সরকারি সেবায় ৩১.৬৭ শতাংশ নাগরিক ঘুষ বা দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। পুরুষদের ক্ষেত্রে এই হার ৩৮.৬২ শতাংশ এবং নারীদের ক্ষেত্রে ২২.৭১ শতাংশ। দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে বিআরটিএ (৬৩.২৯%), আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী (৬১.৯৪%), পাসপোর্ট অফিস (৫৭.৪৫%) এবং ভূমি অফিস (৫৪.৯২%)।

গত বৃহস্পতিবার বিকেলে এই সার্ভে প্রকাশ করে বিবিএস। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর ‘সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে (সিপিএস) ২০২৫’-এর প্রাথমিক প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে।

জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি)-এর ১৬ নম্বর অভীষ্টের ছয়টি সূচক মূল্যায়নে এই জরিপ পরিচালিত হয়। দেশের ৬৪টি জেলার ১,৯২০টি প্রাইমারি স্যাম্পলিং ইউনিট (পিএসইউ) থেকে ৪৫,৮৮৮টি খানায় সাক্ষাৎকার নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী ৮৪,৮০৭ জন নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে সংগৃহীত এই তথ্য দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তাবোধ, সুশাসন, সরকারি সেবার মান, দুর্নীতি, ন্যায়বিচার ও বৈষম্য বিষয়ে একটি বিস্তৃত চিত্র তুলে ধরেছে।

জরিপ অনুযায়ী, ৮৪.৮১% নাগরিক সন্ধ্যার পর নিজ এলাকায় একা চলাফেরায় নিরাপদ বোধ করেন। তবে এই নিরাপত্তাবোধে স্পষ্ট লিঙ্গভিত্তিক পার্থক্য দেখা যায়: পুরুষের ক্ষেত্রে এটি ৮৯.৫৩% হলেও নারীদের ক্ষেত্রে তা ৮০.৬৭%। শহর ও গ্রামভেদেও কিছু পার্থক্য রয়েছে- শহরে ৮৩.৭৫% ও গ্রামে ৮৫.৩০% নাগরিক নিরাপদ বোধ করেন। অপরদিকে, সন্ধ্যার পর নিজ বাড়িতে নিরাপত্তাবোধের হার ৯২.৫৪%, যা নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে যথাক্রমে ৯১.৮২% ও ৯৩.৩৫%।

মাত্র ২৭.২৪% নাগরিক মনে করেন তারা সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে মতামত প্রকাশ করতে পারেন। এই হার পুরুষদের মধ্যে ৩১.৮৬%, অথচ নারীদের মধ্যে তা ২৩.০২% একটি স্পষ্ট লিঙ্গবৈষম্যের চিত্র। পাশাপাশি ২১.৯৯% নাগরিক বিশ্বাস করেন যে তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় কোনোভাবে প্রভাব ফেলতে সক্ষম।

গত এক বছরে ৪৭.১২% নাগরিক অন্তত একবার সরকারি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেছেন। তাদের মধ্যে ৮২.৭২% স্বাস্থ্যসেবাকে সহজপ্রাপ্য এবং ৮৯.৩৪% সেবার ব্যয়কে গ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেন। তবে সেবার মান, স্বাস্থ্যকর্মীদের সময় প্রদান ও আচরণে সন্তুষ্টির হার যথাক্রমে ৬৫.০৭%, ৬৩.১৩% ও ৬৩.১৯%Í যা উন্নয়নের সুযোগ নির্দেশ করে।

৪০.৯৩% নাগরিক জানান, তাদের অন্তত একটি শিশু সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে। প্রাথমিক স্তরে ৯৬.৪৬% নাগরিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সহজে প্রবেশের কথা বলেন এবং ৯২.৬৬% শিক্ষাব্যয় সামর্থ্যের মধ্যে বলে উল্লেখ করেন। মাধ্যমিকে এই হার কিছুটা কম হলেও এখনও যথেষ্ট ইতিবাচক (৮২.২০% ও ৮০.৮৬%)। মানসম্পন্ন শিক্ষা বিষয়ে সন্তুষ্টির হার প্রাথমিক স্তরে ৬৭.৯৩% এবং মাধ্যমিকে ৭১.৮৬%।

পরিচয়পত্র ও নাগরিক নিবন্ধনের মতো সেবায় ৭৮.১২% নাগরিক প্রাপ্তিযোগ্যতায় সন্তুষ্ট এবং ৮৬.২৮% ব্যয়কে সামর্থ্যের মধ্যে মনে করেন। তবে কার্যকর সেবা প্রক্রিয়া, সময়মতো সেবা ও সম-আচরণে সন্তুষ্টির হার যথাক্রমে ৬২.৬০%, ৫১.২৮% ও ৫৬.২৬%Í যা মানোন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।

গত দুই বছরে ১৬.১৬% নাগরিক কোনো না কোনো বিরোধের সম্মুখীন হয়েছেন। এদের মধ্যে ৮৩.৬০% নাগরিক বিচারপ্রক্রিয়ার আওতায় আসতে পেরেছেন। তাদের মধ্যে ৪১.৩৪% আনুষ্ঠানিক (আদালত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) এবং ৬৮.৯৬% অনানুষ্ঠানিক (কমিউনিটি নেতা, আইনজীবী) পন্থায় বিরোধ নিষ্পত্তি করেছেন।

গত এক বছরে ১৯.৩১% নাগরিক কোনো না কোনো বৈষম্য বা হয়রানির শিকার হয়েছেন। শহরাঞ্চলে (২২.০১%) এই হার গ্রামাঞ্চলের (১৮.০৭%) চেয়ে বেশি। আর্থ-সামাজিক (৬.৮২%) এবং লিঙ্গভিত্তিক (৪.৪৭%) বৈষম্য সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা গেছে। বৈষম্যের স্থান হিসেবে শীর্ষে রয়েছে পরিবার (৪৮.৪৪%), গণপরিবহন বা উন্মুক্ত স্থান (৩১.৩০%) এবং কর্মস্থল (২৫.৯৭%)। কিন্তু মাত্র ৫.৩৫% ভুক্তভোগী তাদের অভিজ্ঞতা রিপোর্ট করেছেন।

বিবিএস জানিয়েছে, দেশের ৬৪ জেলার ১,৯২০টি প্রাইমারি স্যাম্পলিং ইউনিট (চঝট) থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এতে ৪৫,৮৮৮টি খানার মোট ৮৪,৮০৭ জন ১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী নারী-পুরুষ অংশগ্রহণ করেন। জরিপের সময়কাল ছিল ২০২৩ সালের ১ অক্টোবর থেকে ২০২৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। আন্তর্জাতিক মান ও জাতিসংঘের নির্দেশনা অনুসরণে তৈরি প্রশ্নপত্রের ভিত্তিতে তথ্য সংগ্রহ করা হয় Computer Assisted Personal Interviewing (CAPI) পদ্ধতিতে।

মত প্রকাশের স্বাধীনতায় লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য লক্ষ্যণীয়। জরিপ অনুযায়ী, পুরুষদের মধ্যে ৩১.৮৬ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে মাত্র ২৩.০২ শতাংশ মনে করেন তারা মত প্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করেন। তবে শহর ও গ্রামের মধ্যে বড় কোনো পার্থক্য নেই; শহরে এই হার ২৭.৮৭% এবং গ্রামে ২৬.৯৪%।

রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বা প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে আরও কম হার লক্ষ করা যায়। জরিপে অংশগ্রহণকারী মাত্র ২১.৯৯ শতাংশ নাগরিক মনে করেন তারা দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। এখানেও পুরুষ (২৬.৫৫%) এবং নারী (১৭.৮১%) অংশগ্রহণের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ফারাক রয়েছে।

সিপিএস ২০২৫ জরিপে মূলত এসডিজি-১৬ লক্ষ্যমাত্রার আওতায় নিরাপত্তা, সুশাসন, সরকারি সেবার মান, দুর্নীতি, ন্যায়বিচারে প্রবেশাধিকার এবং বৈষম্য সংক্রান্ত ছয়টি সূচকের ভিত্তিতে নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতা মূল্যায়ন করা হয়েছে। এই লক্ষ্যে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (UNDP), জাতিসংঘ মাদক ও অপরাধবিরোধী সংস্থা (UNODC) এবং মানবাধিকার কমিশন (OHCHR) এর কারিগরি নির্দেশিকা অনুসরণ করা হয়েছে।এই জরিপের প্রাথমিক ফলাফল বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো ও নাগরিক অধিকারের চিত্র স্পষ্ট করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।