ইবরাহীম খলিল : আজ ২০ জুলাই রোববার। ২০২৪ সালে এদিন শনিবার ছিল। ছাত্রদের সাথে জনতার একত্রিত আন্দোলন সামাল দিতে এদিন স্বৈরাচার সরকার নাটকীয়তার আশ্রয় নেয়। র্কাফিউ দিয়ে ইন্টারনেট বন্ধ করে গণহত্যার পাশাপাশি নানা বাহানার আলাপ করতে থাকে। সরকারের পক্ষ থেকে মন্ত্রীরা বলতে থাকে আন্দোলনে তৃতীয় পক্ষ ঢুকে গেছে। আগের দিন শুক্রবার জারি করা র্কাফিউ এদিন দুপুর ১২টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত শিথিল করা হয়। এদিন রাজধানীর বিভিন্নস্থানসহ সারাদেশে সংঘর্ষ অব্যাহত ছিল।
২০ জুলাই তৃতীয় দিনের মতো সারাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ সেবা বন্ধ রাখে সরকার। র্কাফিউ চলার সময় সারাদেশে যানবাহন চলাচলও বন্ধ থাকে। উপায়ান্তর না দেখে এদিন সরকার ২১ ও ২২ জুলাই দুই দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। সরকার নির্বাহী আদেশে এ ছুটি ঘোষণা করেছে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এক প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়। পরে অবশ্য সাধারণ ছুটি আরও একদিন বাড়িয়ে ২৩ জুলাইও ছুটির আওতায় আনা হয়।
এদিন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে অন্তত ৩৭ জন নিহত হন। এর মধ্যে ঢাকায় দুই পুলিশসহ ২৫ জন নিহত হন। এ ছাড়া ময়মনসিংহ ও সাভারে ৪ জন করে, গাজীপুরে ২ জন এবং নরসিংদীতে ২ জন নিহত হন বিভিন্ন মিডিয়া প্রচার করে।
এদিন যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, বাড্ডা ও মিরপুরে ছিল সংঘর্ষের মূল পয়েন্ট। মোহাম্মদপুরেও সংঘর্ষ হয়। দেশের মিডিয়াগুলোতে সঠিক খবর প্রকাশিত না হওয়া আন্তর্জাতিক মিডিয়ার দিকে চোখ ফেরাতে হয় বিশ^াসযোগ্য খবরের জন্য। আর্ন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলো জানায়, র্কাফিউ জারি করার পর শনিবার সকালে ঢাকার রাস্তায় মানুষের উপস্থিতি ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম। কিছু এলাকায় হাতে গোনা কয়েকটি দোকান খোলা দেখা যায়। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সকাল বেলার চিত্র ছিল অনেকটা অন্যান্য দিনের মতই। শাক-সবজি, মাছসহ নিত্যপণ্যের ব্যবসায়ীদের সকাল থেকেই বাজারে বসতে দেখা গেছে। বিভিন্ন এলাকায় রাস্তাঘাটে মানুষের উপস্থিতি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম দেখা গেছে। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। গণমাধ্যমের গাড়ি, অ্যাম্বুলেন্স বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাড়ি বাদে অন্য গাড়ি ছিল না বললেই চলে। সিএনজি চালিত অটোরিকশাও ছিল না রাস্তায়। তবে সব এলাকাতেই রিকশা চলাচল করতে দেখা গেছে। সকাল থেকে ঢাকার ধানম-ি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, পল্টন, রাজারবাগ, মগবাজার, হাতিরঝিল, বাড্ডা, এলাকার কোথাও কোনো ধরনের মিছিল বা সমাবেশ দেখা যায়নি। তবে রামপুরার পাশে খিলগাও রেলগেটের কাছে রাস্তা আটকে বিক্ষোভকারীদের এক জায়গায় জড়ো হয়ে থাকতে দেখেন বিবিসি সংবাদদাতা। সেসময় বিক্ষোভকারীদের অনেকের হাতে লাঠি, রড দেখা যায়। ধানম-ি, মোহাম্মদপুর সহ বিভিন্ন জায়গায় রাস্তায় আগের দিনের সহিংসতার চিহ্ন দেখা গেছে। সব জায়গায় রাস্তায় ছড়িয়ে ছিল ইটের টুকরা, রাস্তার ডিভাইডারের ভাঙা রড। মোহাম্মদপুর, রামপুরা, মহাখালির বিভিন্ন জায়গায় রাস্তায় দেখা গেছে পুড়ে যাওয়া গাড়ির ধ্বংসাবশেষ। শাহবাগ, মহাখালি আর সংসদ ভবনের চারপাশে সেনাবাহিনীর অবস্থান দেখা গেছে। সেসব জায়গা দিয়ে যাওয়া-আসা করা রিকশা, গাড়ির যাত্রীদের পরিচয়পত্র যাচাই করতে দেখা যায় সেনা সদস্যদের। ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বর এলাকায়, মানিক মিয়া এভিনিউ, শাহীন কলেজের সামনের সড়কে সেনা সদস্যদের চেকপোস্ট দেখতে পেয়েছেন বিবিসির সংবাদদাতা। সব যানবাহন থামিয়ে তারা যাচাই করছিলেন।
সকাল থেকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া, রায়েরবাগ ও কাজলা এলাকায় রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা। একপর্যায়ে রায়েরবাগে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলীবর্ষণ করে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলা এ সংঘর্ষে পুলিশ সদস্যসহ বেশকয়েকজন নিহত হন। আহত হন শতাধিক।
এদিন সকাল থেকে রামপুরা, বনশ্রী ও বাড্ডা এলাকায় বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। সেখানেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সকাল থেকে ভাটারা এলাকায় ইউআইইউ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ও আইইউবিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে তাদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সকালে ধানমন্ডি, নিউমার্কেট ও আজিমপুর এলাকায়ও বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা।
মোহাম্মদপুরের বছিলায়ও কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। বেলা ১১টার দিকে উত্তরার আজমপুর রেলগেট এলাকায় আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। তারা রেললাইন অবরোধ করে বিক্ষোভ করতে থাকেন। দুপুর ১২টার দিকে আন্দোলনকারীরা আজমপুরে সেক্টর-৬-এ অবস্থিত হাইওয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করেন। খবর পেয়ে পুলিশ তাদের টিয়ারগ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলী ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে সন্ধ্যা পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের থেমে থেমে সংঘর্ষ হয়।
এদিন সিদ্ধিরগঞ্জে হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি ভবনে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় আন্দোলকারীরা। এতে ওই ভবনে থাকা হাইওয়ে পুলিশ সদস্যসহ শতাধিক মানুষ আটকা পড়ে যায়। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ গিয়ে হেলিকপ্টারের সহায়তায় তাদের উদ্ধার করে। হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি ছাড়াও ওই ভবনে থাকা হাসপাতাল, ব্যাংক, চাইনিজ রেস্টুরেন্টসহ অর্ধশতাধিক দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় শনিবার দুপুরে পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এছাড়াও সভার উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়েও হামলা-ভাঙচুর করা হয়। সাভার রেডিও কলোনিতে দফায় দফায় সংঘর্ষে আহত হন ২৫ জন। পরে সেনা সদস্যরা এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয় নরসিংদীর কারাগারে হামলার পর পালিয়েছে আট শতাধিক আসামী নরসিংদীর কারাগারে হামলার পর সেখানকার আট শতাধিক কারাবন্দী পালিয়ে গেছে বলে কারা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। বিকাল পৌঁনে পাঁচটার দিকে হাজার হাজার মানুষ নরসিংদী কারাগারে হামলা চালায়। এরপর তারা কারাগারের দরজা ও লকআপ ভাঙতে শুরু করলে ৮২৬ জন কারাবন্দী পালিয়ে যায়। এদের মধ্যে দুজন জেএমবি নারী কয়েদি এবং সাত জন আনসার আল ইসলামের কয়েদি ছিল। এছাড়া চার শতাধিক বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের বন্দী নেতাকর্মী ছিলেন বলে জানা গিয়েছে।
সারা দেশে সেনাবাহিনী মোতায়েনের কথা জানানো হলেও বেলা একটা পর্যন্ত চট্টগ্রামের শহরে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি দেখা যায়নি। নগরের মোড়ে মোড়ে চেকপোস্ট বসিয়েছে পুলিশ। এছাড়াও শহরে পেট্রোলিং করছে বিজিবি। সামাজিক মাধ্যম ও অনলাইন পোর্টালগুলো বন্ধ থাকায় চট্টগ্রামের অনেকেই র্কাফিউ জারির কথা জানতে পারেননি বলে জানান স্থানীয় সাংবাদিক অনুপম শীল। ফলে সকাল থেকেই বিভিন্ন পেশার মানুষ সড়কে কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে বের হন। তবে বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের সংখ্যা কমতে থাকে। এদিকে চট্টগ্রামে বেশ কিছু কলকারখানা খোলা থাকার খবর পাওয়া গেছে। শহরের বিভিন্ন গলিতে খাবারের দোকান খোলা হয়েছে এবং এলাকার ভেতরে জনসাধারণের উপস্থিতি দেখা গেছে। তবে প্রধান সড়কগুলোতে দোকানপাট বন্ধ ছিল। চটগ্রাম শহরের ভেতরে গণপরিবহন চলতে দেখা যায়নি। আগে থেকেই বন্ধ ছিল দূরপাল্লার বাস। তবে সীমিত পরিমাণে স্বল্প দূরত্বের কিছু বাস চলতে দেখা গেছে। এছাড়াও প্যাডেল ও ব্যাটারিচালিত রিক্সা চলাচল করছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার সাইফুল ইসলাম, জনসাধারণকে কারফিউ শিথিল হবার সময় বেরিয়ে জরুরি কাজ শেষ করার এবং বাকি সময়ে ঘরে থাকার আহ্বান জানিয়েছন। এছাড়া কোটা আন্দোলনকারীরা দুপুর একটার দিকে দুই নম্বর গেট মোড়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করলেও সেখানে কাউকে জড়ো হতে দেখা যায়নি বলে জানান আরেক স্থানীয় সাংবাদিক আব্দুল করিম।
শনিবার বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত রাজশাহীতে কোনো বিক্ষোভ বা সংঘাতের ঘটনা দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম। দিবাগত রাত ১২টা থেকে র্কাফিউ জারি করার ফলে শহরে যান চলাচল এবং দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। তবে বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত রাজশাহীতে সেনাবাহিনীর সদস্যদের দেখা যায়নি। শহরজুড়ে পুলিশ, বিজিবিসহ একাধিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যকে টহল দিতে দেখা গেছে। হাসপাতাল কিংবা জরুরি পরিষেবা ব্যতিত কাউকে শহরের দিকে যেতে দেয়া হচ্ছে না। বিশেষ করে যে সড়কগুলোতে গত কয়েকদিনে বিক্ষোভকারীরা জড়ো হয়েছে, সেখানে যাতায়াতকারীদের তল্লাশি নেয়া হচ্ছে।এদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে বেলা ১১টায় কোটাবিরোধী শিক্ষার্থীদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি থাকলেও সেখানে কাউকে জড়ো হতে দেখা যায়নি।
সেদিন বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিবিসি বাংলাকে জানান, চলমান সহিংসতা থামানো এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো রক্ষা করার জন্য সরকার র্কাফিউ দিতে বাধ্য হয়েছে। তিনি বলেন, যারা কোটা বিরোধী আন্দোলন করছে তারা এই সহিংসতার সাথে সম্পৃক্ত নয়। তারা এটা পরিষ্কারভাবে এই কথা জানিয়ে দিয়েছে। আমাদের কাছে আরো পরিষ্কার হয়েছে যে এটা কিছু রাজনৈতিক দলের সন্ত্রাসীরা তাদের নেতাদের উস্কানিতে এটা করছে। সহিংসতা বন্ধ করার জন্য এবং জনগণের জানমাল রক্ষা করার জন্য যেটা করার দরকার আমরা সেটা করেছি। আমরা আশা করছি র্কাফিউ দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করতে পারবো। আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোর মতে র্কাফিউ এমন এক সময়ে জারি করা হলো যখন পুলিশ, র্যাব এবং বিজিবির সাথে বিক্ষোভকারীদের রক্তাক্ত সংঘাত হয়েছে টানা চারদিন ধরে। প্রশ্ন উঠেছে, নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়েছে কী না। আইনমন্ত্রী মনে করছেন, রাস্ট্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যর্থ হয়নি। সেজন্যই বলা হয়েছে ইন এইড অব সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায়)। তারা মোটেও ব্যর্থ হয় নাই। আমাদের কথা হচ্ছে, যেভাবে কেপিআই গুলো ধ্বংস করেছে এবং জনগণের ট্যাক্স-এর টাকায় যেসব স্থাপনা বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য করা হয়েছে সেগুলো ধ্বংস করার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেগুলোকে রক্ষা করার জন্য আমরা এটা (র্কাফিউ) দিতে বাধ্য হয়েছি।
রংপুরের প্রধান সড়কগুলোতে টহল দেয় সেনাবাহিনী। সেখানকার প্রধান সড়কে যান চলাচল দেখা যায়নি বলে জানান স্থানীয় সাংবাদিক শাহরিয়ার মিম। এছাড়াও শহরের বিভিন্ন মোড়ে সীমিত পরিসরে স্থানীয় লোকজনকে দেখা গেছে বলে জানান তিনি। এছাড়া আগুন দেয়া হয় রংপুর শহরের তাজহাট থানা, ডিবি পুলিশের কার্যালয় এবং একটি উপ-পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ে। এছাড়াও পুলিশ কার্যালয়ে রাখা কিছু গাড়ি লুট করা হয় এবং কয়েকটি গাড়ি সড়কে এনে আগুন দেয়া হয়। এসময় ঢাকা ব্যাংকের বুথে ভাংচুর চালায় বিক্ষোভকারীরা।
২০ জুলাই শনিবার সকালে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের মৌচাক এলাকায় তিনটি গাড়িতে আগুন দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। বেলা ১১টা পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ শহরে সেনাবাহিনী দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সাংবাদিক আহসান সাদিক।
এই আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিবিসিকে এক ক্ষুদে বার্তায় জানিয়েছেন যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে শুক্রবার মধ্যরাতে আটক হয়েছে। বাকি সমন্বয়কদের মাঝে কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছে কিনা, সে বিষয়ে তিনি এখনও নিশ্চিত না বলে জানিয়েছেন। নাহিদ ইসলামকে যখন আটকের তথ্য জানা যাচ্ছে, অনেকটা কাছাকাছি সময়ে ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় আন্দোলনের দুইজন সমন্বয়কের সাথে সরকারের একটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে নাহিদ ইসলাম উপস্থিত ছিলেন না। তার আগে মি. ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, ছাত্র হত্যার বিচার না হলে আলোচনার পথ খোলা নেই এবং তাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
২০ জুলাই মধ্যরাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে বিষয়টি তারা অস্বীকার করে আইন -শৃঙ্খলাবাহিনী। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার কয়েকটি ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখেছে, মধ্যরাতে রাজধানীর সবুজবাগে, যেখান থেকে নাহিদকে তুলে নেওয়া হয়েছিল সেসময় ওই বাসার কাছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-৩ এর একটি গাড়ি, একটি এসইউভি, একটি মাইক্রোবাস ও দুটি মোটরসাইকেলের উপস্থিতি ছিল। তুলে নেওয়ার ২৪ ঘণ্টা পর পূর্বাচলে জ্ঞান ফেরে নাহিদের। সারা শরীরে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। ডিবি হেফাজতে নেওয়ার আগে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নাহিদ ডেইলি স্টারকে বলেন, ২০ জুলাই ২৫-৩০ জন সাদা পোশাকের ব্যক্তি রাত ২টার পরে তাকে টেনেহিঁচড়ে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়েছিল। তারা গেট ভেঙে বাসায় ঢোকে। গাড়িতে তোলার পর নাহিদের চোখ বেঁধে ফেলা হয়েছিল। গাড়িটা প্রায় ৩০-৪০ মিনিট চলে। পরে তাকে একটি রুমে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ ও মারধর করা হয়। মারধরের এক পর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
জ্ঞান ফেরার পর একটি ওভারব্রিজের নিচে নিজেকে আবিষ্কার করেন নাহিদ। সাইনবোর্ড দেখে বুঝতে পারেন সেটি পূর্বাচল এলাকা। সেখান থেকে একটি সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে বাসায় ফেরেন তিনি। পরে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নাহিদ জানান, রাত ২টার পরে তাকে গাড়িতে তুলে চোখ বেঁধে ফেলার আগে তিনি একটি র্যাবের গাড়িও দেখতে পেয়েছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরাও একই বর্ণনা দিয়েছেন। নাহিদ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারের সংগ্রহ করা ভিডিও ফুটেজের মিল পাওয়া গেছে।
সবুজবাগে যে বাসা থেকে নাহিদকে তুলে নেওয়া হয়েছিল ওই ভবনের কাছাকাছি বিভিন্ন সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ডেইলি স্টার। সেসব ভিডিও নিশ্চিত করে যে, ২০ জুলাই রাত ১টা ৫১ মিনিট থেকে ২টা ১২ মিনিটের মধ্যে অন্তত একটি র্যাব-৩ এর ভ্যান ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল। রাত ১টা ৫১ মিনিটের দিকে সবুজবাগের নন্দীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে দুটি মোটরসাইকেল, একটি এসইউভি, একটি মাইক্রোবাস ও একটি র্যাবের ভ্যান থামে। নাহিদের বন্ধুর বাসা, যেখানে তিনি রাতে অবস্থান করছিলেন সেখান থেকে গাড়িগুলোর দুরত্ব মাত্র দেড়শ মিটার। গাড়িগুলো নন্দীপাড়া মোড়ের দিক থেকে এসে প্রায় ২০ মিনিট সেখানে অবস্থান করে। পরে একই দিকে ফিরে যায়। এই সময়েই নাহিদকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শী ও নাহিদ নিজে জানিয়েছেন। ২০ জুলাই রাত থেকেই দেশজুড়ে কারফিউ জারি করা হয়। ওই এলাকার রাস্তায় তখন শুধু অ্যাম্বুলেন্স ও কয়েকটি ট্রাকের চলাচল ছিল। এর মধ্যেই রাতে র্যাব-৩ এর ভ্যানসহ অন্য গাড়িগুলো সেখানে থামে।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে যে দুটি মোটরসাইকেলে পিলিয়ন ছিল এবং গাড়ি দুটির বেশিরভাগ সিটেই কেউ না কেউ বসে ছিল। প্রথমে মাইক্রোবাসটি বাসার কাছাকাছি যায়। এসইউভি ও র্যাব-৩ এর ভ্যানটি সেখানে ১০ মিনিট অপেক্ষা করে। সেসময় এসইউভির পেছনের দিকে দাঁড়িয়ে চার-পাঁচজনকে ফোনে কথা বলতে দেখা গেছে। এসইউভির পেছনের দরজা বা বোনেট দুবার খোলা হয়, রাত ১টা ৫৪ মিনিট এবং রাত ২টায়। প্রথমবার পেছনের দরজা খুলে একজন ব্যক্তি একটি হেলমেট রাখেন। পরেরবার আরেকজন গাড়ির পেছনের দরজা খুলে একটি বড় কাটারসহ কিছু সরঞ্জাম নেন। রাত ২টা ২ মিনিটে এসইউভি গাড়িটি নাহিদ যে ভবনে ছিল সেদিকে চলে যায়। র্যাবের ভ্যানটিও সেদিকে ফলো করে। একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী দ্য ডেইলি স্টারকে জানিয়েছেন, নাহিদকে আটক করতে সাদা পোশাকের কয়েকজন ভবনের গেটের তালা ভেঙে ফেলে। পাশের একটি ভবনের একজন নিরাপত্তারক্ষী জানান, মোট ২৫-৩০ জন সাদা পোশাকের ব্যক্তি সেখানে ছিল। তাদের মধ্যে চার-পাঁচজন সীমানা প্রাচীরের ওপর দিয়ে লাফিয়ে মূল ফটকের ভেতরে ঢুকে।
'প্রথমে তারা লোহার রড দিয়ে মূল গেটের তালা ভাঙে। তারপর একটি গাড়ি থেকে কাটার নিয়ে এসে ভেতরের কলাপসিবল গেটের আরও দুটি তালা কেটে বাড়িতে প্রবেশ করে,' বলেন তিনি। সিসিটিভি ফুটেজে তিনটি গাড়ি এবং দুটি মোটরসাইকেলকে রাত ২টা ১২ মিনিটে ওই এলাকা ছেড়ে যেতে দেখা গেছে। পুরো সময় জুড়ে চালকসহ আটজন ইউনিফর্ম পরা র্যাব কর্মকর্তার কাউকে গাড়ি থেকে নামতে দেখা যায়নি। শুধু সাদা পোশাকের লোকজন, যারা র্যাবের পাশাপাশি অন্যান্য গাড়িতে এসেছিল তারাই গাড়ি থেকে নামেন। ডেইলি স্টার একটি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নম্বর 'ঢাকা মেট্রো ঘ ১৪৪৩৮৫' হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ থেকে ওই নিবন্ধন নম্বর যাচাই করা যায়নি।
