লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেসে ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল বৃহস্পতিবার ব্রিটেনের রাজার সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতের জন্য পৌঁছালে তিনি প্রধান উপদেষ্টাকে স্বাগত জানান। প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার এ তথ্য জানান।
বৃহস্পতিবার লন্ডনে সফরের তৃতীয় দিনে একাধিক কর্মসূচিতে অংশ নেন প্রধান উপদেষ্টা। প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, দিনের শুরুতে বেলা ১১টা ২০ মিনিট থেকে ১১টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত রাজা তৃতীয় চার্লসের সঙ্গে বৈঠক করেন অধ্যাপক ইউনূস।
এরপর দুপুর দেড়টা থেকে ৩টা পর্যন্ত তিনি রাজা তৃতীয় চার্লসের দেওয়া পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে অংশ নেন। বিকেল সাড়ে ৩টায় হাউজ অব কমন্সের স্যার লিন্ডসে হোয়েলের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে দ্বি-পাক্ষিক সহযোগিতা, সামাজিক ব্যবসা এবং জলবায়ু পরিবর্তনসহ সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে সাড়ে ৫টা পর্যন্ত তিনি একটি ‘মিট অ্যান্ড গ্রিট’ অনুষ্ঠানে কমিউনিটি নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। দিনের শেষ কর্মসূচিতে সন্ধ্যা ৬টা ২৫ মিনিট থেকে ৬টা ৪৫ মিনিট পর্যন্ত উপিএল লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জয় শ্রফ অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এ সফরের মাধ্যমে অধ্যাপক ইউনূস তার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করার পাশাপাশি সামাজিক ব্যবসার অগ্রগতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচনের সুযোগ সৃষ্টি করছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, বাংলাদেশের যে একটা অবস্থার পরিবর্তন (ট্রানজিশন) হচ্ছে তা নিয়ে কথা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা রাজা চার্লসকে জানিয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে কি কি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, রাজা চার্লস যেহেতু অধ্যাপক ইউনূসের দীর্ঘদিনের পরিচিত, তাই তাদের মধ্যে পুরোনো দিনের নানান স্মৃতি নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে। রাজা চার্লসের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎটি যুক্তরাজ্য সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট ছিল।
ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠক আজ : লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের বৈঠক হচ্ছে আজ। শুক্রবার লন্ডনের স্থানীয় সময় সকাল নয়টায় সেন্ট্রাল লন্ডনের পার্ক লেনের ছয় তারকা ডরচেস্টার হোটেলে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ইতিমধ্যে দেশে-বিদেশে এই বৈঠক নিয়ে ব্যাপক কৌতূহল তৈরি হয়েছে। বলা হচ্ছে দুই জনের মধ্যে ওয়ান টু ওয়ান আলোচনা হবে।
বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে বৈঠকে আগামী জাতীয় নির্বাচনের সময় নিয়ে আলোচনা প্রাধান্য পেতে পারে। এ ছাড়া চলমান সংস্কার ও বিচারের বিষয়ও আলোচনায় থাকবে। অন্যদিকে মঙ্গলবার লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, তারেক রহমান এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলের নেতা এবং অধ্যাপক ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান। তাঁরা যখন বসবেন, তখন বাংলাদেশের এখনকার যেকোনো বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। আলোচনায় বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী জাতীয় নির্বাচন, জুলাই চার্টার (জুলাই সনদ)Ñএগুলোর যেকোনো বিষয়ে আলাপ হতে পারে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের আগে লন্ডনে গেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
এই বৈঠক থেকে ইতিবাচক ফল আসবে বলেই মনে করা হচ্ছে। বৈঠক নিয়ে নানা বিশ্লেষণ করছেন বিশ্লেষকরা। প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও। চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার, বিচার, জুলাই চার্টারসহ (জুলাই সনদ) নানা ইস্যু আলোচনায় উঠে আসবে বলেই মনে করা হচ্ছে। এমনকি নির্বাচিত পরবর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর জাতীয় সংসদে অন্তর্বর্তী সরকারের সব কর্মকা- অনুমোদন দেওয়াসহ এ সংক্রান্ত অনেক কিছু আলোচনায় আসবে বলে বিশ্লেষকদের অনেকে অভিমত দিয়েছেন। বিশেষ করে বিএনপির সিনিয়র নেতারা তারেক রহমান ও ড. ইউনূসের বৈঠক নিয়ে নানা আশার বাণী শোনাচ্ছেন।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, লন্ডনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে আসন্ন বৈঠকটি ‘অনাদিকাল পর্যন্ত’ দেশের গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ বৈঠককে ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন, সংস্কার এবং গণতন্ত্রকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে এ বৈঠক তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব গত বুধবার বলেন, যে কোনো দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার আলোচনা হতেই পারে। এটি গণতান্ত্রিক চর্চারই অংশ। তবে এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে যেন অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর নতুন করে বাড়তি চাপ তৈরি না হয়। আমাদের প্রত্যাশা হচ্ছে উভয়ের মধ্যে যে আলোচনা হবে সেটা যেন শুধু নির্বাচনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে। বিচার এবং সংস্কারের বিষয়টি যেন সমান গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়।
বৈঠকে দলীয় রাজনীতির বিশুদ্ধতা ও সংস্কার নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা এবং তারেক রহমানের মধ্যে আলোচনা হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে দলটির যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান এ মন্তব্য করেন। বিবৃতিতে গাজী আতাউর রহমান বলেন, স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও দেশে পরিপক্ব রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। গত ১৫ বছরের স্বৈরাচারবিরোধী লড়াই ও অভ্যুত্থানের পর জাতি সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রত্যাশা করেছিল, কিন্তু বর্তমান রাজনীতির বাস্তবতা হতাশাজনক।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মুখপাত্র বলেন,নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড অত্যন্ত জরুরি। এটি কেবল রাজনৈতিক নয়, প্রশাসনিক, মনস্তাত্ত্বিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ও। প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন সফরের আচরণে ওই ভারসাম্য বিঘিœত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রত্যাশা করে, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে সব রাজনৈতিক দলের প্রতি সমভাবে নিরপেক্ষ আচরণ করা হবে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের মধ্যে আলোচনা হওয়া খবুই জরুরি। বিএনপি অন্যতম প্রধান স্টেকহোল্ডার। তার প্রধান নেতৃত্বের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক কিংবা তিনি (তারেক রহমান) প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করবেন এটা ইতিবাচক ঘটনা। আমরা আশা করি, রাজনৈতিকভাবে নানা দিক থেকে আরও বেশি সমন্বয়ের প্রয়োজন আছে। সেটার অগ্রগতি হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের যুক্তরাজ্য সফরে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন লন্ডনে অবস্থানরত ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারা কুক। গতকাল বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে তিনি লিখেছেন, ‘এই সপ্তাহে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে যুক্তরাজ্যে স্বাগত জানাতে পেরে দারুণ ভালো লাগছে। হাইকমিশনার কুক বলেন, ‘অধ্যাপক ইউনূসের কর্মসূচির পরিধি দুই দেশের গণতন্ত্র, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, জলবায়ু পদক্ষেপ, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং রোহিঙ্গাদের প্রতি সমর্থনের ক্ষেত্রে যৌথ অঙ্গীকারের প্রতিফলন।
সফরের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব রুহুল আলম সিদ্দিক বলেন, ‘এটি অত্যন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ সফর। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক গভীর ও বহুমাত্রিক। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, এই সফর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও জোরদার করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।