দীর্ঘ সাত বছর পর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন করেছেন চিকিৎসা নিতে লন্ডনে যাওয়া বিএনপি চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। গত রোববার যুক্তরাজ্যের উত্তর লন্ডনের কিংস্টনে বড় ছেলে তারেক রহমানের বাসায় উৎসবমুখর পরিবেশে এই ঈদ উদযাপন করেন তিনি। এদিকে সোমবার বাংলাদেশ সময় রাতে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারাসহ বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সাথে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করেন খালেদা জিয়া। দীর্ঘদিন পর সবাইকে এভাবে একসাথে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। এ সময় আগামী দিনে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশনা দেন খালেদা জিয়া। বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া বর্তমানে অনেকটাই সুস্থ। চিকিৎসকরা অনুমতি দিলে চলতি মাসের মধ্যেই তিনি দেশে ফিরতে পারেন।
ক্ষমতার পালাবদলের পর গত ৬ আগস্ট খালেদা জিয়াকে স্থায়ী মুক্তি দেওয়া হয়। এরপর লিভার সিরোসিসসহ নানা জটিলতায় আক্রান্ত খালেদা জিয়া উন্নত চিকিৎসার জন্য ৮ জানুয়ারি লন্ডন যান। হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে সরাসরি তাকে দ্য লন্ডন ক্লিনিকে নেওয়া হয়। ১৭ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ২৫ জানুয়ারি লন্ডন ক্লিনিক থেকে তারেক রহমানের বাসায় যান তিনি। ওইদিন রাতে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন জানান, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ড এখনও লিভার প্রতিস্থাপনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়নি। তার বয়স ও সামগ্রিক স্বাস্থ্যের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বর্তমানে তারেক রহমানের বাসায় লন্ডন ক্লিনিকের ডা. প্যাট্রিক কেনেডি ও ডা. জেনিফার ক্রসের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা চলছে খালেদা জিয়ার।
দীর্ঘদিন পর লন্ডনে বড় ছেলের বাসায় এবার উৎসবমুখর পরিবেশে ঈদ উদযাপন করলেন খালেদা জিয়া। ঈদের দিন পারিবারিক একটি ছবিতে হাস্যোজ্জ্বল অবস্থায় তারেক রহমান, তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান ও তাদের কন্যা জায়মা রহমানের সঙ্গে খালেদা জিয়াকে দেখা গেছে। জানা যায়, লন্ডন সময় রোববার সকালে ঈদের নামাজ পড়ে বাসায় ফিরে মাকে নিয়ে এই ছবিটি তোলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এর আগে ওইদিন সকাল ১০টায় তারেক রহমান লন্ডনের কিংসমিডো স্টেডিয়ামের খোলা মাঠে ঈদের নামাজ আদায় করেন। তবে খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শর্মিলা রহমান সিঁথি গত রোববার ঢাকায় এসেছেন। মায়ের অসুস্থতার খবরে ওইদিন জরুরিভিত্তিতে লন্ডন থেকে ঢাকায় আসেন তিনি। শর্মিলা রহমানের মা মোকারেমা রেজা (৭০) রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে সিসিইউতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
খালেদা জিয়া এর আগে সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই চোখ ও পায়ের চিকিৎসা নিতে লন্ডনে গিয়েছিলেন। ওই সময় তিন মাস তারেক রহমানের বাসায় অবস্থান করেন এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঈদুল আযহা উদযাপন করেন। এরপর দেশে ফিরে দীর্ঘদিন কারাবন্দী থাকায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আর ঈদ উদযাপন করা হয়নি তার।
তবে এবার লন্ডনে পরিবারের সাথে ঈদ উদযাপনের পাশাপাশি ঢাকায় দলের নেতাদের সাথেও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন খালেদা জিয়া। বাংলাদেশে ঈদুল ফিতরের দিন সোমবার রাত ৯টায় লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি ঢাকার গুলশানে তার রাজনৈতিক কার্যালয়ে সমবেত দলের স্থায়ী কমিটিসহ বিভিন্ন স্তরের নেতাদের ঈদ মোবারক জানান এবং তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি আরও যুক্ত ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
