্লেখ না থাকা পুলিশ সদস্য।

পুলিশ সদর দফতরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকে জুলাই-আগষ্টের গনআন্দোলন চলাকালে ৫ আগষ্ট পর্যন্ত পুলিশের ৪৬ সদস্য নিহত হন। এ ঘটনায়ও মামলা হয়েছে পৃথকভাবে।

মামলার বিশ্লেষনে দেখা যায়, এ যাবত হওয়া মামলার মধ্যে, ৭ জন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আসামি হয়েছেন। তারা হলেন, নূর মোহাম্মদ, হাসান মাহমুদ খন্দকার, এম সানাউল হক, এ কে এম শহীদুল হক, জাবেদ পাটোয়ারী, বেনজীর আহমেদ ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। মামুনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১৯৯টি, শহীদুল হকের বিরুদ্ধে ৩০ টি, বেনজীরের বিরুদ্ধে ১৬ টি, হাসান মাহমুদ খন্দকারের বিরুদ্ধে ৭টি, জাবেদ পাটোয়ারীর বিরুদ্ধে ৩ টি ও সানাউলের বিরুদ্ধে ৩ টি, নূর মোহাম্মদের বিরুদ্ধে ৩ টি।

যাদের বিরুদ্ধে মামলা বেশি

সংশ্লিষ্ট সুত্রগুলোর তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে। তাঁর মামলার সংখ্যা ১৯৯ টি। তারপরেই আছেন ডিএমপির তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ প্রকাশ ডিবি হারুন। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১৯৬ টি। এরপরই রয়েছেন তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান। তাঁর মামলার সংখ্যা ১৬৩ টি। এরপর রয়েছেন ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার (অতিরিক্ত ডিআইজি) বিপ্লব কুমার সরকার। তাঁর বিরুদ্ধে ১৪২ টি মামলা হয়েছে। সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মো. মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে রয়েছে ৬৭ টি মামলা। ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার (অতিরিক্ত ডিআইজি) এস এম মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে ৩৭টি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া সাবেক আইজিপি শহীদুল হকের বিরুদ্ধে ৩০, বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে ১৬, র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) ব্যারিস্টার হারুন অর রশিদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ২১ টি। ডিএমপির তৎকালীন উপকমিশনারের (ডিসি) মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইনের বিরুদ্ধে, মামলা ৩০টি। ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি করা নিয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে কথা বলছেন ইকবাল। মুঠোফোনে একটি ভিডিও দেখিয়ে তিনি বলছিলেন, ‘গুলি করে লাশ নামানো লাগছে স্যার। গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা। একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না। এইটা হলো স্যার সবচেয়ে বড় আতঙ্কের এবং দুশ্চিন্তার বিষয়...।’ এ সময় সেখানে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ও সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব জাহাঙ্গীর আলম উপস্থিত ছিলেন।

আসামির তালিকায় আরও রয়েছেন সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মোখলেসুর রহমান, শফিকুল ইসলাম, ইকবাল বাহার, মাহবুবুর রহমান, আতিকুল ইসলাম, বনজ কুমার মজুমদার, দিদার আহমেদ, মোহাম্মদ আলী মিয়া, এম খুরশিদ হোসেন, সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, খন্দকার লুৎফুল কবীর, কৃষ্ণপদ রায়, এ কে এম হাফিজ আক্তার, সাবেক ডিআইজি এস এম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান, ইব্রাহিম ফাতেমী, মো. আসাদুজ্জামান, বিনয়কৃষ্ণ বালা, শেখ মোহাম্মদ মারুফ হাসান, শেখ হেমায়েত উদ্দিন, খন্দকার লুৎফুল কবীর, বশির আহমেদ, আনোয়ার হোসেন, ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন, আব্দুল জলিল মণ্ডল, নূরে আলম মিনা, জাকির হোসেন খান, সাইফুল ইসলাম, সৈয়দ নুরুল ইসলাম, এ কে এম নাহিদুল ইসলাম, ডিএমপির সাবেক কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া, যুগ্ম কমিশনার মশিউর রহমান, ডিআইজি মোল্লা নজরুল ইসলাম প্রমুখ।

আলোচিত যাঁরা গ্রেফতার

সাবেক আইজি শহীদুল ইসলাম, আবদুল্লাহ আল মামুন, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, সাবেক সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার, ডিএমপির সাবেক উপকমিশনার মো. জসীম উদ্দীন মোল্লা, পুলিশ সুপার (এসপি) তানভীর সালেহীন, মহিউদ্দিন ফারুকী, আবদুল মান্নান, এস এম তানভীর আরাফাত, আসাদুজ্জামান, মো. আবদুল্লাহিল কাফী, জুয়েল রানা, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম, ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহিদুল ইসলাম, খুলনা মহানগর পুলিশের (কেএমপি) অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. সাদেক কাওছার দস্তগীর, বরিশালের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলেপ উদ্দিন, ডিএমপির মিরপুর বিভাগের দারুস সালাম অঞ্চলের অতিরিক্ত উপকমিশনার এম এম মইনুল ইসলাম, ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের সহকারী কমিশনার ইফতেখার মাহমুদ ও মো. তানজিল আহমেদ, ডিএমপির বাড্ডা অঞ্চলের সহকারী কমিশনার রাজন কুমার সাহা, যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান, গুলশান থানার সাবেক ওসি মাজহারুল ইসলাম প্রমুখ।

সর্বশেষ মামলায় আসামী ৫ পুলিশ

গত ২৩ জুলাই সর্বশেষ মামলাটি দায়ের করা হয় জুলাই-আগষ্ট গনআন্দোলনে হতাহতের ঘটনায়। রাজধানীর শাহআলী থানার যুবদল কর্মী আসিফ শিকদারকে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগে পাঁচ পুলিশ, তিন সেনা কর্মকর্তাসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মো. জাকির হোসেন গালিবের আদালতে এ মামলা করেন নিহতের মা স্বপ্না বেগম। এ সময় বাদির জবানবন্দি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন আদালত। মামলার আসামিরা হলেন, শাহআলী থানার ওসি শরিফুল ইসলাম, ওসি (তদন্ত) মতিউর রহমান, ডিএমপির দারুসসালাম জোনের এসি এমদাদুল হক, এডিসি জাকারিয়া, ডিএমপির মিরপুর ডিভিশনের ডিসি মোহাম্মদ মাকসুদুর রহমান। আসামিদের বিরুদ্ধে গত ২০ জুলাই মধ্যরাতে আসিফ শিকদারকে বাসা থেকে হাত-পা বেঁধে শাহআলী থানায় নিয়ে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে।