জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় ‘জুলাই জাতীয় সনদ’ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে গতকাল শুক্রবার দুপুরে সংসদ ভবন সংলগ্ন মানিক মিয়া এভিনিউ এলাকায় জুলাই যোদ্ধাদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। এতে অন্তত অর্ধশত জুলাই যোদ্ধা ও নিহত পরিবারের সদস্য আহত হয়েছেন। সংঘর্ষ চলাকালে সংসদ ভবনের একটি গেট ভাঙচুর, পুলিশের কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ এবং সড়কে অস্থায়ী স্থাপনায় অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ টিয়ার গ্যাসের সেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছে। এসময় মানিক মিয়া এভিনিউসহ আশেপাশের সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সংঘর্ষে আহত ২০ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
আহতরা অভিযোগ করে বলেন সনদের একটি দফার সংশোধনের দাবি জানাতে তারা শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান নিয়েছিলেন, কিন্তু পুলিশ তাদের ওপর বিনা প্ররোচনায় লাঠিচার্জ করে। তবে পুলিশ বলছে, জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানকে ঘিরে নিরাপত্তা বেষ্টনী উপেক্ষা করে সংসদ ভবন এলাকার দেয়াল টপকে বেলা ১১ টার দিকে তারা ভেতরে ঢুকে পড়েন। দুই ঘন্টা ধরে তাদের বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত সরিয়ে দেওয়ার জন্য বল প্রয়োগ করতে হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ১০ টার পর থেকেই ‘জুলাই যোদ্ধারা’ তিন দফা দাবিতে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। এক পর্যায়ে সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের মঞ্চের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। তাদের মূল দাবিগুলো ছিল- জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ছাত্র-জনতাকে ‘জুলাই আহত বীর’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সুরক্ষা আইনের মাধ্যমে দায়মুক্তি নিশ্চিত করা এবং জুলাই সনদে তাদের স্বীকৃতি নিশ্চিত করা। বেলা সোয়া ১টার দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিক্ষোভরত ‘জুলাই যোদ্ধাদের’ অনুষ্ঠানস্থল থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে লাঠিচার্জ ও ধাওয়া দিলে আন্দোলনকারীরাও পাল্টা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। সংঘর্ষের একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ ‘জুলাই যোদ্ধারা’ সংসদ ভবনের ১২ নম্বর গেট ভেঙে বাইরে মানিক মিয়া এভিনিউর দিকে আসেন। এসময় তারা সড়কে থাকা পুলিশের কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। এছাড়া, সড়কে ব্যবহৃত পুলিশের ব্যারিকেড ও সেচ ভবনের সামনে তৈরি করা অস্থায়ী অভ্যর্থনা কক্ষ, কন্ট্রোল রুম এবং আসবাবপত্রে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এতে ওই এলাকায় যান চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। পুলিশের ধাওয়া ও লাঠিচার্জের মুখে আন্দোলনকারীরা আসাদ গেট ও খামারবাড়ির দিকে সরে যেতে বাধ্য হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যৌথ অভিযানে মানিক মিয়া এভিনিউ এলাকা পুলিশের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে সংসদ ভবনের আশেপাশে অতিরিক্ত পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনী, এপিবিএন, সোয়াট, বিজিবি ও আনসার গার্ড ব্যাটালিয়নের সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ২০ জন হলেন-আতিকুল গাজী (২০), সাইফুল ইসলাম (২৬), লাইলী আক্তার (২৫), কামরুল হাসান (২৯), শরিফুল ইসলাম (২৯), সিনথিয়া (২১), আশরাফুল (২০), হাবিবউল্লাহ (৩০), শফিউল্লাহ (৩২), শাকিব (২৫), মো. লিটন (৩২), তানভীর (২২), দুলাল (৩০), কামাল (৩২), ওমর ফারুক (২৭), নুরুল হুদা (২৫), আখের উদ্দিন (২৮), মিজান (২৮), মোস্তাক বিপ্লব (২৭) এবং আল আমিন (৩৪)। ঢামেক পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক বলেন, আহতদের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। চিকিৎসকদের প্রাথমিক ধারণা অনুযায়ী, কারও অবস্থা গুরুতর নয়।
আহতদের মধ্যে একজন জুলাই আন্দোলনে আহত হয়ে ডান হাত হারানো আতিকুল গাজী বলেন, ‘আমাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না দেওয়ার প্রতিবাদে আমরা জুলাই শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধারা আন্দোলন করে আসছিলাম। সরকার আমাদের দাবিতে সাড়া না দিয়ে আজ (শুক্রবার) জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান করতে গেলে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদে দাঁড়াই। তখন হঠাৎ পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে।’ প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ বেশ কয়েক রাউন্ড টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। এতে এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং দোকানপাট সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
এ ঘটনার পর এক পর্যায়ে ঐকমত্য কমিশনের সহ সভাপতি আলী রীয়াজ মঞ্চে এসে জুলাই যোদ্ধাদের প্রতি দুঃখ প্রকাশ করেন এবং দাবি পূরণের আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ ও আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি আপনাদের কাছে। আপনাদের সাথে এভাবে দেখা করতে হচ্ছে এটা শুধু লজ্জার, ক্ষোভের, দুঃখের বিষয়। আমরা কমিশনের পক্ষ থেকে ক্ষমাপ্রার্থী। তিনি বলেন, জুলাই যোদ্ধাদের প্রতিনিধিরা যে দাবি এনেছেন, বৃহস্পতিবারের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ঐকমত্য কমিশন জাতীয় সনদের পঞ্চম দফার অঙ্গীকারনামার বিষয়ে দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে দাবির প্রতিফলন ঘটাতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী তৈরি করেছে। এটি জাতীয় সনদের চূড়ান্ত ভাষ্য রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করা হবে। যার প্রতিশ্রুতিতে পরবর্তী সরকার পদক্ষেপ নেবে। সেখানে সুস্পষ্টভাবে বলব- যেন এ অঙ্গীকারনামা বাস্তবায়নে সরকার যেন ব্যবস্থা করে। এ নিয়ে দল ও ঐকমত্য কমিশনের কোনো মতপার্থক্য নেই। অঙ্গীকারনামার ৫ নম্বর দফার সংশোধিত ভাষ্য পড়ে শোনান সহ সভাপতি। তিনি বলেন, যেখানে জুলাই যোদ্ধাদের অবদানের স্বীকৃতি, প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার রয়েছে- আপনাদের রাষ্ট্রীয় মযাদা, সুযোগ সুবিধা ও আইনি সুরক্ষা, নিরাপত্তার বিধান রয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন জুলাই জাতীয় সনদের অঙ্গীকারনামার পঞ্চম দফা সংশোধন করার ঘোষণা দেয়ার পর পরিস্তিতি স্বাভাবিক হয়।