এ সময় বিএনপির নেতাদের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, আগামী দিনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। একে অপরকে সহযোগিতা করতে হবে। সবাই মিলে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে অভিনন্দন জানান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এরপর তারেক রহমান সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বক্তব্য দেওয়ার অনুরোধ করেন।
সবার উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আপনাদের এত ত্যাগ ও সংগ্রাম বৃথা যায়নি এবং যাবে না। দেশবাসীর ভোটাধিকার সবাই মিলে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।’ পরে দেশবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানান। এ সময় আগামীর পথচলায় দেশবাসীর দোয়া ও আল্লাহর সাহায্য কামনা করেন তিনি।
বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর সঞ্চালনায় শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে আরও অংশ নেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, বরকত উল্লাহ বুলু, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদীন, নিতাই রায় চৌধুরী, আসাদুজ্জামান রিপন, নুরুল ইসলাম মনি, যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উন নবী খান সোহেল, সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, মহানগর উত্তরের আমিনুল হক, দক্ষিণের রফিকুল আলম মজনু, মহিলা দলের আফরোজা আব্বাস, সুলতানা আহমেদ, তাঁতী দলের আবুল কালাম আজাদসহ অন্যরা।
মাকে নিয়ে পার্কে ঘুরলেন তারেক রহমান : লন্ডনের একটি পার্কে স্থানীয় সময় মঙ্গলবার (১ এপ্রিল) বিকেলে খালেদা জিয়াকে ঘুরতে নিয়ে যান বড় ছেলে তারেক রহমান। এ সময় পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন বলে জানান বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান। খালেদা জিয়াকে নিয়ে পার্কে ঘোরার ভিডিওটি ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই ভিডিওতে দেখা যায়, খালেদা জিয়াকে একটি হুইল চেয়ারে বসিয়ে পার্কের ফুটপাথে ঘুরানো হচ্ছে। পাশেই তারেক রহমান তার পরিবারসহ হাঁটছেন। সঙ্গে আরও ছিলেন খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন।
কবে ফিরবেন খালেদা জিয়া : খালেদা জিয়া বর্তমানে শারীরিকভাবে অনেকটাই সুস্থ। ঈদের দিন পরিবারের সদস্যদের সাথে তার হাস্যেজ্জ্বল ছবি এবং পরবর্তীতে ঢাকায় বিএনপি নেতাদের সাথে ভার্চুয়ালি ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়কালেও সেটা ফুটে উঠেছে। লন্ডন ক্লিনিকের চিকিৎসকরা তারেক রহমানের বাসায় গিয়ে খালেদা জিয়াকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিচ্ছেন। তিনি চলতি এপ্রিল মাসের মধ্যেই দেশে ফিরতে পারেন। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, মধ্য এপ্রিলের পর যেকোনো দিন তিনি লন্ডন থেকে দেশে ফিরতে পারেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম গত রোববার রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, খালেদা জিয়া সম্ভবত এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে দেশে ফিরবেন। তবে এটা চূড়ান্ত না।
খালেদা জিয়ার পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য পরীক্ষা শুরু করেছে লন্ডন ক্লিনিকের চিকিৎসকরা
বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ‘পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য পরীক্ষা’ শুরু করেছে লন্ডন ক্লিনিকের চিকিৎসকরা। লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন গণমাধ্যমকে একথা জানান।
