প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা আমাদের এজেন্ডার শীর্ষে রয়েছে। আমি জনগণকে আশ্বস্ত করেছি, একবার নির্বাচন পরিচালনায় আমাদের ম্যান্ডেট পূরণ হয়ে গেলে এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হলে, আমরা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করবো। বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের পাশাপাশি দেশের প্রতিটি নাগরিকের, সে নারী হোক কিংবা ধর্মীয় সংখ্যালঘু অথবা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্য হোক না কেন সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে আমরা দৃঢ়ভাবে কাজ করে যাবো।

গতকাল শুক্রবার ব্যাংককে অনুষ্ঠিত ৬ষ্ঠ বিমসটেক সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং টেকসই প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধারের জন্য বলিষ্ঠ ও সুদূরপ্রসারী সংস্কার করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা সুশাসন, দুর্নীতি দমন এবং অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা যে সংস্কারের পরিকল্পনা করেছি তার মূলে রয়েছে এগুলোই। জনগণের মালিকানা, জবাবদিহিতা ও জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করতে বিচার বিভাগ, নির্বাচনী ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও সংবিধান সংস্কারের সুপারিশ করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার ছয়টি কমিশন গঠন করে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, কমিশনগুলো ইতোমধ্যে তাদের সুপারিশ জমা দিয়েছে, যা সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন রয়েছে। স্বতন্ত্র কমিশনগুলোর পেশ করা সুপারিশ বিবেচনা ও গ্রহণের জন্য আমি আমার নেতৃত্বে এবং ছয়টি কমিশনের প্রধানদের সমন্বয়ে সাত সদস্যের একটি ‘জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন’ গঠন করেছি। গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, শ্রম ও নারী অধিকারের বিষয়ে নীতি সুপারিশ করতে আমরা সম্প্রতি চারটি অতিরিক্ত কমিশন গঠন করেছি।

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে একটি বর্বর সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৯ মাস লড়াইয়ে গণহত্যায় লাখ লাখ সাধারণ নারী-পুরুষ, শিশু ও যুবক সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ স্বীকার করে। আমাদের জনগণ একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়সঙ্গত এবং মুক্ত সমাজের আকাক্সক্ষা করেছিল, যেখানে প্রতিটি সাধারণ মানুষ তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারে। দুঃখজনকভাবে, গত ১৫ বছরের সময়কালে, আমাদের জনগণ, বিশেষ করে তরুণরা ক্রমান্বয়ে তাদের স্থান এবং অধিকারকে সংকুচিত হতে দেখেছে। তারা প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের গভীর অবক্ষয় প্রত্যক্ষ করেছে এবং নাগরিক অধিকার পদদলিত হয়েছে। ১১৮ শিশুসহ প্রায় ২ হাজার নিরীহ মানুষ, যাদের বেশিরভাগই যুবক, তাদের জীবনের বিনিময়ে নৃশংস কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান ঘটায় সাধারন মানুষ।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের মানুষ তার ইতিহাসে পুনর্জন্ম প্রত্যক্ষ করেছে। শেখ হাসিনার দুর্নীতিগ্রস্ত ও স্বৈরাচারী শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করা ছাত্রনেতারা ইতিহাসের এই ক্রান্তিলগ্নে দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আমার কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন। আমি আমাদের জনগণের স্বার্থে দায়িত্ব নিতে রাজি হয়েছি।

এসময় তিনি মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে সাম্প্রতিক বিধ্বংসী ভূমিকম্পের ফলে প্রাণহানির ঘটনায় থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের সরকার ও জনগণের প্রতি আন্তরিক শোক ও গভীর সহানুভূতি প্রকাশ করেন। তিনি প্রিয়জন হারানো পরিবারগুলোর প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানান এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেন।

‘থ্রি জিরো’র বিশ্ব গড়তে চায় বাংলাদেশ

বাংলাদেশ ‘থ্রি জিরো’ অর্থাৎ শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব, শূন্য কার্বন নির্গমন বিশ্ব গড়ে তুলতে চায় বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, বিমসটেক অঞ্চলে বিশ্বের জনসংখ্যার পাঁচ ভাগের এক ভাগ বসবাস করে। এখানে প্রচুর চ্যালেঞ্জ থাকলেও সেগুলোকে সুযোগে রূপান্তরিত করার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা এমন অঞ্চল একটি কল্পনা করি, যেখানে সব দেশ এবং জনগণ সমতা, পারস্পরিক সম্মান, স্বার্থ এবং অভিন্ন কল্যাণের ভিত্তিতে সংযুক্ত থাকবে।

তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার সুদূরপ্রসারী সংস্কার বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যাতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত হয়। সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই এবং অর্থনীতির প্রতিটি স্তরে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য কাজ করছি। জ্বালানি নিরাপত্তা বিমসটেক অঞ্চলের টেকসই উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নবায়নযোগ্য শক্তি, আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ বাণিজ্য, এবং শক্তি দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য আমাদের একত্রে কাজ করতে হবে। নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচন আয়োজন সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে। প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধান না হলে পুরো অঞ্চলে অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। বিমসটেক রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের জন্য মিয়ানমারের সাথে আরও কার্যকর সংলাপ ও উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। ২০২৫ সালে জাতিসংঘের আওতায় অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ‘মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি সংক্রান্ত উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনে’ বিমসটেক সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণের আহ্বানও জানান তিনি। ড. ইউনূস বলেন, যুবশক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রযুক্তি কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োগ, জ্ঞান ও প্রযুক্তির বিনিময় নিশ্চিত এবং জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকার ছাড়াও অন্যান্য অংশীদারদের সম্পৃক্ত করার প্রতি আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত।