ওসমান হাদীর মৃত্যুর খবরে বিক্ষুব্ধ জনতা বৃহস্পতিবার রাতে ইংরেজী দৈনিক ডেইলি স্টার, বাংলা দৈনিক প্রথম আলো এবং ধানমন্ডি ৩২ নম্বর ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের কার্যালয়ে হামলা, ভাংচুর করে অগ্নিসংযোগ করে। বিক্ষুব্ধ জনতার দাবি এই প্রতিষ্ঠানগুলো ফ্যাসিবাদের দোসর এবং বাংলাদেশের কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগকে সহযোগিতাকারী প্রতিষ্ঠান। সেইসাথে আগ্রাসী প্রতিবেশী দেশ ভারতকে সহযোগিতা করছে।

বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত পৌনে ১২টার দিকে বিক্ষুব্দ একদল লোক এই হামলা চালায়। এ ঘটনায় পত্রিকা দুটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, প্রথমে দৈনিক প্রথম আলো অফিসে ভাংচুরের পরে ডেইলি স্টারে হামলা চালায়। পরে রাতে ঘটনাস্থলে যায় সেনাবাহিনী। তারা বিক্ষোভকারীদের বুঝিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় বিজিবি (বডার গার্ড বাংলাদেশ) সদস্যদের দেখা যায়। এরপর হামলাকারীরা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর ও ছায়ানট ভবনে গিয়ে ভাঙচুর করে। রাত পৌনে ৩টার দিকে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নূরুল কবীর হামলার প্রতিবাদ জানাতে ডেইলি স্টার ভবনের সামনে যান। এ সময় তোপের মুখে পড়েন তিনি। পরে সেনাবাহিনী তাঁকে সরিয়ে নেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদীর মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর একদল লোক শাহবাগ থেকে মিছিল নিয়ে কারওয়ান বাজারের দিকে অগ্রসর হয়। মিছিলটি প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে পৌঁছে ঘেরাও ও বিক্ষোভ শুরু করে। এ সময় সেখানে উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের শান্ত করার চেষ্টা করলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। একপর্যায়ে তারা লাঠিসোটা নিয়ে প্রথম আলো কার্যালয়ে ভাঙচুর শুরু করে। হামলায় কার্যালয়ের বেশির ভাগ জানালার কাচ ভেঙে ফেলা হয়। রাত ১২টার দিকে বিক্ষোভকারীদের একটি অংশ কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশ করে টেবিল-চেয়ার ও গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র বাইরে রাস্তায় বের করে নিয়ে আসে এবং সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের সময় বিক্ষোভকারীদের ‘ইনকিলাব ইনকিলাব, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ’, ‘নারায়ে তাকবির’ ‘আল্লাহু আকবর’সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন। প্রথম আলোর নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, প্রথমা প্রকাশনা, প্রথমা ডটকম, বিজ্ঞাপন, হিসাব শাখা, চরকিসহ বিভিন্ন বিভাগ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। পরে তারা ডেইলি স্টার ভবনের দিকে যায়। সেখানে হামলা ভাঙচুরের পর আগুন ধরিয়ে দেয়।

হামলা ভাংচুর এবং আগুনের ব্যাপারে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ১৮ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে ঢাকার কারওয়ান বাজারে অবস্থিত প্রথম আলোর অফিস উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সংগঠিত আক্রমণের শিকার হয়েছে। আক্রমণকালে কর্মরত সাংবাদিকেরা অনলাইন সংবাদপোর্টাল চালানোর পাশাপাশি ১৯ ডিসেম্বরের কাগজ প্রকাশের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। প্রথম আলোর কর্মীরা এই সন্ত্রাসী হামলার মুখে সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েন এবং জীবনের ঝুঁকিতে পড়ে যান। আক্রমণকারীরা অফিসের ভবন ব্যাপকভাবে ভাঙচুরের পরে তাতে অগ্নিসংযোগ করে। দীর্ঘ সময় ধরে চলা অগ্নিকাণ্ডের কারণে ভবন পুড়ে যায় এবং তাতে সংরক্ষিত সম্পদ ও মূল্যবান নথিপত্র ভস্মীভূত হয়।

প্রথম আলো অফিস আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা যাওয়ায় এ ব্যাপারে নিরাপত্তা চেয়ে সরকারের উচ্চপর্যায় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর বিভিন্ন বাহিনীসহ নানা মহলের সঙ্গে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু তারা পৌঁছানোর আগেই অফিস আক্রান্ত হয়ে পড়ে। কর্মরত উদ্বিগ্ন সাংবাদিক ও কর্মীরা জীবন বাঁচাতে কার্যালয় ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।

দৈনিক প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার রাতে হামলার ঘটনায় পত্রিকা দুটির সম্পাদকের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনাদের প্রতিষ্ঠান ও সংবাদকর্মীদের ওপর এই অনাকাক্সিক্ষত ও ন্যক্কারজনক হামলা আমাকে গভীরভাবে ব্যথিত করেছে। এই দুঃসময়ে সরকার আপনাদের পাশে আছে।’ প্রধান উপদেষ্টা বলেন, দেশের শীর্ষস্থানীয় দুটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ওপর এই হামলা স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর হামলার শামিল। এই ঘটনা দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে বিরাট বাধা সৃষ্টি করেছে। টেলিফোনে আলাপকালে সম্পাদকদের ও সংবাদমাধ্যমগুলোর পূর্ণ নিরাপত্তাসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন ড. ইউনূস। খুব শিগগিরই এই দুই সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে বলেও জানান প্রধান উপদেষ্টা।

বিএফইউজে- ডিইউজের নিন্দা

দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলা, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন- ডিইউজে। বিএফইউজে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহীন, মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী এবং ডিইউজে সভাপতি মো শহিদুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক খুরশীদ আলম এক যুক্ত বিবৃতিতে ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, গণমাধ্যমের ওপর হামলা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। কারণ, গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরে কখনো আইনের শাসন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। এ ধরনের হামলা সুস্থ রাজনীতির অন্তরায় উল্লেখ করে সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ বলেন, বিএফইউজে ও ডিইউজে শুরু থেকেই স্বাধীন মুক্ত গণমাধ্যমের জন্য লড়াই করে আসছে।

সম্পাদক পরিষদ ও নোয়াবের নিন্দা :

দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার-এর কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ন্যক্কারজনক ঘটনায় গভীর উদ্বেগ, ক্ষোভ এবং তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে সম্পাদক পরিষদ ও সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নোয়াব। ১৯ ডিসেম্বর রাতে গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি জানান সংগঠনের ২টির সভাপতি নূরুল কবীর ও এ. কে. আজাদ। এদিকে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি ও জাতীয় প্রেসক্লাব প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার অফিসে হামলার নিন্দা জানান।