তিনি বলেন, বুধবার থেকে ম্যাডামের ‘পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য পরীক্ষা’ শুরু হয়েছে। আজকে, কালকে, পরশু.... আগামী চারদিন উনার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে, উনার ডাক্তাররা (লন্ডন ক্লিনিকের ডাক্তারগণ) বাসায় উনাকে দেখতে আসবেন। কিছু পরীক্ষা করার জন্য হয়ত উনাকে লন্ডনে ক্লিনিকেও নিয়ে যাওয়া হবে। আগামী কয়েকটি দিন বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা আছে যা চিকিৎসকদের পরামর্শক্রমে করা হচ্ছে।
কবে দেশে ফিরতে পারেন জানতে চাইলে জাহিদ বলেন, ডাক্তার সাহেবরা যেসব পরীক্ষা করতে বলেছেন সেগুলোর রিপোর্ট পর্যালোচনা করে এখানকার ডাক্তাররা পরবর্তিতে সিদ্ধান্ত নেবেন.... কত দ্রুত উনি ছুটি দেয়ার মতো অবস্থায় যেতে পারবেন।
বিএনপি চেয়ারপারসন লন্ডনের ডেভেরনশায়ার প্লেসে ‘দ্য লন্ডন ক্লিনিক’ এর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক প্যাট্টিক কেনেডি ও অধ্যাপক জেনিফার ক্রসের তত্ত্বাবধানে তারেক রহমানের বাসায় চিকিৎসাধীন আছেন।
গত ৮ জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য কাতারের আমীর শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির পাঠানো রাজকীয় এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী চিকিৎসার জন্য লন্ডন যান। লন্ডন পৌঁছে হিথ্রো আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে তাকে সরাসরি অ্যাম্বুলেন্সে করে ‘দ্য লন্ডন ক্লিনিক’ এ ভর্তি করা হয়। ১৭ দিন সেখানে চিকিৎধীন থাকার পর তার ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বাসায় নেয়ার শর্তসাপেক্ষে অনুমতি দেয় চিকিৎসকরা।
৭৯ বছর বয়সী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন থেকে লিভার সিরোসিস, কিডনি, হার্ট, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিসসহ নানা শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন।
খালেদা জিয়া আগের চেয়ে ভালো আছেন: এখন কেমন জানতে চাইলে অধ্যাপক জাহিদ বলেন, আলহামদুলিল্লাহ, ম্যাডামের মানসিক ও শারীরিক অবস্থা এখন স্থিতিশীল। মানসিকভাবে উনি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ভালো। মাচ বেটার।
পার্কে হুইল চেয়ারে ঘুরেছেন খালেদা জিয়া: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পার্কে ঘুরানো একটি ভিডিও প্রকাশের বিষয়টি ঠিক কিনা জানতে অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন বলেন, গত (মঙ্গলবার) হুইল চেয়ারে করে জাস্ট উনাকে (খালেদা জিয়া) গাড়ি থেকে নামিয়ে ঘুরনো হয়েছিল। আবহাওয়াটা... শীত কম ছিলো সেজন্য কিছুক্ষণ ঘুরানো হয়েছিলো।
একুট মন ভালো লাগার জন্য... উনাকে স্থানীয় একটি পার্কে(সাউথ-ওয়েস্ট ইনার লন্ডনে) গাড়ি থেকে নামিয়ে ঘুরানো হয়েছিলো এই আর কি। পার্কের নানা রঙের ফুল-টুল-বাগান... এগুলো দেখালে ম্যাডামের একটু ভালো লাগবে এই চিন্তা করে এটা করা হয়েছিলো। ডাক্তাররা বলেছিলেন যে, তোমরা যদি উনাকে একটু হাঁটাতে পারলে ভালো হয়... উনাকে যদি পারো গাড়ির মধ্যে বসিয়ে ঘুরানোর চেষ্টা করতে পারো এটাতে উনার মানসিক প্রশান্তির যেমন আসবে, শারীরিক সজীবতাও আসবে।
এখানকার পার্কের ভেতরে তো গাড়ি চালানো যায়, গাড়ির আলাদা রাস্তা আছে... উনাকে গাড়িতে করে ঘুরাতে নিয়ে পার্কে কিছুক্ষণের জন্য নামানো হয়েছিলো... গাড়ি থেকে হুইল চেয়ারে করে ফুলের বাগানের সাইট দিয়ে ঘুরানো হয়েছিলো। বাসার বাইরে নিয়ে ঘুরানোর জন্যই এটা করা হয়েছিল আর কি।
এবার লন্ডনে তারেকের বাসায় দুই ছেলের পরিবারের সদস্য নিয়ে একান্তে ঈদ উদযাপন করেন খালেদা জিয়া। লন্ডনে আছেন তারেক রহমান ও মরহুম ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর পরিবারের সদস্যরা।
খালেদা জিয়ার লন্ডনে এটি তৃতীয় ঈদ উদযাপন। এবার দশ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো ছেলে তারেক রহমানের বাসায় ঈদ পালন করছেন।
এর আগে ২০১৭ সালে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গিয়ে ছেলের বাসায় ঈদুল আযহা উদযাপন করেছিলেন। এরও আগে এক-এগারোর পরে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে প্রায় আট বছর পর লন্ডনে পরিবারের সদস্যদের সাথে ঈদ উদযাপন করেছিলেন।