কয়েকবার চেষ্টা করেও র্যাব-৩ এর কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী যোবায়ের আলম শোভনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি ডেইলি স্টার। একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনিম ফেরদৌস জানান, ২০ জুলাই নাহিদকে তুলে নেওয়ার সঙ্গে র্যাবের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। তিনি বলেন, 'তখন ছিল র্কাফিউয়ের প্রথম রাত। সারা দেশে আমাদের ৩০০টিরও বেশি গাড়ি টহলরত ছিল।... আপনারা হয়তো ওই এলাকায় টহলরত কোনো গড়ি বা অন্য কোনো কাজে যাওয়া গাড়ি দেখতে পারেন। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট শাহদীন মালিক জানান, আইন ও সংবিধান অনুযায়ী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যদি কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে তবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে আদালতে হাজির করতে হবে। 'নাহিদকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করা হয়নি। এটি বেআইনি ও আইন বহির্ভূত। এ ঘটনায় অপহরণ মামলা করা যেতে পারে। কিন্তু যেহেতু দেশে কোনো জবাবদিহিতা নেই, তাই কোনো থানা বা ম্যাজিস্ট্রেট আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে হয়তো এমন মামলা গ্রহণ করবে না,' বলেন তিনি।
একইদিন গণঅধিকার পরিষেদের সভাপতি নুরুল হক নুরকেও আটক করা হয় বলে তার পরিবারের সদস্যরা জানান। শুক্রবার গভীর রাতে তাকে রাজধানীর হাতিরঝিলের বাসা থেকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন তার স্ত্রী মারিয়া লুনা। তিনি জানান, রাত সোয়া তিনটার সময় র্যাব, পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা বাসার দরজা ভেঙে ধরে নিয়ে যায়। এ সময় বাসার সিসিটিভি ক্যামেরাও খুলে নিয়ে যাওয়া হয় । আটকের সময় বাসা থেকে অন্তত ৭টি মোবাইল ফোন নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলেও পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। তবে দল ও পরিবারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করা হলেও তাকে কোথায় রাখা হয়েছে সেটি নিশ্চিত করতে পারেনি। অবিলম্বে মি. নুরের মুক্তির দাবি করেছে গণঅধিকার পরিষদ। সংগঠনের দপ্তর সম্পাদক শাকিল উজ্জামান বিবিসি বাংলাকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে আটক করলেও কোথায় নিয়ে গেছে তা এখনো জানাচ্ছে না, এটা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।
কয়েকদিনের হতাহতের ঘটনায় সরকার গভীরভাবে মর্মাহত তথ্য প্রতিমন্ত্রী এ আরাফাত বলেন, স্বার্থান্বেষী মহল ছাত্রদের জীবনের বিনিময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে, এটা পরিষ্কার। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরাও বলেছেন, এ ধরনের সন্ত্রাস, অগ্নিসংযোগ, নৈরাজ্যের সঙ্গে তাদের কোনো সংযোগ নেই। তারাও বলছেন আন্দোলনের নামে সন্ত্রাসী কর্মকা- ঘটানো হচ্ছে এবং তারাও এর নিন্দা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন এই সন্ত্রাস-সহিংসতার সঙ্গে শিক্ষার্থীরা জড়িত নন। এখানে তৃতীয় পক্ষ ঢুকে পড়েছে। আন্দোলনের নামে এখন পরিষ্কার সন্ত্রাসী কর্মকা- চলছে। সরকার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সব দাবি মেনে নেওয়ার পরও কারা কী কারণে এই সন্ত্রাসী কর্মকা- করছে, সে প্রশ্নও রাখেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী।
এ তৃতীয় পক্ষ কারা-এমন প্রশ্নের জবাবে তথ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধংদেহী, ধ্বংসাত্মক আক্রমণকারীরা হচ্ছে তৃতীয় পক্ষ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বিএনপি-জামায়াত, এটা পরিষ্কার। সরকার কেন প্রতিরোধ করতে পারল না, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অন্য দেশে হলে কী করত ? গুলি চালাত। তখন একজন সন্ত্রাসী মরলেও আপনারা বলতেন এত মানুষ মরল! আমরা ধৈর্য ধরেছি, সহনশীলতা দেখিয়েছি। গুলি চালানোর কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। গুলি চালানো হয়নি। যে কারণে সন্ত্রাসীরা সুযোগ পেয়ে আন্দোলনে ঢুকে ধ্বংসাত্মক কর্মকা- করেছে। কিন্তু আমরা এখন বলছি, আমাদের কঠোর হতে হবে জনগণের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে।