রাজধানীর বুড়িগঙ্গা নদীর এপার ও ওপারে ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনিতে দুই যুবক নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় উপস্থিত সাধারণ জনতার গণপিটুনিতে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন আরও দুই যুবক। গতকাল শুক্রবার ভোরে এ ঘটনা ঘটেছে। নিহত একজনের নাম আসিফ (২৫)। অন্যজনের নাম পরিচয় জানা যায়নি। এদিকে বৃহস্পতিবার রাতে গুলশানে পুলিশ প্লাজার সামনে টেলি সুমন (৩৩) নামে এক যুবককে গুলী করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। লালবাগে একটি বাসা থেকে তাহিয়া তাসনিম (১৯) নামে এক গৃহবধূর রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।

চকবাজার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আবুল খায়ের জানান, ভোর ৫টার পর বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে একটা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এ সময় ওপারের লোকজন ডাক-চিৎকার দিলে ছিনতাইকারীরা পালাতে থাকে। দুইজন ছিনতাইকারী পালিয়ে নৌকা দিয়ে আমাদের এই পাশে চম্পাতলী ঘাটের দিকে আসছিল। ওপারে চিৎকার-চেঁচামেচিতে এপারের লোকজন দুইটা নৌকা নিয়ে নদীতে যায়। এপারের লোকজন যখন তাদের ধরতে যায় তখন তারা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তখন এপারের লোকজন তাদের ধরে নিয়ে আসে। পরে জনগণ উত্তেজিত হয়ে তাদের গণপিটুনি দেয়। তিনি বলেন, খবর পেয়ে তাদের উদ্ধার করে প্রথমে পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক একজনকে মৃত ঘোষণা করেন। আর একজন গুরুতর অবস্থায় ভর্তি আছেন।

পরিদর্শক (তদন্ত) মো. আবুল খায়ের আরও বলেন, পাশাপাশি একই ঘটনায় কেরানীগঞ্জের জনগণ বাকি দুইজনকে ধরে গণপিটুনি দিয়েছে। সেখানেও একজন মারা গেছে। কেরানীগঞ্জ থেকে গণপিটুনিতে আহত হয়ে আসা আরেকজনও গুরুতর অবস্থায় ঢামেকে ভর্তি আছে। মোট এপারে একজন এবং ওপারে একজন মিলিয়ে দুজন নিহত হয়েছে। কারও নাম-পরিচয় জানা গেছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, সিআইডির সহযোগিতায় আমরা জানতে পেরেছি এপারে যিনি মারা গেছেন তার নাম আসিফ। তিনি কামরাঙ্গীরচর এলাকার বাসিন্দা। আহত ও নিহতদের সবার বয়স ২৫ বছরের নিচে।

গুলশানে গুলীতে নিহত যুবকের বিরুদ্ধে ছিল ৬ মামলা: গুলশানে সুমন নামে যে যুবককে গুলী করে হত্যা করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা ছিল। তিনি একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্য ছিলেন। বৃহস্পতিবার রাতে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থল গুলশানের পুলিশ প্লাজার সামনে গিয়ে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) এসএম নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, নিহত ব্যক্তির বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে। তার নাম টেলি সুমন। তার বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা ছিল। সে-ও একটি গ্রুপের সদস্য। আন্তঃগ্রুপ কোন্দল থেকে হত্যা হতে পারে বলে আমরা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি। হত্যাকারীদের শনাক্তে সিসি ক্যামেরার ফুটেজসহ বিভিন্ন প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া হবে বলেও জানান অতিরিক্ত কমিশনার নজরুল ইসলাম।

এর আগে, বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে গুলশানের পুলিশ প্লাজার পাশে ফজলে রাব্বী পার্কের কোনায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। পরিবারের অভিযোগ, ব্যবসায়িক বিরোধের জেরে সুমনকে হত্যা করা হয়েছে। তারা জানায়, মহাখালী এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন সুমন। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের হুমকির মুখে ব্যবসা ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। সুমনের স্ত্রীর বড় ভাই মো. বাদশা মিয়া অভিযোগ করে বলেন, মহাখালী টিবি গেট এলাকায় ‘প্রিয়জন’ নামে একটি ইন্টারনেট ব্যবসা রয়েছে। সুমনের ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ছিল।

নিহতের স্ত্রী মৌসুমী বলেন, সুমন ইন্টারনেটের ব্যবসা করতো। মহাখালী এলাকায় সংযোগ দিতো। বিরোধী পক্ষ নানা হয়রানি করে তাকে ব্যবসা ছাড়তে বাধ্য করেছে। সব লাইন কেটে দেয় তারা। এদিকে, হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে গুলশান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মারুফ আহমেদ জানান, সুমন পুলিশ প্লাজার উত্তর পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। এসময় কয়েকজনের সঙ্গে তার ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে দুর্বৃত্তরা তাকে লক্ষ্য করে গুলী করে পালিয়ে যায়। ঘটনার পর পথচারীরা তাকে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন।

গৃহবধূর রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার: রাজধানীর একটি বাসা থেকে তাহিয়া তাসনিম নামে এক গৃহবধূর রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে লালবাগের বিসি দাস স্ট্রিটের একটি ভবনের নবম তলায় এ ঘটনা ঘটে। পরে রাত সোয়া ১২টার দিকে ওই গৃহবধূকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। নিহত তাহিয়া তাসনিম বিসি দাস স্ট্রিটের ভবনটির বাসিন্দা মো. তাজুল ইসলামের মেয়ে। নিহতের বাবা তাজুল ইসলাম বলেন, এক বছর আগে তাহিয়া ও সাগরের বিয়ে হয়। পরে তাহিয়া জানতে পারে তার স্বামী আগেও বিয়ে করেছিল এবং পরবর্তীতে ওই স্ত্রীকে তালাক দিয়ে তাহিয়াকে বিয়ে করেছে। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দাম্পত্য কলহ হলে একপর্যায়ে তাহিয়া শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আমার (বাবার) বাড়িতে চলে আসে। নিহতের বাবা আরও বলেন, গত মঙ্গলবার আমার মেয়ের স্বামীর পরিবারের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলাম। যদি সমাধান না হয়, তাহলে যেন ডিভোর্স দিয়ে দেয়। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। আমার মেয়েকে হত্যা করা হলো। তাজুল ইসলাম বলেন, ঘটনার দিন তাহিয়া বাসায় একা ছিল, তার মা কর্মস্থলে ছিল। আমি নামাযে যাওয়ার আগে মেয়েকে বলে গিয়েছিলাম, কেউ আসলে দরজা যেন না খোলে। কিন্তু তার স্বামী দারোয়ানকে ডেকে দরজা খুলে ভেতরে ঢোকে। পরে রাত সাড়ে দশটার দিকে বাসায় ফিরে দেখি, খাটের পাশে মেয়ের রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে। মুখে ও শরীরে একাধিক আঘাতের চিহ্ন ছিল। তিনি বলেন, আমি বুঝতে পারি, সাগর তাকে মেরে পালিয়েছে। পরে রাত সোয়া ১২টার দিকে ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা জানান, আমার মেয়ে আর বেঁচে নেই। এ বিষয়ে লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ক্যাশৈনু গণমাধ্যমকে বলেন, ঘটনার দিন সন্ধ্যায় তাহিয়ার স্বামী বাসায় আসেন। ভেতর থেকে দরজা না খুললে, তিনি দারোয়ানকে নিয়ে দরজার সামনে যান। পরে তাহিয়া দরজা খুললে দারোয়ান স্বাভাবিকভাবে নিচে চলে যান। তিনি আরও বলেন, প্রায় ১৫ মিনিট পর তার স্বামী বাসা থেকে বেরিয়ে যান। পরবর্তীতে রাত সাড়ে ১০টার দিকে নিহতের বাবা বাসায় এসে দেখেন, রুমের দরজা ভেতর থেকে আটকানো। দরজা খুলে তিনি দেখেন, মেয়েটি মেঝেতে পড়ে আছে, আর ফ্যানের সঙ্গে একটি ছেঁড়া ওড়না ঝুলছে।