প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে শহর-এর দেখভাল আর উন্নয়নসহ আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনে কাজ করছে স্থানীয় সরকার বিভাগের ২৫টি সংস্থা। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দুটিই হচ্ছে, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর (ডিপিএইচই) ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)। কাজকর্মে এই সংস্থা দুটি এখন ‘গতিহারা’। চব্বিশের গণআন্দোলনের পর এই সংস্থা দুটির সদর দফতর থেকে উপজেলা পর্যায়ের অবস্থা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ‘আমরা সবাই রাজা, আমাদেরই রাজার রাজত্বে’। যদিও রূপকল্প (মিশন) হচ্ছে, জনঅংশগ্রহণে কার্যকর স্থানীয় সরকার। আর অভিলক্ষ্য (ভিশন) স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ এবং আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন কর্মকা- বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন। অথচ, সঠিক নেতৃত্বের অভাব, নানা অনিয়মম আর ঘুষ-দুর্নীতির কারণে এই রুপকল্প ও অভিলক্ষ্য থেকে পিছিয়ে আছে সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগ। ফলে, জনস্বাস্থ্য ও এলজিইডিতে ‘হযবরল’। সংশ্লিষ্ট একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রে এ খবর জানা গেছে।

জানা গেছে, জনস্বাস্থ্য ও এলজিইডির মতো স্থানীয় সরকারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার মাঠ পর্যায় থেকে শীর্ষ পর্যায়ের মধ্যে শতাধিক পদ শূণ্য রয়েছে, যার মধ্যে একাধিক পদ চলছে চলতি আর রুটিন দায়িত্ব নিয়ে। আর কোনটি চলছে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে, জুনিয়রদের দিয়ে, আবার কোনটি চলছে সিনিয়রদের তদারকির মাধ্যমে। দীর্ঘদিন ধরে চলা এসব শূণ্য পদের বিপরীতে পদোন্নতি না হওয়া আর যোগ্যদের পদায়ন না করাকেই দূষছেন সংশ্লিষ্টরা। মন্ত্রনালয়ের নীতি নির্ধারকদের দূরদর্শীতাকে দায়ী করছেন অনেকেই। দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতি না থাকায় ওই দুটি সংস্থার বঞ্চিতরা মনোবল হারিয়ে কাজকর্মে গা ছাড়া ভাব।

জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো: রেজাউল মাকছুদ জাহেদী দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, জনস্বাস্থ্য ও এলজিইডিতে যেসব পদ শূণ্য রয়েছে, তা পূরনের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা প্রধানদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তারা শূণ্য পদগুলো পূরনের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরন করে মন্ত্রনালয়ে মতামত পাঠাবেন।

যোগাযোগ করা হলে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) প্রধান প্রকৌশলী (রুটিন দায়িত্ব) মো: আনোয়ার হোসেন দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, শূণ্য পদগুলো পূরনের জন্য সংস্থার পক্ষ থেকে কার্যবিবরনী প্রস্তুত করে একটি তালিকা পাঠানো হয়েছে বিদ্যমান পদের বিপরীতে। সেটা মন্ত্রনালয়ের সচিবের হাত হয়ে উপদেষ্টার টেবিলে গিয়ে পড়ে আছে। তিনি জানান, সংস্থাটির গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর মধ্যে ১৬ টি তত্বাবধায় প্রকৌশলী (এসই) ও ৬৮ টি নির্বাহী প্রকৌশলীর (এক্সইয়েন) পদ শূণ্য রয়েছে। এছাড়া, মাঠ পর্যায়ের অনেক পদই শূণ্য নিয়ে চলছে এলজিইডি।

এলজিইডির কাজকর্ম চলছে শূণ্যতায় ভর করে : দেশের স্থানীয় পর্যায়ে গ্রামীণ, পানিসম্পদ ও নগর অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি এসব অবকাঠামোর রক্ষণাবেক্ষণ এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে বিভিন্ন বিষয়ে কারিগরি সহায়তা দিয়ে থাকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)। সড়ক, সেতু, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার অবকাঠামো থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ, স্যানিটেশনসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের উন্নয়নে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সংস্থাটি। কিন্তু প্রকৌশলীদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে সেখানে আটকে আছে পদোন্নতি। কর্মকর্তাদের রেষারেষির প্রভাব পড়ছে গ্রামীণ এলাকার উন্নয়নে।

অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী ও সহকারী প্রকৌশলী, সব স্তরেই পদোন্নতি আটকে আছে। ফলে মাঠপর্যায়ে দুই শতাধিক উপজেলা প্রকৌশলী অতিরিক্ত দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। সদর দপ্তরে একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে ২-৩টি দপ্তরের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। এতে প্রকল্প অনুমোদন ও বাস্তবায়নে গতি কমে এসেছে।

জানা গেছে, এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলীর কর্মকা- চলছে রুটিন দায়িত্বে। অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন প্রধান প্রকৌশলীর রুটিন দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি গ্রামীণ সেতু সহায়তা কর্মসূচির প্রকল্প পরিচালক। ১৩টি অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর পদের বিপরীতে এখন কর্মরত আছেন মাত্র চারজন। বছর শেষে সংখ্যা নেমে আসবে একজনের কোটায়।

এলজিইডিতে প্রকৌশলীদের মধ্যে একাধিক গ্রুপ রয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে ২৫৭ কর্মকর্তা বিভিন্ন প্রকল্পে চুক্তিতে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। এদের মধ্যে ২০০ জন এখনো কর্মরত। হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের রায়ের ভিত্তিতে তাদের চাকরি স্থায়ী হয়। ২০১৯ সালে সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী পদে তাঁদের পদোন্নতি হয়। নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাহী প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি পাওয়ার কথা থাকলেও মামলা জটিলতায় তা আটকে আছে। বর্তমানে অর্ধশতাধিক নির্বাহী প্রকৌশলীর পদ শূন্য থাকলেও সে পদে পদোন্নতি বা চলতি দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে না।

সূত্র জানায়, পদোন্নতি প্রক্রিয়া মূলত রেষারেষি, মামলা-মোকদ্দমা ও অভ্যন্তরীণ কাদা ছোড়াছুড়ির কারণে আটকে গেছে। সহকারী প্রকৌশলী থেকে নির্বাহী প্রকৌশলী পদোন্নতিতে তিনটি গ্রুপ, ২৫৭ জনের গ্রুপ, পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া জামাল গ্রুপ এবং ২০০৫ ব্যাচ, পরস্পরের বিরুদ্ধে ঠেলাঠেলি করছে। দীর্ঘদিনের এই বিরোধে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এভাবে চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে নির্বাহী প্রকৌশলীর অনেক পদ শূন্য হয়ে পড়বে, পোস্টিং দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত জনবলও থাকবে না।

জানা গেছে, প্রশাসনিক রেষারেষি ও দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের এই অচলাবস্থা শুধু কর্মকর্তাদের হতাশই করছে না, বরং দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রকল্প বাস্তবায়নেও সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায়, এলজিইডিতে শূণ্যতা প্রকট আকার ধারন করেছে। বলতে গেলে কাজ কর্মে অচলাবস্থা। দৈনন্দিন কাজগুলো চলছে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে। শূণ্য পদ পূরনের জন্য দফায় দফায় প্রস্তাব পেশ করা হলেও উপদেষ্টার দফতরে সেসব প্রস্তাব পড়ে আছে বলে অভিযোগে প্রকাশ। সুত্র মতে, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর পদ শূণ্য রয়েছে ১৪ টি। কয়েকজন তত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে সেসব পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কোনমতে কাজ চালিয়ে নেয়ার জন্য। তত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর পদ শূণ্য রয়েছে ১১ টি। নির্বাহী প্রকৌশলীর পদ শূণ্য ৮৫ টি। বিভিন্ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকের পদ শূণ্য রয়েছে ৩০টির মতো।

পূর্ণাঙ্গ প্রধান প্রকৌশলী পাচ্ছে না এলজিইডি : এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলীর পদটি গ্রেড-১ সমমানের। সর্বশেষ এই মর্যাদা নিয়ে অবসরে গেছেন চলতি বছরের ফেব্রুয়ারীর প্রথম সপ্তাহে আলী আকতার হোসেন। এরপর জেষ্ঠ্যতার তালিকা লংঘন করে বেশ কয়েকজনকে ডিঙ্গিয়ে প্রধান প্রকৌশলী করা হয় গ্রেড-৩ মানের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো: আব্দুর রশীদ মিয়াকে। স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে তাকে প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব দেয়ার সময় আদেশে বলা হয়, আব্দুর রশীদ মিয়া চলতি দায়িত্বে প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে উচ্চতর পদের পদবী ব্যবহার করবেন। ছয় মাসের দায়িত্ব শেষে তিনি তাঁর গ্রেড পরিবর্তনের সুযোগ পাননি। চলতি দায়িত্বের বোঝা কাধেঁ নিয়েই এলজিইডি ত্যাগ করেন সেপ্টেম্বর মাসের ৪ তারিখে। এরপর আরেকজন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীকে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে বসায় সরকার। তাকে দেয়া হয় রুটিন দায়িত্ব। রুটিন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী মো: আনোয়ার হোসেন অবসরে গেছেন গত ২৫ অক্টোবর শনিবার। এরপর যিনি দায়িত্বে আসবেন, তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগ।

অভিযোগে প্রকাশ, নিয়মিতভাবে পদোন্নতি না দেয়ায় সংস্থাটির শীর্ষ পদগুলোতে শূণ্যতার সৃষ্টি হয়। জেষ্ঠ্যতার তালিকা না মেনে বর্তমান সরকার যাকে ইচ্ছে তাকে বসানোর যে প্রক্রিয়ায় হাঁটছে, তাতে করেই এলজিইডির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে। এতে করে মাঠ পর্যায়ের উন্নয়নে প্রভাব পড়ছে। সবার মাঝে বিরাজ করছে গা ছাড়া ভাব।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরে পদোন্নতি নেই এক যুগেও : জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের ক্যাডার কর্মকর্তার সংখ্যা ৪৫৮ টি। সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলীর পদটি গ্রেড-১ সমমানের। বর্তমানে প্রধান প্রকৌশলী মীর আব্দুস সহিদ রুটিন দায়িত্বে কাজকর্ম করছেন। প্রধান প্রকৌশলীর পদটি দীর্ঘদিন ধরে শূণ্য। রুটিন দায়িত্ব নিয়েই তিনি অবসরে চলে যাবেন আগামী নবেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। নবেম্বরের শেষ দিকে অবসরে যাবেন একজন নির্বাহী প্রকৌশলী। এর আগে গত সেপ্টেম্বরে অবসরে গেছেন আরও দু‘জন নির্বাহী প্রকৌশলী। শীর্ষ পদগুলো থেকে অবসরে যাওয়ার আগেই জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালকের ১৬ টি পদ শূণ্য রয়েছে অনেকদিন ধরে। সব মিলে নবেম্বরে সংস্থাটির ওপর ভর করবে বিরাট শূণ্যতা।

জানা গেছে, ক্যাডার কর্মকর্তারা পদোন্নতির যোগ্য, সব শর্ত পূরণ করেছেন, তবু আটকে আছেন। অন্যদিকে যোগ্যতা পূরণ করেননি এমন ৯০ জন নন-ক্যাডার কর্মকর্তাকে ক্যাডার বানিয়ে নন-ক্যাডারদের পদোন্নতি দিয়ে ক্যাডার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈষম্য করার অভিযোগ উঠেছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরে।

অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এখানে বিসিএসের মাধ্যমে সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত ক্যাডার কর্মকর্তারা যোগ দেওয়ার পর থেকে একই পদে আছেন। ১২ বছরের বেশি সময় হয়ে গেল, কোনো পদোন্নতি পাননি তাঁরা। অথচ যাঁরা ক্যাডার কর্মকর্তা নন, তারা পদোন্নতি পেয়ে চলেছেন। চাকরির বিধিমালা লঙ্ঘন করে বিভাগীয় পরীক্ষা বা সিনিয়র স্কেল পরীক্ষা ছাড়াই কিছু কর্মকর্তা নির্বাহী প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও নন-ক্যাডার থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত সহকারী প্রকৌশলীকে ক্যাডারভুক্ত করে সহকারী প্রকৌশলী পদ থেকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এতে পিএসসির মাধ্যমে ৩০, ৩১ ও ৩২তম বিসিএসে সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে ক্যাডার কর্মকর্তারা বলেন, সরকারে বড় ধরনের বদলের পর প্রশাসন ক্যাডারে আর পুলিশ ক্যাডারে যেভাবে নানা পদোন্নতি আর সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তাতে আমরাও আশান্বিত হয়েছিলাম। ১২ বছরের অপেক্ষার পালা শেষ হওয়ার আশায় ছিলাম। কিন্তু আমাদের দিকে কেউ ফিরেও তাকায়নি। সমস্যার কথা বলতে গিয়ে উল্টো হেনস্তার শিকার হয়েছেন আমাদের কর্মকর্তারা। অথচ এটা আমাদের যৌক্তিক ও প্রাপ্য দাবি। অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ৯০ জন কর্মকর্তা মূলত ৯ম গ্রেডের। তাঁরা কী কারণে ৪র্থ বা ৫ম গ্রেডের বেতন গ্রহণ করছেন, সেটিও বোঝা যাচ্ছে না। ভুয়া তথ্য প্রদান করে কিছু কর্মকর্তা সিনিয়র স্কেল পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে কেন কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না।

পদোন্নতিবঞ্চিত একজন ক্যাডার কর্মকর্তা বলেন, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর একটি ক্যাডার অধিদপ্তর হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন সময় নন-ক্যাডার ও প্রকল্পের মাধ্যমে নিয়োগ করা কর্মকর্তাদের অবৈধভাবে ক্যাডারভুক্তকরণ ও পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন বিসিএসে ক্যাডার কর্মকর্তা নিয়োগের ফাঁকে ফাঁকে নন-ক্যাডার কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। সহকারী প্রকৌশলী পদে অল্পসংখ্যক ক্যাডার ও অধিক সংখ্যক নন-ক্যাডার নিয়োগ দেওয়ায় ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা যোগদানের পর থেকেই বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এ অধিদপ্তরে প্রকল্প থেকে আত্তীকৃত, ক্যাডার ও নন-ক্যাডারের সংমিশ্রণে একটি জগাখিচুড়ি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

পদোন্নতিবঞ্চিত আরেকজন ক্যাডার কর্মকর্তা বলেন, বিগত সরকারের আমলে কিছু প্রভাবশালী ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার প্রভাবে বেআইনিভাবে নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের একাধিকবার ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এমনকি যোগ্যতাসম্পন্ন ক্যাডার কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করে নন-ক্যাডারদের ক্যাডারভুক্তির পাঁচ মাসের মধ্যে তাঁদের পঞ্চম গ্রেডে পদোন্নতিও দেওয়া হয়। কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে এসব অবৈধ প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল স্থানীয় সরকার বিভাগ। সেগুলো এখন তদন্ত করলেই প্রমাণ পাওয়া যাবে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে নিয়মিত করা ৩২ জন, ৫৮ জন নন-ক্যাডারসহ মোট ৯০ জন সহকারী প্রকৌশলীকে ক্যাডার ভুক্তির উদ্দেশ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২০২২ সালে নিয়োগ বিধিমালা সংশোধন করে। যেখানে ভূতাপেক্ষিক ক্যাডার ভুক্তির কোনো নির্দেশনা ছিল না। নিয়োগবিধি সংশোধনে এবং ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল) গঠন ও ক্যাডার বিধিমালা, ১৯৮০’ সংশোধনপূর্বক সহকারী প্রকৌশলীর ক্যাডার পদ ৫০টি থেকে ২৩৫টিতে বৃদ্ধির প্রজ্ঞাপনেও কোনো ভূতাপেক্ষিক কার্যকারিতা দেওয়া হয়নি। এমনকি বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন সচিবালয় ওই ৯০ কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষভাবে ক্যাডার পদে অন্তর্ভুক্ত করার কোনো সুপারিশ করেনি। বরং বিদ্যমান ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ার পর ওই ৯০ নন-ক্যাডার কর্মকর্তাকে ক্যাডারভুক্ত করার জন্য সুপারিশ করে পিএসসি। তা সত্ত্বেও স্থানীয় সরকার বিভাগ ২০২২ সালে ৯০ কর্মকর্তাকে বিসিএস জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ক্যাডারে তাদের রাজস্ব খাতে যোগদানের তারিখ থেকে ভূতাপেক্ষভাবে ক্যাডারভুক্ত করে। ফলে ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় থেকে এই ৯০ কর্মকর্তা ভূতাপেক্ষভাবে ক্যাডার হয়ে যান ২০২২ সালে এসে। এই গেজেট প্রকাশের ফলে বিভিন্ন অসামঞ্জস্যতা দেখা যায়। যে সময় থেকে তাঁরা ক্যাডারভুক্ত, সে সময়ে ক্যাডারে পর্যাপ্ত পদই ছিল না। এই গেজেট প্রকাশের ফলে বিদ্যমান ক্যাডার কর্মকর্তারা জ্যেষ্ঠতার ক্ষেত্রে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এই ৯০ জনের মধ্যে অনেকে বিসিএস পরীক্ষাই দেননি। আবার কয়েকজন বিসিএসে উত্তীর্ণ হলেও পদস্বল্পতার কারণে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। অথচ বিসিএস ক্যাডারদের কয়েক মাস আগে অধিদপ্তরে নন-ক্যাডার পদে যোগদান করে তাঁরা ক্যাডার কর্মকর্তাদের সিনিয়র হয়ে যান। এ ছাড়া এই অধিদপ্তরের বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী ও অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ওই গেজেট প্রকাশের পর থেকে তাঁদের অধীন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার জুনিয়র হয়ে যান।

ক্যাডার কর্মকর্তারা গত ২৫ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপদেষ্টার কাছে জরুরি ভিত্তিতে ৯০ জনের এনক্যাডারমেন্টের প্রজ্ঞাপন বাতিল, এনক্যাডার কর্মকর্তাদের পঞ্চম গ্রেডে পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন সংশোধন ও পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তাদের বিধিসম্মতভাবে পদোন্নতি প্রদানের দাবি জানান। তাঁরা মনে করেন এ সমস্যার সমাধান করা না হলে, বিদ্যমান ২৫ ক্যাডার কর্মকর্তাদের মতো ৪১তম বিসিএসের মাধ্যমে নতুন যোগদান করা ৩১ জন ও ৪৩তম বিসিএসের মাধ্যমে সুপারিশ করা ৫০ জন কর্মকর্তাও পরবর্তী সময় এ বৈষম্যের শিকার হবেন।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মো: রেজাউল মাকছুদ জাহেদী বলেন, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের পদোন্নতি নিয়ে জটিলতা তৈরি করা হয়েছে বিগত আমলে। যার কারণে বিরাট শূণ্যতা দেখা দিয়েছে। এই শূণ্য পদগুলো পূরণের জন্য সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে মূল্যায়ন চাওয়া হয়েছে। এজন্য তালিকাসহকারে একটি চিঠি দেয়া হয়েছে মাস দেড়েক আগে। ওই সংস্থার মূল্যায়ন রিপোর্ট পাওয়ার পরই মন্ত্রণালয় থেকে শূণ্য পদ পূরণের উদ্যোগ হিসেবে পদোন্নতির প্রক্রিয়া শুরু করা হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

স্থানীয় সরকার সচিব জানান, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের প্রশাসনিক কাজের গতিশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে করনীয় নির্ধারনের জন্য চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দেয়া হয়েছে গত ২২ সেপ্টেম্বর। এই কমিটির প্রধান করা হয়েছে যুগ্মসচিব ড. মুহা. মনিরুজ্জামানকে। কমিটির সদস্যরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের কর্মকর্তাগনের গ্রেডেশন তালিকা হালনাগাদ করবেন। এছাড়া, অধিদফতরের জনবল কাঠামো হালনাগাদের বিষয়েও পর্যালোচনা ও সুপারিশ করবেন।